প্রবন্ধ

মি’রাজ (তাত্ত্বিক ধারাবাহিক আলোচনা)

মাওলানা মুহাম্মদ ওসমান গণি

মি’রাজ সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম বিস্ময়কর শ্রেষ্ঠ মু’জিযা, যা অন্য কোন নবী রাসূলের ভাগ্যে জুটেনি।

• মি’রাজ অর্থ হলাে উর্ধ্ব গমনের সিঁড়ি। মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে বলা হয় আসরা যা পবিত্র কুরআন মাজীদ দ্বারা প্রমাণিত। এটাকে বিশ্বাস করা আবশ্যক এবং অস্বীকার করা কুফরী আর অস্বীকারকারী হবে কাফির।

 

• মসজিদে আকসা থেকে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ভ্রমণ মুতাওয়াতির কিংবা মশহুর হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত বিধায় এটার অস্বীকারকারী হবে বিদআতী ও ফাসিক।

 

• লা’মকান পর্যন্ত ভ্রমণ এবং মি’রাজের বিভিন্ন আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহ খবরে ওয়াহিদ দ্বারা সাব্যস্ত তাই ঐগুলাের অস্বীকারকারী মূর্খ, বঞ্চিত ও হতভাগা হিসেবে বিবেচিত হবে। (মাদারিজ্জুন নবুয়্যত)

 

মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে বলা হয় আসরা। মসজিদে আকসা তথা বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ভ্রমণকে বলা হয় মি’রাজ আর আসমান থেকে ‘কাবা কাউসাইন পর্যন্ত ভ্ৰমণকে বলা হয় ইরাজ। (ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ)

 

মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মােকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা বনী ইসরাঈলের শুরুতে বর্ণনা দিয়ে বলেন —

 

سبحان الذي أسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام إلى المسجد الأقصى الذي باركنا حوله لنريه من آياتنا إنه هو السميع البصير

 

অর্থ- পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বিশেষ বান্দাকে রাত্রির কিছু অংশে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি- যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী, দর্শনশীল। (সূরা বনী-ইসরাইল)

 

যে কোন ভ্ৰমণ কাহিনীতে সাধারণত সাতটি বিষয়ের উল্লেখ থাকে। যথা- ১. ভ্রমণ কে করায়েছেন? ২. ভ্রমণ কে করেছেন? ৩. ভ্রমণ কোথা হতে করলেন? ৪. ভ্ৰমণ কোথা পর্যন্ত করলেন? ৫. ভ্রমণ কখন করেছেন? ৬. ভ্ৰমণ কতক্ষণ সময় পর্যন্ত করেছেন? ও ৭. ভ্রমণ কি উদ্দেশ্যে করলেন?

 

আল্লাহ তায়ালা উপরােক্ত আয়াতে সবগুলাে উল্লেখ করেছেন। ১. সুবহান তথা পুত-পবিত্র মহান আল্লাহ তায়ালা ভ্রমণ করায়েছেন। ২. ভ্ৰমণ তাঁর বিশেষ বান্দা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন। ৩. মসজিদে হারাম থেকে ভ্রমণ করেছেন। ৪. মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন। ৫. রাতের বেলায় ভ্রমণ করেছেন। ৬. রাত্রে মাত্র অল্প সময়ে এবং ৭. আল্লাহর নির্দর্শন দেখানাের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করানাে হয়েছে।

 

সুবহান শব্দের অর্থ হলাে আল্লাহ সমস্ত অসম্ভব থেকে পাক ও মুক্ত। অর্থাৎ তাঁর জন্য অসম্ভব বলতে কিছুই নেই। মুহূর্তের মধ্যে বাইতুল মােকাদ্দাস, সপ্ত আসমান ও লা মকান পর্যন্ত যাওয়া-আসা এবং জান্নাত-জাহান্নামসহ আল্লাহর অসংখ্য কুদরতী নির্দর্শন পরিদর্শন করা কোন মাখলুকের জন্য অসম্ভব হলেও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর জন্য মােটেই অসম্ভব নয়। তাই তিনি মিরাজের ঘটনা সুবহান শব্দ দিয়ে বর্ণনা করেন।

 

মি’রাজের ঘটনায় بعبده বলার কারণ

মি’রাজের ঘটনায় আল্লাহ তায়ালাبرسوله  না বলে بعبده বলার কারণ হলোে- রাসুল বলা হয় যিনি আল্লাহর নিকট থেকে বান্দার নিকট আগমন করেন পক্ষান্তরে ‘আবদুন’ বলা হয় যিনি বান্দাদের নিকট থেকে আল্লাহর নিকট গমন করেন। এখানে আল্লাহর নিকট থেকে আসা নয় বরং আল্লাহর নিকট যাওয়ার ব্যাপার, তাই এখানে بعبده বলা হয়েছে। এর দ্বিতীয় কারণ হলাে রাসূল সাল্লাল্লাহু এর এই বিরাট মর্যাদা প্রাপ্তির কারণ হলাে উবুদিয়ত। অর্থাৎ বান্দা যখন আল্লাহর নিকট বিনয়ী হয় তখন আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তৃতীয় কারণ হলাে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র এই মর্যাদা দেখে যেন কেউ তাঁকে খােদা বা খোদার সন্তান না বলে। যেভাবে হযরত ঈসা (আ.) কে আসমানে তুলে নেয়ার কারণে ঈসায়ীরা তাঁকে খােদা বলে গােমরাহ হয়েছিল। চতুর্থ কারণ হলো ‘আবদ’ বলার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মি’রাজ ঘুমে, স্বপ্নে বা  রূহানীভাবে নয় বরং জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মি’রাজ হয়েছিল। কারণ আবদ বলা হয় শরীর ও রূহ উভয়ের সমষ্টিকে। কেবল রূহের উপর আবদ এর ব্যবহার হয়না। মি’রাজ সংঘটিত হয় বিশুদ্ধ মতানুযায়ী হিজরতের এক বছর পূর্বে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত ২৭ তারিখ রাতে।

