প্রবন্ধ

মহিলা সাহাবীদের নবীপ্রেম

 

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ রিদওয়ান

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মহিলা সাহাবীদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রথম যাঁর নাম আলোচনা করতে হবে, সেই মহিয়সী শ্রেষ্ঠ মহিলা হলেন উম্মুল মু’মেনীন রফীক্বায়ে হায়াতে সৈয়্যদুল মুরসালীন হযরত খাদীজাতুল কোবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা।

তিনি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শুধু সাহাবী নন, জীবন সঙ্গীনীও। সে হিসেবে রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে। শুধু তা নয়, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নুবূয়ত প্রকাশ পূর্ব থেকেই তিনি আল্লাহর রসূলের সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন। হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার অন্তরে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র জন্য যে অগাধ প্রেম-ভক্তি ছিলো ইতিহাসে তুলনা দেয়ার মতো দ্বিতীয় আর কোন দৃষ্টান্ত নেই। প্রিয় নবীকে কেমন ভালবাসতে হবে তার দৃষ্টান্ত হিসেবে হযরত মা খাজিদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-ই যথেষ্ট।

 

আমার সব কিছু আমার নবীরই

 

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার যখন শুভ বিবাহ্ সম্পন্ন হলো, তখন কুরাইশদের কতিপয় ইর্ষাকাতর লোভী ও হিংসুক প্রকৃতির লোক বলতে লাগলো, ‘‘মক্কার বিখ্যাত ব্যবসায়ী খুওয়াইলিদ তনয়া খাদিজা সর্বাপেক্ষা অভিজাত এবং ধনী হয়েও কেন নিঃস্ব এক যুবক আবদুল্লাহ’র পুত্র মুহাম্মদকে বিবাহ করে আমরা ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের সম্মান নষ্ট করলো- আমরা তো তা কোন ভাবেই মানতে পারছি না। খাদিজা আমাদের মর্যাদাহানী করেছে, আমাদেরকে অপমান করেছে, আমরা এর উপযুক্ত প্রতিশোধ নেব।’’

ঈর্ষাকাতর নিন্দুকদের এসব কথা শুনে হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা মক্কার কুরাইশ কাফির সর্দারদেরকে দাওয়াত দিয়ে একত্রিত করলেন, এবং সকলের সম্মুখে ব্যক্তিত্বপূর্ণভাবে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন- পবিত্র মক্কানগরীর হে ধনী সম্প্রদায়! আমার নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী সকলেই শুনুন! আমি আপনাদেরই প্রতিবেশী একজন মহিলা। যে ধন সম্পদের বড়াই করে আপনারা গরীব-নিঃস্বকে ঘৃণা করেন সেই সম্পদে আমি আপনাদের নেতৃস্থানীয়া। কিন্তু কুরাইশ সর্দার আবদুল মোত্তালিবের পৌত্র হযরত মুহাম্মদকে বিবাহ করার অপরাধে আপনারা আমার ব্যপারে যা কিছু বলছেন তা আমার কানে এসেছে। আমি আপনাদের সকলের সম্মুখে বলে দিতে চাই- আমার ধন-সম্পদ সকল বিত্ত-বৈভব এমনকি আমার প্রাণটাও আমার প্রিয় স্বামী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র জন্য উৎসর্গ করে দিলাম। আপনারা সবাই সাক্ষী থাকুন; আজ হতে উক্ত সকল সম্পত্তির উপর আমার কোন দাবী-দাওয়া থাকবে না। আজ হতে আমার স্বামী সমস্ত সম্পত্তির মালিক হলেন। যাঁকে পুরো জীবনটুকু সঁপে দিয়ে চির জীবনের সঙ্গীরূপে গ্রহণ করেছি। যাঁর গভীর আকর্ষণে সুখ শান্তি ভোগ-বিলাস সব কিছু বিসর্জন দিয়ে দুঃখ ক্লেশকে সানন্দে গ্রহণ করেছি, তাঁকে হিংসুকের দল অবহেলা করবে তা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি হযরত খাজিদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার এ অভাবিত প্রেম-ভালবাসা দেখে মক্কার সকল সর্দার বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে রইল। এরূপ ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের কথা তারা জীবনে কোন দিন শোনেনি। হয়তো পৃথিবীবাসী ভবিষ্যতেও শুনবে না।

 

