প্রবন্ধ

হাদিস সংকলনের ইতিহাস

রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে হাদিসের পবিত্রতা রক্ষা এবং কুরআনে বিশদ ব্যাখ্যা ও পর্যালােচনার জন্য হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হয়। যার ফলে উমাইয়া খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর যুগে হাদিস সংকলনের শুভসূচনা হয় এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের যুগে তা পূর্ণতা লাভ করে।

হাদিস সংকলনের ইতিহাস :

সামগ্রিক বিশ্লেষণে হাদিস সংকলনের ইতিহাসকে মােট পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়। যথা-

ক. রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে হাদিস সংকলন।
খ. সাহাবায়ে কেরামের যুগে হাদিস সংকলন।
গ. ওমর ইবনে আবদুল আযীযের যুগে হাদিস সংকলন।
ঘ, আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়ার্কিলের যুগে হাদিস সংকলন।
ঙ. সিহাহ সিত্তাহ প্রণয়ন।

ক. মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে হাদিস সংকলন :

ইসলামের প্রাথমিক যুগে কুরআনের সাথে হাদিসের সংমিশ্রণের আশঙ্কা থাকায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে হাদিস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেছেন-
لا تكتبوا عنى غير القران ومن كتبه فليمحه
কিন্তু পরবর্তীতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লেখার মাধ্যমে হাদিস সংরক্ষণের অনুমতি প্রদান করলে সাহাবীগণ অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলন করেন। যেমন-

১) মদিনা সনদ : মুফতি আমীমুল ইহসান (র) বলেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিজরত করে মদিনায় গমন করার পর সেখানে সকল ধর্মের লোকদের সাথে সহাবস্থানের জন্য একটি চুক্তি সম্পাদন করেন, যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র।

২) ইসলাম গ্রহণকারীদের তালিকা : মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নব মুসলিমদের নামের তালিকা করতে নির্দেশ প্রদান করেন। এ ব্যাপারে আবু হােরায়রা (রা) বলেন-وكتبنا له الفا وخمس مائة رجل

৩) হযরত আবু যার (রা)-এর লেখা : হাফেয ইবনে আবদুল বার (র) লিখেছেন।

وكتب رسول الله صلى الله عليه وسلم كتاب الصدقات والديات والفرائض والسنن بعمرو بن حزم وغيره-
অর্থাৎ, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমর ইবনে হাযম ও অন্যান্যকে সদকা, দিয়াত এবং ফরয ও সুন্নাত সম্পর্কে এক দস্তাবেজ লিখে দিয়ােছিলেন।

৪) সন্ধিপত্র : বনু সাকীফের সাথে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক সন্ধিপত্র সম্পাদন করেন, যা নিম্নোক্ত শিরােনামে শুরু করেছিলেন
هذا الكتاب من رسول الله صلى الله عليه وسلم لثقيفٍ-

৫) অন্যান্য : বিভিন্ন গােত্র ও সম্প্রদায়ের প্রতি বিভিন্ন সময় লিখিত ফরমান, হুদায়বিয়ার সন্ধি, বিভিন্ন বাদশাহ ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে লিখিত ইসলামের দাওয়াত সংবলিত চিঠি ইত্যাদির মাধ্যমে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদিস সংকলন ও সংরক্ষণ করা হয়।

খ. সাহাবায়ে কেরামের যুগে হাদিস সংকলন :

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ওফাতের পর সাহাবীগণ হাদিস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সংকলনে আত্মনিয়ােগ করেন। বিশিষ্ট সাহাবীগণ ব্যক্তিগতভাবে কিছুসংখ্যক হাদিস সংগ্রহ করে তা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন। যেমন-

১) হযরত আলী (রা) কর্তৃক সংরক্ষিত হাদিস সংকলন ‘সহীফায়ে আলী’।
২) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা)-এর সংকলন সহীফায়ে সাদেকাহ’।
৩) হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা)-এর সংকলন ‘সহীফায়ে আনাস ইবনে মালেক’।
৪) হযরত ইবনে আব্বাস (রা) কর্তৃক সংকলিত ‘সহীফায়ে ইবনে আব্বাস’।
৫) হযরত ইবনে মাসউদ (রা) কর্তৃক সংকলিত ‘সহীফায়ে ইবনে মাসউদ’।
৬) হযরত আবু হােরায়রা (রা) কর্তৃক সংকলিত ‘সহীফায়ে আবু হােরায়রা’।