 

ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ (র.) এর বর্ণনা মতে মিরাজ হাতীমে কাবা থেকে আরম্ভ হয়েছিল। ইমাম নাসাঈ’র অন্য বর্ণনা মতে এবং ইমাম আবু ইয়ালা ও ইমাম তাবরানীর বর্ণনা মতে হযরত উম্মে হানী বিনতে আবু তালেবের ঘর থেকে হয়েছে। উভয় বর্ণনার মধ্যে সমাধান হলাে, তিনি প্রথমে উম্মে হানীর ঘরে শুয়ে ছিলেন অতঃপর সেখান থেকে উঠে হাতীমে কাবায় চলে যান এবং সেখান থেকেই মি’রাজ আরম্ভ হয়। কোন কোন রিওয়ায়েতে আছে নিজের ঘর থেকে মি’রাজ হয়েছে। এ উত্তর হল উম্মে হানী হল তাঁর চাচাত বােন সুতরাং নিসবতের কারণে উম্মে হানীর ঘরকে নিজের ঘর বলেছেন। মিরাজের ব্যাপারে তিনটি প্রসিদ্ধ মত পরিলক্ষিত হয়। ১. মিরাজ ছিল রূহানী এবং তা স্বপ্নে হয়েছিল। ২. মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত জাগ্রত অবস্থায় আর বাইতুল মােকাদ্দাস থেকে আসমান পর্যন্ত রূহানী মিরাজ ছিল। ৩. অধিকাংশ ওলামাদের মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সর্বস্থরের মিরাজ জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে হয়েছিল। অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, মুহাদ্দিসীন, ফুকাহা, মুতাকাল্লিমীন ও মুফাসসিরীণগনের মত এটিই। (মাদারিজুন নবুয়্যত)

 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  এর মিরাজ হয়েছিল ৩৪বার। তম্মধ্যে একবার সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় আর বাকীগুলাে স্বপ্নে রূহানীভাবে হয়েছিল। (মাদারিজুন নবুয়্যত)

 

রূহুল বয়ান গ্রন্থে উল্লেখ আছে-

 

قال الشيخ الاكبر قدس سره أن معراجه عليه السلام اربع وثلاثون مرّة واحدة بجسده والباقی بروحه

 

শেখে আকবর কুদ্দিসা সিররূহু বলেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মি’রাজ হয়েছিল ৩৪বার তম্মধ্যে একবার হয়েছিল সশরীরে বাকীগুলাে রূহানীভাবে।(সীরাতে হালভীয়্যা)

 

সশরীরে মিরাজের দলীল

১. মি’রাজের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা عبده বলেছেন, ‘আবদুন’ শব্দটি শরীর ও রূহ উভয়ের সমষ্টিকে বুঝায়। ২. আয়াতে اسرى  বলা হয়েছে। আর اسرى  বলা হয় রাতের  ভ্ৰমণকে। তাও রূহের জন্য ব্যবহার হয়না। ৩. হাদিস শরীফে বুরাক নামক বাহনের কথা বলা হয়েছে। বাহন প্রয়ােজন হয় শরীরের জন্য, রূহের জন্য নয়। ৪. রূহানী মি’রাজ হলে এটি এক বিরাট মুজিযা হতােনা। কারণ রূহানী মি’রাজ বহুবার হয়েছে এবং এটা অসম্ভব কিছু নয়। ৫. রূহানী মি’রাজ হলে কাফিররা অবিশ্বাস করতােনা এবং একদল দুর্বল মুমিন মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী হতােনা। শারিরীক মি’রাজের কথা শুনে তারা এটাকে অসম্ভব মনে করে পথভ্রষ্ট হয়েছিল। পক্ষান্তরে আবু বকর (রা.) তা অকপটে বিশ্বাস করার কারণে সিদ্দীক উপাধিতে ভূষিত হন। ৬. আল্লাহ তায়ালা সূরা নাজমের ১৭নং আয়াতে এ সম্পর্কে বলেন – ما زاغ البصر وما طغى  তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি এবং সীমালঙ্ঘন করেনি। উক্ত আয়াতে البصر  শব্দটি দ্বারা বাহ্যিক চোখের কথা বলা হয়েছে, অন্তরের চোখের কথা নয়। (আহকামুল কুরআন) ৭.বাইতুল মােকাদ্দাসে সকল নবীগণের ইমামতি করা শারিরীক মি’রাজের প্রমাণ বহন করে।

 

পবিত্র কুরআনে মি’রাজকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত সীমারেখা নির্ধারণের কারণ

 

পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মসজিদে আকসা পর্যন্ত মিরাজ হয়েছে। এর দ্বারা আসমান ও লা মকান পর্যন্ত মিরাজ অস্বীকার করা যাবেনা। কারণ এগুলাে এমন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যেগুলাের বর্ণনাকারী ৩১জন সাহাবী। ইমাম সুয়ূতী (র.) খাসায়েসুল কোবরা গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ২৫২ পৃষ্ঠায় এদের নামসহ উল্লেখ করেছেন। আর পবিত্র কুরআনে শুধু মসজিদে আকসার কথা উল্লেখ করার কারণ হলাে মক্কার কাফিররা মসজিদে আকসা দেখেছিল এবং এর সম্পর্কে তাদের অনেকের জ্ঞান ছিল। এ কারণেই মি’রাজের ঘটনা শুনার পর তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট এর কিছু নিদর্শন বর্ণনার দাবী করতে বাধ্য হয়েছিল। যদি এত অল্প সময়ে এক মাসের দূরত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম হয় তাহলে আসমানে ভ্রমণ করাও সম্ভব।

 

মি’রাজের ঘটনার বর্ণনা বিভিন্ন হওয়ার কারণ

 

মি’রাজের ঘটনা একত্রিশ জন সাহাবী থেকে হাদিসের বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। কোন বর্ণনায় পরিপূর্ণভাবে মি’রাজের ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি। বুখারীর কোন বর্ণনায় মসজিদে আকসা যাওয়ার কথা উল্লেখ নেই বরং এর উল্লেখ করেছেন ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ (র.)। কোন বর্ণনায় বক্ষ বিদীর্ণের ঘটনার উল্লেখ নেই। এবং কোন কোন বর্ণনায় বুরাকে আরােহণের কথা উল্লেখ নেই। এভাবে হযরত মুসা (আ.)কে কবরে দেখার কথা উল্লেখ করেননি বরং এটি বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম,  নাসাঈ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ। সিহাহ সিত্তাহর বর্ণনায় বরযখের ঘটনা দেখার উল্লেখ নেই বরং এগুলাে ইমাম বায়হাকী, ইবনে জারীর, হাকিম, ইবনে কাসীর, আল্লামা হালভীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেছেন। বর্ণনার মতভেদের কারণ হলাে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহুবার বহু সাহাবায়ে কিরামের সামনে মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা দিয়েছেন। প্রত্যেকের যােগ্যতা অনুসারে তিনি তা বর্ণনা করেছেন। ফলে রেওয়ায়েতে মতবিরােধ ও  ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে।

মি’রাজের ধারাবাহিক ঘটনা

বুখারী শরীফে মালিক ইবনে সা’সা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহর নবী মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন- একদিন আমি কাবা ঘরের হাতিমের অংশে কিংবা হাজরে আসওয়াদের পাশে শুয়েছিলাম। হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার নিকট এলেন এবং আমার হলকুমের নিম্নদেশ থেকে নাভী পর্যন্ত বিদীণ করলেন। তারপর আগন্তুক আমার হৃদপিণ্ড বের করলেন। তারপর আমার নিকট একটি স্বর্ণের পাত্র আনা হল যা ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল। তারপর আমার হৃদপিণ্ডটি (যমযমের পানি দ্বারা) ধৌত করা হলাে এবং ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ করে যথাস্থানে পুনরায় রেখে দেয়া হলাে। তারপর সাদা রঙের একটি বাহন আমার নিকট আনা হলাে যা আকারে খচ্চর থেকেও ছােট ও গাধা থেকে বড় ছিল। জারুদ বললেন- হে আবু হামযা! এটিই কি বুরাক? হযরত আনাস (রা.) বললেন, হ্যাঁ। সেটি একেক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ প্রান্তে। আমাকে তার উপর সওয়ার করানাে হলাে। তারপর আমাকে নিয়ে জিব্রাইল (আ.) চললেন। প্রথম আসমানে নিয়ে দরজা খুলতে বললেন, জিজ্ঞাসা করা হলাে কে? তিনি বললেন, জিব্রাইল, আবার জিজ্ঞাসা করা হলাে, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আবার জিজ্ঞাসা করা হলাে, তাকে কি আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যা। তখন বলা হলাে তাঁর জন্য খােশ আমদেদ, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর আসমানের দরজা খুলে দেয়া হলাে। আমি সেখানে পৌছে আদম (আ.)’র সাক্ষাত পেলাম। জিব্রাইল (আ.) বললেন, ইনি আপনার আদি পিতা আদম (আ.), তাকে সালাম করুন। আমি তাকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, নেককার পুত্র ও নেককার নবীর প্রতি খােশ আমদেদ। তারপর দ্বিতীয় আসমানে পৌছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হলাে কে? তিনি বললেন, জিব্রাইল। জিজ্ঞাসা করা হলাে আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হলাে তাকে কি আমন্ত্রণ করা হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তারপর বলা হলাে তার জন্য খােশ আমদেদ, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর দরজা খুলে দেওয়া হলাে। যখন তথায় পৌছলাম, তখন সেখানে ইয়াহিয়া ও ঈসা (আ)র সাক্ষাত পেলাম। তারা দু’জন ছিলেন পরস্পরের খালাত ভাই। জিব্রাইল (আ.) বললেন, এরা হলেন ইয়াহিয়া ও ঈসা (আ.)। তাঁদেরকে সালাম করুন। তখন আমি তাঁদের সালাম করলাম। তাঁরা উত্তর দিলেন। তারপর বললেন, নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি খােশ আমদেদ। এরপর তিনি আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানে গেলেন। সেখানে পৌছে জিব্রাইল (আ.) বললেন, দরজা খুলে দাও। তাকে বলা হলাে কে? তিনি বললেন, জিব্রাইল। জিজ্ঞাসা করা হলাে আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হলাে তাঁকে কি আমন্ত্রণ করা হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তারপর বলা হলাে তাঁর জন্য খােশ আমদেদ, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর দরজা খুলে দেওয়া হলাে। আমি সেখানে পৌঁছে ইউসূফ (আ.)কে, দেখতে পেলাম। জিব্রাইল (আ.) বললেন, ইনি ইউসূফ (আ.) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনিও জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার ভাই, নেক্কার নবীর প্রতি খােশ-আমদেদ। তারপর আমাকে নিয়ে চতুর্থ আসমানে পৌঁছলেন আর দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হলাে কে? তিনি বললেন, জিব্রাইল। জিজ্ঞাসা করা হলাে আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি। জিজ্ঞাসা করা হল তাঁকে কি আমন্ত্রণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন বলা হলাে তাঁর প্রতি খােশ আমদেদ, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। দরজা খুলে দেয়া হলাে। আমি ইদ্রিস (আ.)এর কাছে পৌঁছলে জিব্রাইল (আ.) বললেন, ইনি ইদ্রিস (আ.) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনিও জবাব দিলেন। তারপর বললেন, নেককার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খােশ আমদেদ। এরপর জিব্রাইল (আ.) আমাকে নিয়ে পঞ্চম আসমানে পৌঁছে। দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হলাে, আপনি কে? তিনি বললেন, জিব্রাইল। জিজ্ঞাসা করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল তাঁকে কি আমন্ত্রণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন বলা হলাে তাঁর প্রতি খােশ আমদেদ, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তথায় পৌছে হারুন (আ.) কে পেলাম।