হযরত উম্মুল মু’মিনীন খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার প্রতিটি ঘটনা অকল্পণীয় বিস্ময়কর। যেমন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন হেরা পর্বতের সুউচ্চ গুহায় ধ্যান যাপন করতে যেতেন, সেই সুউচ্চ গুহায় হযরত মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা প্রতিদিন আমাদের নবীর জন্য দু’বার খাবার রান্না করে নিজেই নিয়ে যেতেন। সেই সময়ে পাহাড়ে উঠার কোন তেমন সু-ব্যবস্থা ছিলো না কিভাবে উঠতেন? কতো প্রেম থাকলে তা সম্ভব। বর্তমানে অনেক হাজী সাহেব হজ্জ করতে গেলে সেই হেরার গুহা দেখার জন্য মন চাইলেও এতো উঁচুতে উঠার সাহস করেন না। আবার অনেকে সাহস করলেও উঁঠতে হাঁপিয়ে উঠেন। অথচ হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সেই যুগে কোন সুব্যস্থা না থাকা সত্ত্বেও প্রিয় নবরি ভালবাসায় সেই উঁচু পাহাড়ে উঠে যেতেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি ভালবাসার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা একেবারে বিরলই। নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মাধ্যমে তিনি যে গুণাবলী ও অনুপম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছেন তা কেয়ামত পর্যন্ত সকল নারীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।

 

হযরত মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার অনুপম গুণাবলী ও শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য সমূহ
মু’মিনদের মাতা হযরত খাদিজাতুল কোবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা এমন এক সৌভাগ্যবতী রমণী যিনি, কুল মাখলুকাতের শ্রেষ্ঠ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান জীবন সঙ্গীনী; যাঁকে নিয়ে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর মহাশান্তি ও সুখের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি জীবিত থাকাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আর কোন বিবাহ্ করেননি।

 

নারীর মধ্যে হযরত খাজিদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন

 

ইসলামের ইতিহাসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উম্মতের নারীদের মধ্যে হযরত মা খাদিজাই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলমান। যিনি অযু ও নামাযের নিয়ম কানুন সর্বপ্রথম শিক্ষা লাভ করার গৌরব অর্জন করেন। ইসলামের প্রথমাবস্থায় যে দু’জন ব্যক্তির অর্থানুকল্যে ইসলাম বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিলো তাঁদের অন্যতম হযরত খাজিদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি হযরত মা খাজিদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার প্রেম-প্রীতি, ভক্তি-ভালবাসা এবং আত্মোৎসর্গের তুলনা নেই। দুর্যোগময় ও প্রতিকুল অবস্থায় হযরত মা খাদিজাই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পারিবারিক জীবনে শান্তি, আরাম ও নিরাপত্তার একমাত্র নির্ভরযোগ্য ছিলেন। হযরত রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন চিন্তাক্লিষ্ট হৃদয়ে ঘরে ফিরে আসতেন তখন তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ মিষ্টালাপ ও শান্ত্বনাবাক্য দ্বারা আপন স্বামী রাসূল পাকের মনে নতুন শক্তি ও সজীবতা সৃষ্টি করতেন। অকেন সময় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বাইরে থেকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘরে ফিরে আসলে মা খাদিজা ঘরে অন্য সব কাজ ফেলে স্বামীর পাশে এসে বসতেন এবং নানাভাবে তাঁর মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করতেন।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার ধন-ঐশ্বর্য হাতে পেয়ে তা মুক্ত হস্তে দান করতে লাগলেন। নিজেদের ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার জন্য কিছুই ব্যয় করলেন না। সমস্ত সম্পদ গরীব-দুঃখী ইসলাম ও মুসলমানের জন্য খরচ করেন। এ ব্যাপারে হযরত মা খাদিজা কোন প্রকার অীভযোগ বা নিষেধ ইত্যাদি করা তো দূরের কথা বরং তিনি তাঁকে আরও উৎসাহিত করতেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রতিকুল পরিস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন কোন বিপদগ্রস্ত হতেন, তখন একমাত্র হযরত মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাই তাঁকে সেই নিরাশার মাঝেও আশার বাণী শুনাতেন, শান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘‘প্রিয়তম! আল্লাহ্ তা‘আলাই আপনাকে সাহায্য করবেন।’’

 

হযরত মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার অনুপম গুণাবলী ও মধুর ব্যবহার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র অন্তরে এমন গভীর প্রেম-প্রীতির আসন দখল করেছিলো যে, তাঁর মৃত্যুর পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একটি দিনের জন্য তাঁকে ভুলতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর শপথ! খাদিজার ন্যায় উত্তম স্ত্রী আমি আর একজনও পাইনি। সারা আরবদেশ যখন আমাকে অবিশ্বাস করেছিলো তখন হযরত খাদিজাই আমার উপর ঈমান এনেছিলো। সে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি আমার নামে উৎসর্গ করেছিলো। আর সে-ই আমাকে শান্ত্বনা দান করেছে। সুতরাং তাঁর সাথে অন্য আর কোন স্ত্রীর তুলনা হয় না। একমাত্র হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার গর্ভের সন্তানদের মাধ্যমেই জগতে নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র বংশ জগতে বিস্তার লাভ করেছে।

 