গ. ওমর ইবনে আবদুল আযীযের যুগে হাদিস সংকলন :

উমাইয়া খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর যুগেই সরকারিভাবে হাদিস সংকলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

১) খলিফার নির্দেশ জারি : দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে উমাইয়া খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ইসলামি রাষ্ট্রের সমগ্র এলাকায় এ নির্দেশ জারি করেন-
أنظر ما كان من حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم فاكتبه فانی خفت دروس العلم وذهاب العلماء-
এ সময় খলিফার নির্দেশ মােতাবেক মদিনার গভর্নর হযরত আবু বকর ইবনে হাযম বিপুল সংখ্যক হাদিস সংগ্রহ করে হাদিসের কয়েকটি খণ্ড গ্রন্থ সংকলন করেন।

২) মুহাদ্দিসগণের হাদিস সংকলনে আত্মনিয়ােগ : সে সময় ইসলামি রাষ্ট্রের আনাচে-কানাচে হাদিসবিশারদগণ হাদিসে নববী গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। যেমন- ইবনে জুরাইজ, আওযায়ী, যুহরী, সাওরী, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী, মাকতুল, হিশাম, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা প্রমুখ। এদের প্রত্যেকেই পৃথক পৃথকভাবে হাদিসের পান্ডুলিপি তৈরি করেন।

ঘ. খলিফা মুতাওয়াক্কিলের যুগে হাদিস সংকলন :

আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের যুগ হলাে হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলনের সােনালি যুগ। এ যুগ তৃতীয় শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম শতাব্দীতে শেষ হয়।

১) মুতাওয়াক্কিলের উদ্যোগ : খলিফা মুতাওয়াক্কিলের যুগে স্বার্থান্বেষী গােষ্ঠী নিজেদের মতবাদ প্রমাণ ও ইসলামি সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার নিমিত্তে মিথ্যা হাদিস প্রচার শুরু করে। তখন খলিফা মুতাওয়াক্কিল সরকারিভাবে হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলনে উদ্যোগী হন। তিনি হাদিস শিক্ষাদানের জন্য অনেক মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন।

২) রিওয়ায়াত ও দিরায়াত : মুহাদ্দিসগণ সহীহ হাদিস ও জাল হাদিসের মধ্যে পার্থক্য প্রমাণ করার জন্য রিওয়ায়াত ও দিরায়াত নামে দুটি হাদিস পরীক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন। তাঁরা অত্যন্ত যাচাইবাছাই করে সহীহ হাদিসসমূহ নিজেদের সংকলিত গ্রন্থে উদ্ধৃত করেন।

ঙ. সিহাহ সিত্তাহ প্রণয়ন :

এ যুগে কয়েকজন শ্রেষ্ঠ মনীষীর আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ৬টি হাদিসগ্রন্থ সংকলন হয়।
গ্রন্থগুলাে হলাে- যথা:

১. ইমাম বুখারী (র) সংকলিত ‘সহীহ বুখারী’।
২. ইমাম মুসলিম (র) সংকলিত ‘সহীহ মুসলিম’।
৩. ইমাম তিরমিযী (র) সংকলিত ‘জামে তিরমিযী’।
৪. ইমাম আবু দাউদ (র) সংকলিত ‘সুনানে আবু দাউদ’।
৫. ইমাম নাসায়ী (র) সংকলিত ‘সুনানে নাসায়ী’।
৬. ইমাম ইবনে মাজাহ (র) সংকলিত ‘সুনানে ইবনে মাজাহ’।

 

 

হাদিস সংকলনের সময়ােচিত পদক্ষেপ নিয়ে উমাইয়া খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ও আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাওয়াক্কিল (র) যে অবদান রেখেছেন মুসলিম জাতির নিকট তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।