 

জিব্রাইল (আ.) বললেন, ইনি হারুন (আ.) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম, তিনিও জবাব দিলেন এবং বললেন নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খােশ আমদেদ। তারপর আমাকে নিয়ে ষষ্ঠ আসমানে পৌছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হলাে, আপনি কে? তিনি বললেন, জিব্রাইল। জিজ্ঞাসা করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করা হল তাঁকে কি আমন্ত্রণ করা হয়েছে? বললেন, হ্যাঁ। ফেরেশতারা বললেন, তাঁর প্রতি খােশ আমদেদ। উত্তম আগম্ভক এসেছেন। সেখানে আমি মূসা (আ.) কে পেলাম। জিব্রাইল (আ.) বললেন ইনি মূসা (আ.), তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম, তিনিও জবাব দিলেন এবং  বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ আমদেদ। আমি যখন অগ্রসর হলাম তখন তিনি কেঁদে ফেললেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলাে আপনি কেন কাঁদছেন? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি যে, আমার পর একজন যুবককে নবী বানিয়ে পাঠানাে হয়েছে। যাঁর উম্মত আমার উম্মত থেকে অধিক সংখ্যায় জান্নাতে যাবে। তারপর জিব্রাইল (আ.) আমাকে নিয়ে সপ্তম আসমানে পৌছেন এবং দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞাসা করা হলাে, আপনি কে? তিনি বললেন, জিব্রাইল। জিজ্ঞাসা করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল তাঁকে কি আমন্ত্রণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বলা হলাে তাঁর প্রতি খােশ আমদেদ। উত্তম আগন্তুকের আগমন হয়েছে। সেখানে ইব্রাহিম (আ.)কে দেখতে পেলাম। জিব্রাইল (আ.) বললেন, ইনি আপনার পিতা তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন নেক্কার পুত্র ও নেক্কার নবীর প্রতি খােশ আমদেদ। তারপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উঠানাে হলাে। দেখতে পেলাম উহার ফল হাজর এলাকার মােটকার ন্যায় এবং পাতাগুলাে হাতির কানের মত। আমাকে বলা হলাে এ হলাে সিদরাতুর মুনতাহা (যা জড় জগতের শেষ প্রান্ত) সেখানে আমি চারটি নহর দেখতে পেলাম যাদের দু’টি ছিল অপ্রকাশ্য আর দু’টি ছিল প্রকাশ্য। আমি জিব্রাইল (আ.)কে জিজ্ঞাসা করলাম। এ নহরগুলাে কী? উত্তরে বললেন, অপ্রকাশ্য দু’টি হলাে জান্নাতের দু’টি নহর আর প্রকাশ্য দু’টি হলাে নীল নদী ও ফুরাত নদী। তারপর আমার সামনে বায়তুল মামুর প্রকাশ করা হলাে। এরপর একটি শরাবের পাত্র, একটি দুধের পাত্র ও একটি মধুর পাত্র পরিবেশন করা হলাে। আমি দুধের পাত্র গ্রহণ করলাম। তখন জিব্রাইল (আ.) বললেন, এটি হল ফিতরাত তথা দ্বীন-ই-ইসলাম। আপনি ও আপনার উম্মতগণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত। তারপর আমার উপর দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হলাে। আমি ফিরে আসার সময় মুসা (আ.)এর পাশ দিয়ে আসার প্রাক্কালে তিনি বললেন- আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কি আদেশ করেছেন? আমি বললাম, আমাকে দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের আদেশ করা হয়েছে। মূসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায়ে সক্ষম হবে না। আল্লাহর কসম, আমি আপনার আগের লােকদের পরীক্ষা করেছি এবং বনী ইসরাইলের হেদায়তের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি। তাই আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের বােঝা হালকা করার জন্য আবেদন করুন। আমি ফিরে গেলাম। ফলে দশ ওয়াক্ত সালাত হ্রাস করে দিলেন। আমি আবার মূসা (আ.)’র নিকট ফিরে এলাম। তিনি আবার আগের মত বললেন, আমি পুনরায় ফিরে গেলাম। ফলে আল্লাহ দশ ওয়াক্ত সালাত কমিয়ে দিলেন। ফিরার পথে মূসা (আ.)এর নিকট পৌছলে তিনি আবার পূর্বোক্ত কথা বললেন, আমি আবার ফিরে গেলাম। আল্লাহ তায়ালা আরাে দশওয়াক্ত সালাত হ্রাস করলেন। আমি মুসা (আ.)এর নিকট ফিরে এলাম। তিনি আবার ঐ কথা বললেন, আমি আবার ফিরে গেলাম। তখন আমাকে দেনিক দশওয়াক্ত সালাতের আদেশ দেওয়া হল। আমি তা নিয়ে ফিরে এলাম। এবারও মূসা (আ.) আগের মত বললেন, আমি আবার ফিরে গেলাম তখন আমাকে পাঁচওয়াক্ত সালাতের আদেশ দেওয়া হল। তারপর মূসা (আ.)এর নিকট ফিরে এলাম। তিনি বললেন আমাকে কি আদেশ করা হয়েছে? আমি বললাম আমাকে দৈনিক পাঁচওয়াক্ত সালাত আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে। মূসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে সক্ষম হবে না। আপনার পূর্বে আমি লােকদের পরীক্ষা করেছি। বনী ইসরাইলের হেদায়তের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। আপনি আপনার প্রভুর নিকট ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য আরাে সহজ করার আবেদন করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি আমার প্রভু নিকট অনেক বার আবেদন করেছি, এতে আমি লজ্জাবােধ করছি। আর আমি এতেই সন্তুষ্ট হয়েছি এবং তা মেনে নিয়েছি। এরপর তিনি বললেন, আমি যখন মূসা (আ.)’কে অতিক্রম করে অগ্রসর হলাম, তখন জনৈক ঘােষণাকারী ঘােষণা দিলেন, আমি আমার অবশ্য পালনীয় আদেশটি জারি করে দিলাম এবং আমার বান্দাদের উপর লঘু করে দিলাম। (সহীহ বুখারী)

