হিজরি সনের আদ্যোপান্ত | আহমদ শাহ আদীল
“দিন রাতের পরিবর্তনে আমাদের থেকে বিদায় গ্রহণ করে এক একটি দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর, আর এভাবেই আমাদের মাঝে উপস্থিত নতুন হিজরি নববর্ষ”
●হিজরি-
হিজরি শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো ত্যাগ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া।
●হিজরি সন প্রবর্তনের কারণ-
হিজরি ১৬ সন খলিফা হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র শাসনামলে প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবু মুসা আশয়ারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একবার খলিফা ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র দরবারে হযরত আবু মুসা আশয়ারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু চিঠি লিখলেন যে, ‘আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সম্বলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোন চিঠি কোন দিনের তা নির্ণয় করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদেরকে নির্দেশ কার্যকর করতে খুব কষ্ট করতে হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রতবোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে।
কেউ মত পোষণ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের মাস রবিউল আউয়াল থেকে বর্ষ শুরু। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র ওফাত মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। অন্যান্যের মতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র হিজরতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক।
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র এই বক্তব্যকে হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একবাক্যে সমর্থন করেন। অতপর বহু চিন্তাভাবনার পর হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হিজরতের বছর থেকেই ইসলামী দিনপঞ্জি গণনার সিদ্ধান্ত নেন।
হিজরি সনের প্রবর্তক ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ফারুকে আজম হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তবে এতে হযরত আবু মুসা আশয়ারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র আবেদন, হযরত মাওলা আলী এবং হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা’র যৌথ প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। সর্বশেষ ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬’জানুয়ারি শুক্রবার থেকে হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়।
●হিজরি সনের মাসঃ
হিজরি সনের মাস সংখ্যা মোট বারো। যেমনটা কুরআনুল কারীমে বর্ণনা করা হয়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন,
অর্থ:- নিশ্চয় মাসগুলোর সংখ্যা আল্লাহ্র নিকট বার মাস, আল্লাহ্র কিতাবের মধ্যে, যখন থেকে তিনি আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটা সম্মানিত। এটা সোজা দ্বীন। সুতরাং এ মাসগুলোর মধ্যে নিজেদের আত্মাগুলোর উপর যুলুম করো না এবং মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বদা যুদ্ধ করো, যেমনিভাবে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বদা যুদ্ধ করে এবং জেনে রেখো যে, আল্লাহ্ খোদাভীরুদের সাথে আছেন। (অনুবাদ- কানযুল ঈমান | সূরা- তাওবা, আয়াত : ৩৬)
মহররম- এটি আরবি মাসসমূহের প্রথম মাস। ইসলামের আগমনের আগে আরবদের নিকট এই মাসে কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাত করা হারাম এবং অবৈধ ছিল। তাই এই মাসকে মুহররমুল হারাম নামে নামকরণ হয়েছে।
সফর- সফর শব্দটি সিফর থেকে নির্গত। এর অর্থ শূন্য হওয়া, জাহেলি যুগে সফর মাসে লোকেরা যুদ্ধের জন্য বের হয়ে গেলে ঘর শূন্য হয়ে যেত, তাই সফরের মাসের নাম সফর রাখা হয়েছে।
রবিউস সানি- এই মাসের নামের অর্থ দ্বিতীয় বসন্ত। বসন্তের শেষার্ধে পড়ার কারণে এই মাসকে রবিউল আখের বা শেষ বসন্তও বলা হয়।
জুমাদাল উখরা- এই মাসের সময়কালে শৈত্যপ্রবাহের প্রচণ্ডতায় পানি পর্যন্ত জমে যেত। তাই এই মাসের নাম এভাবে রাখা হয়েছে।
শাবান- শাবান শা’ব শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এর অর্থ হলো বের হওয়া, শাখা-প্রশাখা হওয়া, প্রকাশ হওয়া, বিদীর্ণ হওয়া। যেহেতু এ মাসে বিপুল কল্যাণ প্রকাশিত হয়, মানুষের রিজিক উৎপাদন ও বণ্টিত হয় এবং তকদিরের ফয়সালাগুলোও বণ্টন করে দেওয়া হয়—তাই এ মাসের নাম শাবান রাখা হয়েছে।
শাওয়াল- শাওয়াল শব্দটি শাওল ধাতু থেকে নির্গত, অর্থ বাইরে গমন করা। এখানে আরববাসী নিজ ঘরবাড়ি থেকে ভ্রমণে বের হতো। তাই এর নামকরণ হয় শাওয়াল।
জিলহজ- জিলহজ আরবি মাসসমূহের সর্বশেষ মাস। জিলহজ শব্দটি হয়তো হজ্জ থেকে নেয়া হয়েছে। অর্থ একবার হজ করা অথবা শব্দটি হিজ থেকে নেওয়া হয়েছে। অর্থ বছর। যেহেতু এই মাস বছরের শেষাংশে আসে এবং এর দ্বারাই পূর্ণ বছরের সমাপ্তি ঘটে, তাই এই মাসের নামকরণ হয়েছে জিলহজ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনা মুনাওয়ারায় আসেন, তখন মাসটি ছিল রবিউল আউয়াল। আর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হিজরি সনের প্রথম মাস ধরেন মহররমকে। যদিও প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় পৌঁছেন রবিউল আওয়াল মাসে। কিন্তু হিজরতের পরিকল্পনা হয়েছিল নবুওয়তের ১৩তম বর্ষের হজের মৌসুমে। সময়টি ছিল মদিনার আনসারি সাহাবাদের সঙ্গে আকাবার দ্বিতীয় শপথ সংঘটিত হওয়ার পর। তখন ছিল জিলহজ মাস। আর তার পরের মাসই হলো মহররম।
প্রিয়নবির হিজরতের আগে মক্কার কুরাইশদের দ্বারা নিরপরাধ মুসলমানদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের কারণে প্রিয়নবি মুসলমানদেরকে মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দেন। আর মুসলমানদের মধ্য থেকে হিজরতকারী প্রথম দলটি মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন মহররম মাসে। মুসলমানদের এ হিজরত ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদিনায় হিজরতের শুভ সূচনা।
●হিজরি সনের গুরুত্বঃ
হিজরি সন ও তারিখের সাথে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। মুসলমানদের পবিত্র রমজানের রোজা, হজ, দুই ঈদ, শবে বরাত, শবে কদর, শবে মেরাজ এমনকি ইসলামের বিভিন্ন বিধি- বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। যেমন- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গ। (মুসলিম শরীফ)
হিজরি নববর্ষ উদযাপন মুসলমানদের সাংস্কৃতিক অংশ। তবে তা পালনে পশ্চিমা আবহ তৈরি করা হারাম। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহকর্মীদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার শিক্ষা গ্রহণ। পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ থেকে আল্লাহ তা’আলার নিকট ক্ষমা চাওয়া ও হিজরি নববর্ষে মুসলমানদের নব উদ্যমে উদ্দমী হতে প্রতিজ্ঞা করা উচিত।