হযরত মা ফাতেমাতুয্ যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার মতো কন্যারত্ন যিনি ‘খাতুনে জান্নাত’ অর্থাৎ বেবেশতের নারীদের সর্দার আখ্যায়িত হয়েছিলেন তিনি হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার গর্ভেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।

 

এ পৃথিবীতে জীবিত অবস্থায় বেহেশত লাভের প্রতিশ্রুতি ও সুসংবাদ দু’জন নারীকেই দেয়া হয়। তাঁদের একজন উম্মুল মু’মেনীন হযরত মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা, অন্যজন তাঁর কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা।

 

হযরত মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা আরবের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন বলে তিনি কখনও সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেননি বরং তাঁর সম্পদ সমুদয় ইসলামের খেদমতে দান করেছেন। আরবের সমস্ত দুঃস্থ নর-নারীকে তিনি মুক্ত হস্তে দান করতেন। সকলে হযরত মা খাদিজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তাঁর দানশীলতা, পবিত্রতা, ধার্মিকতা, সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর ওফাতের সময় দুঃস্থ নর-নারীদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো। তাঁর চরিত্রের নির্মলতা ও পবিত্রতার কথা আরবের সেই অন্ধকার যুগেও প্রসিদ্ধ ছিলো। তা আজও মানুষ নির্দ্বিধায় স্মরণ করে।

 

মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা এমন এক ভাগ্যবতী মহিলা, যিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র হাতের উপর মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই মা খাদিজার কবরে নেমে তাঁরই পবিত্র হাতে মা খাদিজার শব দেহ কবরে রেখে ছিলেন।

 

রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র জীবদ্দশায় তাঁরই সামনে অনেক আত্মীয় স্বজন মৃত্যু বরণ করলেও হযরত মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার মৃত্যুর বছরটিকে ‘আমল খুযন’ ‘শোকের বছর’ ঘোষণা করা হলো। সে ব্যপারে কেয়ামত পর্যন্ত ইতিহাস সাক্ষী থাকবে। এ থেকে বুঝা যায় মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকেও প্রিয় বনী কতো ভালবাসতেন।

 

রাসূলে পাক কর্তৃক হযরত খাদিজা (রাদ্বি.)’র প্রশংসা

 

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘আসমান ও যমীনের মধ্যে যত রমনী রয়েছে তাঁদের মধ্যে বিবি মরিয়ম ও হযরত খাদিজাই সর্বোত্তম। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে ভীষণ ভালবাসতেন। তাঁর ইন্তিকালের পরও প্রায় সর্বদা তাঁকে স্মরণ করতেন এবং কথা প্রসঙ্গে তাঁর প্রশংসা করতেন। বিভিন্ন ঘটনা ও কাজের কথা বর্ণনা করতে করতে তাঁর রূহের জন্য শুভ কামনা করতেন এবং দো’আ প্রার্থনা করতেন।

একদা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অনেক্ষণ পর্যন্ত হযরত খাজিদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার জন্য দো’আ করছিলেন তখন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বিরক্তির সূরে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! একজন বৃদ্ধা স্ত্রী লোক, যিনি ইন্তিকাল করেছেন, তাঁর জন্য আপনি এতই ব্যকুলতা প্রকাশ করছেন! ওই বুড়ীর কথা কেন বার বার বলছেন? আল্লাহ্ তা‘আলা তো তার চাইতেও উত্তম যুবতী স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন।

 

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার এ মন্তব্য শুনে প্রিয় নবী খুবই মর্মাহত হলেন এবং বললেন, ‘‘হে আয়েশা! আল্লাহর শপথ! হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার চেয়ে উত্তম স্ত্রী আমি দ্বিতীয় একজনই পায়নি। সারা বিশ্বের মানুষ যখন আমাকে অবিশ্বাস করেছে তখন এ খাজিাই আমার উপর ঈমান এনেছে। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে উৎসর্গ করেছে। হে আয়েশা! খাদিজার সাথে অন্য কোন নারীর তুলনা হয়না। তাঁর মতো উত্তম স্ত্রী আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে আর দান করেননি। হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সম্বন্ধে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরেকবার ইরশাদ করেছেন, ‘‘হযরত খাদিজার তুলনা স্বয়ং হযরত খাদিজাই। তাঁর সাথে কোন নারীর তুলনা হতে পারে না। তাঁর মতো ধর্মপরায়ণা, দয়াবতী, দানশীলা, পুণ্যবতী, বুদ্ধিমতী এবং সর্বগুণে গুণান্বিত আর নেই, হবেও না।

 

খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার নবীপ্রেমের আরেক দৃষ্টান্ত বিজ্ঞ পাঠকের অবশ্যই জানা থাকবে, হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার সাথে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার আগে তিনি তাঁকে তার ব্যবসার দায়িত্বভার দিয়ে সিরিয়া পাঠিয়েছেন- হযরতকে সাহায্য সহযোগীতার জন্য ‘মায়সারা’ নামের বিশ্বাসী সুচতুর এক দাসকে এবং খোসায়মা নামের এক আত্মীয়কে সাথে দিয়েছেন।

 

যাওয়ার সময় ‘মায়সারাকে’ মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বিশেষ যে উপদেশ দিয়েছিলেন সেই থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় মা খাদিজার পবিত্র অন্তরে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি প্রেম-ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিলো।মা খাদিজা মায়সারাকে বলেছিলেন- মায়সারা! তোমাকে তাঁর সাথে এ জন্য পাঠাচ্ছি তুমি সর্বদা তাঁর সাথে থাকবে, তাঁর সেবা করবে এবং রাস্তায় যেন তাঁর কোন অসুবিধা না হয়। তাঁর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে। কোন প্রকার আদান-প্রদান বা ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি ব্যাপারে কখনো কোন মন্তব্য করবে না। তাঁর কাজে কোন বাঁধা প্রদান করবে না। তাঁর বিনা অনুমতিতে কোন কাজ করবে না। প্রত্যেকটি কাজ করার পূর্বে তাঁকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে, তাঁর অনুমতি নেবে। সাবধান! কখনো তাঁর অবাধ্য হয়ো না এবং শালীনতা পূর্ণ আচরণ করবে।

 

আমার আদেশ পুরোপুরি পালন করে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পারলে তোমাকে আমি আশাতীত পুরষ্কার দিয়ে চিরদিনের জন্য দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেব। [আল্লাহু আকবর] নবী পাকের প্রতি এমন ভক্তি ও ভালবাসা! প্রকৃত পক্ষে নবীর প্রতি ভালবাসা, ভক্তি-বিশ্বাস কেমন হওয়া উচিত, হযরত মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। হযরত মা খাদিজার নবী প্রেমের আন্দাজ এ থেকেও বুঝা যায় যে, শেষ বয়সে তিনি একদিন বলেছিলেন, ‘‘হে আমার হাবীব, আমার মুনিব, আমার মাথার মুকুট আপনি আমার পাশে একটু সময় নিয়ে বসুন। আমার শেষ ইচ্ছা- আপনাকে আমি মন ভরে দেখব আর আমার অন্তরেকে শান্ত করব। আমার একান্ত বিশ্বাস যে, আপনার এ সৌন্দর্য দর্শনই আমার পরকাল মুক্তির একমাত্র ওসিলা।’’ প্রিয় নবী যখন হয়রত খাদিজার পার্শ্বে বসলেন, তখন মা খাদিজা আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি আমার জীবন আপনার খিদমতে ব্যয় করেছি এখন তো আমার বিদায়ের সময় এসে গেছে। ইয়া রাসূলাল্লাহ্ অন্তরে আপনার বিচ্ছেদ জ্বালা নিয়ে যাচ্ছি। ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার জীবনের শেষ প্রান্তে আপনার পাক চরণে আমার আরয, কিয়ামত দিবসে যেন এ দাসীকে আপনার সাথে রাখেন, আল্লাহর কাছে যেন আমার ক্ষমা ও মুক্তির সুপারিশ করেন। সেই কঠিন মুহুর্তে আপনার সুপারিশ ও শাফা‘আতের প্রার্থনা করছি এবং বিশেষ করে আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনার খিদমত করতে গিয়ে যদি কোন প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে- ক্ষমা করে দেবেন এবং আমার মেয়েদের প্রতি সজাগ ও দয়ার দৃষ্টি রাখবেন বিশেষ করে সব চেয়ে ছোট মেয়ে ফাতিমার প্রতি! সে খুব ছোট বয়সেই মা হারা হয়ে যাবে।

 

দয়ার নবী তাজেদারে আরব ও আজম হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র চক্ষু যুগল অশ্রুতে ভরে গেল। চোখের পানি ধরে রাখতে না পেরে মা খাদিজার পার্শ্বে মেয়ে ফাতিমাকে বসিয়ে নবীয়ে পাক উঠে গেলেন। মেয়ে ফাতিমাকে পেয়ে মা খাদিজা বলতে লাগলেন হে আমার কলিজার টুকরা মেয়ে ফাতিমা! তোমার আব্বাজানকে বলো তোমার মায়ের জীবনের শেষ ইচ্ছা যে, ‘‘ওহী নাযিল হওয়ার সময় তোমার আব্বাজানের পবিত্র শরীরে যে মুবারক চাদর খানা ছিলো সে মুবারক চাদর খানা যেন আমার কাফনের জন্য দেন। ওই পবিত্র চাদর শরীফের ওসিলায় যেন আমি আল্লাহর অবারিত রহমত-বরকত লাভে ধন্য হতে পারি।