 

উপরােক্ত হাদিস শরীফে আসমানের ফেরেশতা কর্তৃক হযরত জিব্রাইল (আ.)ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পরিচয় জিজ্ঞাসা করা অপরিচিতের কারণে নয় বরং তাযীম ও সম্মানার্থে ছিল।

 

বাইতুল্লাহ থেকে বাইতুল মােকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ কাহিনী

 

রাসূল বােরাক’ নামক জান্নাতী বাহনে আরােহন করে মসজিদে আকসার দিকে রওয়ানা হন। অধিক খেজুর বৃক্ষ সম্বলিত ভূমিতে পৌঁছলে জিব্রাইল (আ.) বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! সওয়ারী থেকে নেমে এখানে নামায পড়ুন। তিনি সেখানে নামায পড়লেন আর জিব্রাইল (আ.) বললেন- আপনি ইয়াসরবে (মদীনায়) নামায পড়েছেন। একদিন এই স্থান আপনার আবাস স্থল হবে। তারপর তাঁর সওয়ারী এক শুভ্র স্থানে পৌঁছলে জিব্রাইল (আ.) বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! সওয়ারী থেকে নেমে এখানে নামায পড়ুন। তিনি সেখানে নামায পড়লেন আর জিব্রাইল (আ.) বললেন- আপনি ইয়াসরবে (মদীনায়) নামায পড়েছেন। একদিন এই স্থান আপনার আবাস স্থল হবে। তারপর তাঁর সওয়ারী এক শুভ্র স্থানে পৌছলে জিব্রাইল (আ.) বললেন, হুযুর! এখানেও নামায পড়ুন। তিনি নামায পড়লেন। জিব্রাইল (আ.) বললেন, আপনি মাদয়নে নামায পড়েছেন। সেখান থেকে বায়তুল লাহম পৌঁছলে সেখানেও জিব্রাইল (আ.)’র কথা মতাে সওয়ারী থেকে অবতরণ করে নামায পড়লেন। জিব্রাইল (আ.) বললেন, এখানে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সওয়ারী চলন্ত অবস্থায় এক বৃদ্ধা দৃষ্টিগােচর হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাইল (আ.)কে জিজ্ঞাসা করলেন এ কে? জিব্রাইল (আ.) বললেন- আপনি চলুন। তিনি চলতে লাগলেন। পথে এক বৃদ্ধ, দেখলেন সে আহবান করতে লাগল, হে আল্লাহর রাসূল! এদিকে তাশরীফ আনুন। কিন্তু জিব্রাইল (আ.) বললেন- আপনি চলুন। অতঃপর তিনি এমন দলের পাশ দিয়ে গমন করছিলেন যারা তাঁকে السلامও السلام عليك يا اخر السلام عليك يا اول عليك يا حاشر  বলে সালাম দিচ্ছিলেন। জিব্রাইল (আ.) বললেন, আপনি এদের সালামের জাওয়াব দিন। তিনি তাদের সালামের জবাব দিলেন। এরপর জিব্রাইল (আ.) বললেন- পথে আপনি যে বৃদ্ধাকে দেখেছেন তা হলাে দুনিয়া। এখন দুনিয়ার বয়স মাত্র এতটুকু বাকী আছে যতটুকু ঐ বৃদ্ধার বয়স বাকী আছে। যদি আপনি তার আহবানে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত দুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দিতাে। আর যে শব্দ করে আপনাকে আহবান করছিল সে ছিল ইবলিস শয়তান। যদি আপনি তার ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেতাে। আর যে দল আপনাকে সালাম করেছিলেন তারা হলেন- হযরত ইব্রাহিম, মূসা, ও ঈসা (আ.)। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে- তাঁর যাত্রা হযরত মূসা (আ.)এর পাশ দিয়ে হয়েছিল। وهوقائم يصلى فى قبره এ সময় তিনি স্বীয় কবরে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিলেন। মাদারেজুন নবুয়ত গ্রন্থে বর্ণিত আছে হযরত মূসা (আ.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখে বলেছিলেন اشهد انك رسول الله ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল’।

মুজাহিদগণের সাক্ষাত

 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পথে এমন এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন- যারা যেদিন ফসলের বৃক্ষ রােপন করতেন সেদিনই ফসল কাটতেন এবং সাথে সাথে বৃক্ষ পুনরায় ফসলে পূর্ণ হয়ে যেতাে। তিনি জিব্রাইল (আ.)কে জিজ্ঞাসা করেন- এরা কারা? তিনি উত্তরে বললেন- এরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী। তাদের নেকী সাতশগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেন। তারা যা কিছু ব্যয় করে আল্লাহ তায়ালা উত্তম প্রতিদান দান করেন এবং উত্তম রিযিক প্রদান করেন।

 

বে-নামাযীদের সাক্ষাত

 

অতঃপর তিনি এমন একদলের পাশ দিয়ে গমন করেছিলেন যাদের মাথা পাথরের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছে এবং পুনরায় মাথা পূর্বাবস্থায় হয়ে যায় আর বিরামহীনভাবে এ আযাব চলছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- হে জিব্রাইল! এরা কারা? তিনি বললেন- এরা ঐসব লােক যারা ফরয নামায আদায় করতাে না।

 

যাকাত অনাদায়কারীর সাক্ষাত

 

অতঃপর তাঁর গমন এমন একদলের পাশ দিয়ে হয়েছিল যাদের লজ্জাস্হানের সম্মুখ ও পিছনের দিকে চেড়া কাপড় দিয়ে ঢাকা এবং চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় চরছে আর কাঁটা, যক্কুম ও জাহান্নামের পাথর খাচ্ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? জিব্রাইল (আ) বললেন – এরা ঐসব লোক যারা স্বীয় সম্পদের যাকাত আদায় করতনা। আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর যুলুম করেননি এবং  আপনার প্রতিপালক স্বীয় বান্দার উপর যুলুমকারী নন।

 

ব্যভিচারীদের দেখা

 

অতঃপর তাঁর গমন এমন একদলের পাশ  দিয়ে হয়েছিল যাদের সম্মুখে একটি ডেকসিতে রান্না করা উন্নত মানের গােশত রয়েছে এবং অপর একটি ডেকসীতে কাঁচা দুর্গন্ধবযুক্ত গােশত বিদ্যমান। কিন্তু তারা দুর্গন্ধযুক্ত গােশত খাচ্ছে আর রান্না করা গােশত খাচ্ছেনা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- এরা কারা? জিব্রাইল (আ.) উত্তর দিলেন- এরা আপনার উম্মতের ঐসব লােক যাদের নিকট পুত-পবিত্র স্ত্রীগণ থাকা সত্ত্বেও নষ্টা মহিলাদের নিকট যেতাে এবং তাদের নিকট সকাল পর্যন্ত রাত্রিযাপন করতাে। এভাবে এরা ঐসব মহিলা যারা স্বীয় হালাল ও পবিত্র স্বামীদের নিকট থেকে উঠে অবৈধ পরুষদের নিকট গমন করতাে সকাল পর্যন্ত সারা রাত তাদের সাথে থাকতাে।

 

লােভীর দর্শন

অতঃপর তাঁর গমন এমন এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে হয়েছিল যে লাকড়ির এক বিরাট বােঝা একত্রিত করে রাখল যা সে উঠাতে অক্ষম। কিন্তু তবুও সে লাকড়ি খুঁজে এনে বােঝা বড় করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- এ কে? উত্তরে জিব্রাইল (আ.) বললেন- এ আপনার উম্মতের এক ব্যক্তি যার দায়িত্বে অনেক লােকের হক ও আমানত রক্ষিত ছিল যা আদায়ে সে সক্ষম ছিলনা। অথচ তবুও সে আরাে হক ও আমানত গ্রহণ করে বােঝা ভারী করেছে।

আমলবিহীন অসৎ বক্তার দর্শন

অতঃপর এমন এক দলের পাশ দিয়ে তাঁর গমন হয়েছিল যাদের ঠোঁট লােহার কাঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছে। যখন একবার কাটে সাথে সাথে তা পুনরায় পূর্বের ন্যায় হয়ে যায় আর এভাবে চলতে রয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- এরা কারা? উত্তরে জিব্রাইল (আ.) বললেন- এরা মানুষকে পথভ্রষ্টকারী বক্তা; যারা নিজেদের বক্তব্য অনুযায়ী নিজেরা আমল করে না।

অশ্লীল ভাষীর দর্শন

অতঃপর একটি পাথরের পাশ দিয়ে তাঁর গমন হয়েছিল যে পাথর থেকে একটি বড় বলদ গরু বের হয় এবং পুনরায় সেই পাথরের ভিতর প্রবেশ করতে চায় কিন্তু প্রবেশ করতে পারেনা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এটা কি? উত্তরে জিব্রাইল (আ.) বললেন- এটি ঐ ব্যক্তির অবস্থা যে মুখ থেকে কোন মন্দ কথা উচ্চারণ করলাে তারপর এজন্য লজ্জিত হলাে এবং ঐ মন্দ কথাকে পুনরায় মুখের ভিতর ফিরিয়ে নিতে চায় কিন্তু সে তা ফিরিয়ে নিতে অক্ষম।

জান্নাতের আওয়াজ শ্রবণ

অতঃপর তিনি এক উপত্যকা দিয়ে গমন করছিলেন। সেখানে ঠাণ্ডা পবিত্র স্বর্গীয় বাতাস এবং মেশকের সুগন্ধি আসছিল। আর একটি আওয়ায শুনলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এটা কি? উত্তরে জিব্রাইল (আ.) বললেন- এটি জান্নাতের আওয়ায। জান্নাত বলতেছে যে, হে আল্লাহ! আপনি আমার সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন তা আপনি আমাকে দেন। কেননা আমার যাবতীয় নিয়ামত যা জান্নাতীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে তা অনেক বেশী হয়ে গিয়েছে। এখন আমার অধিবাসীদেরকে আমাকে দিয়ে দিন যাতে তারা ঐসব নিয়ামত ভােগ করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বললেন- তােমাকে দেওয়া হবে প্রত্যেক মুসলমান মুমিন নর-নারীকে যারা আমার উপর এবং আমার রাসূলগণের উপর ঈমান এনেছে আর যারা আমার সাথে কাউকে শরীক করেনি। যারা আমাকে ছাড়া আর কাউকে খােদা মানেনি এবং আমাকে ভয় করতাে। তারা নিরাপদে থাকবে আর যা আমার কাছে চাইবে তা আমি তাদেরকে দেবাে। আর যারা আমাকে কর্জ দেবে আমি তার বিনিময় দেবাে এবং যারা আমার উপর ভরসা করবে আমি তাদেরকে যথেষ্ট করে দেবাে। আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। আমি ওয়াদা খেলাফী করি না। নিশ্চয় মু’মিন সফল হবে। আর আল্লাহ তায়ালা হলেন সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টিকর্তা ও বরকতমণ্ডিত। জান্নাত একথা শুনে বলেছে- আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।

দোযখের আওয়াজ শ্রবণ

অতঃপর তাঁর গমন এমন এক উপত্যকা দিয়ে হলাে, যেখান থেকে এক ভয়ানক আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং দুর্গন্ধ অনুভব করলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এটি কি? উত্তরে জিব্রাইল (আ.) বললেন- এটি জাহান্নামের আওয়ায। জাহান্নাম বলছে- হে আল্লাহ! আমার সমস্ত আযাব ও আযাবের উপকরণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমার গভীরতা অনেক দীর্ঘ হয়েছে আর আমার উষ্ণতাও বেড়ে গিয়েছে। সুতরাং আমাকে যা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা আমাকে দেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন- প্রত্যেক মুশরিক ও কাফির নারী-পুরুষ এবং অহংকারী যারা কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করতাে তাদেরকে তােমাকে দেওয়া হবে। দোযখ বলেছে, আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।

ইহুদী-নাসারা এবং দুনিয়ার আহবান

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- এক আহবানকারী আমাকে ডানদিক থেকে আহবান করে বলল, আপনি আমার দিকে দেখুন। আমি আপনার কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করবাে। আমি তার আহবানে সাড়া দেইনি। তারপর অপর একজন আহবানকারী বাম দিক থেকে অনুরূপভাবে আহবান করলাে। আমি তার আহবানেও সাড়া দেইনি। তারপর তিনি একজন মহিলা দেখলেন যার বাহুদ্বয় বিবস্ত্র ছিল এবং সে সম্পূর্ণ সুসজ্জিত ছিল। সেও বলল, হে মুহাম্মদ! আমার দিকে দৃষ্টিপাত করুন। আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবো। তিনি তার প্রতিও ভ্রক্ষেপ করেননি। জিব্রাইল (আ.) বললেন- প্রথম জন ছিল ইহুদীদের আহবানকারী। যদি আপনি তার ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত ইহুদী হয়ে যেতাে আর দ্বিতীয়জন ছিল নাসারাদের আহবানকারী যদি আপনি তার ডাকে সাড়া দিতেন তবে আপনার উম্মত নাসারা হয়ে যেতাে এবং তৃতীয় মহিলা ছিল দুনিয়া। তার ডাকে সাড়া দিলে আপনার উম্মত দুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দিতাে।

সুদি ব্যক্তিদের দর্শন

অতঃপর তাঁর গমন এমন এক দলের পাশ দিয়ে হলো, যাদের পেট এতই বড় যে, যখনই দাঁড়াতাে সাথে সাথে পড়ে যেতাে। জিব্রাইল (আ.) বললেন- এরা সুদখাের।

ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণকারীর দর্শন

অতঃপর তাঁর গমন এমন এক দলের পাশ দিয়ে হলাে- যাদের ঠোঁটগুলাে উটের ঠেটের ন্যায় বৃহদাকারের। আগুনের স্ফুলিঙ্গ তারা গলদ করণ করছে আর তা মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। জিব্রাইল (আ.) বললেন- এরা ঐ সব লােক যারা ইয়াতীমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতাে।

ব্যভিচারিণীর দর্শন

অতঃপর তাঁর গমন এমন এক দলের পাশ দিয়ে হলাে যাদেরকে তাদের বক্ষদেশের ব্রেস্টের সাথে বাধা অবস্থায় ঝুলন্ত রাখা হয়েছিল। এরা হলাে ব্যভিচারিনী নারী।

চোগলখােরের দর্শন

অতঃপর তাঁর গমন এমন একদলের পাশ দিয়ে হলাে যাদের পাশ থেকে গােশত কাটা হচ্ছে। এরা হলাে চোগলখাের।

বাইতুল মােকাদ্দাসে পৌঁছা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বাইতুল মােকাদ্দাসে পৌছে আম্বিয়ায়ে কিরামগণ যেখানে তাঁদের সাওয়ারী বাঁধতেন সেখানে বােরাক বাঁধলেন। তারপর তিনি মসজিদে আকসায় তাশরীফ নিলেন। সেখানে তাঁকে স্বাগতম জানানাের জন্য সকল আম্বিয়ায়ে কিরাম উপস্থিত ছিলেন। সকলেই তাঁকে দেখে প্রশংসা করলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরূদ পাঠ করলেন  এবং সকলেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিলেন। তারপর আযান ও ইকামত দেওয়া হলো এবং আম্বিয়ায়ে কিরামগণ কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন আর ইমাম কে হবেন সেই অপেক্ষায় রইলেন। বড় বড় আম্বিয়াগণ ইমামতির আশা করেছিলেন। কিন্তু জিব্রাইল (আ.) ইমামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ মােস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাত ধরে সকলের ইমাম বানিয়ে দিলেন। তিনি সকল আম্বিয়ায়ে কিরামের ইমামতি করলেন। কেউ কেউ এই নামায ও ইমামতি মিরাজ থেকে আসার সময় পথের ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন।

আম্বিয়ায়ে কিরামগণ কর্তৃক আল্লাহর প্রশংসা

এসময় হযরত ইব্রাহিম, হযরত মূসা, হযরত দাউদ, হযরত সােলায়মান, হযরত ঈসা (আ.) এবং সর্বোপরি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রশংসা করেন ও নিজের উপর আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতের বর্ণনা দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন –

الحمد لله الذي أرسلني رحمة للعالمين، وكافة للناس بشيرا ونذيرا، وأنزل على الفرقان فيه تبيان كل شيء للناس، وجعل أمتي أمة وسطا،
وجعل أمتي هم الأولون وهم الأخرون، وشرح لي صدري، ووضع عني وزري، ورفع لي ذكري وجعلني فاتحا وخاتما –

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি আমাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং সকলের জন্য সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী বানিয়েছেন। আর আমার উপর ফোরকান নাযিল করেছেন যার মধ্যে সব কিছুর বর্ণনা রয়েছে। আমার উম্মতকে সর্বোত্তম উত্তম বানিয়েছেন যাদেরকে মানুষের হেদায়তের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাদেরকে মধ্যমপন্থী বানিয়েছেন। আর যিনি আমার বক্ষ খুলে দিয়েছেন আমার থেকে বােঝা হালক  রে দিয়েছেন, আমার স্মরণকে সুউচ্চ করে দিয়েছেন এবং আমাকে দিয়ে নবুয়তের ধারাবাহিকতা আরম্ভ করেছেন আর আমাকে দিয়েই তা সমাপ্তি করেছেন।

বায়তুল মােকাদ্দাস থেকে সপ্ত আসমানে ভ্রমণ

এ সম্পর্কে বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদিসে বিস্তারিত ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে, যাতে বিভিন্ন আসমানে বিভিন্ন নবীগণের সাথে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। আর এসব সাক্ষাত ছিল দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে অর্থাৎ সশরীরে। এব্যাপারে জালালাইন শরীফের প্রান্তটীকায় বর্ণিত আছে যে-

لقى ادم اي بروحه وجسده معا كبقية الانبياء الاتی ذكرهم في السموات السبع فاجتمع النبي صلی الله عليه وسلم بهم باجسادهم وارواحهم بعد أن اجتمع بهم كذالك في جملة الانبياء في بيت المقدس-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  হযরত আদম (আ.)এর সাক্ষাত করেছিলেন তাঁর আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে যেভাবে সপ্ত আসমান পর্যন্ত অন্যান্য নবীগণের সাথে সশরীরে সাক্ষাত করেছেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সশরীরে রূহ ও দেহের সমন্বয়ে তাঁদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন বাইতুল মােকাদ্দাসে যেভাবে সশরীরে সাক্ষাত করেছিলেন। (তাফসীরে জালালাইনের প্রান্ত টীকা)

আসমানসমূহে বিভিন্ন নবীগণের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কারণ অপরিচিত হওয়ার কারণে নয় বরং তাঁর সম্মান বৃদ্ধির কারণে পরিচয় করে দেওয়া হয়েছিল। যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের পূর্বে তিনি জিব্রাঈলের সাথে মিকাঈল (আ)’র পরিচয় করে দিয়েছিলেন। এরূপ ঘটনা অসংখ্য। রাসূল একেক আসমানে অসংখ্য ফেঁরেশতাকে কিয়াম, রুকু, সিজদা ও কুয়ুদ অবস্থায় আল্লাহর যিকরে রত দেখেছেন এবং জানতে পেরেছেন তাদের সৃষ্টি থেকেই তারা এভাবে আল্লাহর যিকর ইবাদতে মশগুল রয়েছেন। জিব্রাইল (আ.)এর অনুরোধে তিনি এসব ইবাদতের সওয়াব লাভের অনুরূপ ইবাদত উম্মতের জন্য আল্লাহর নিকট আবেদন করলে আল্লাহ তা মনজুর করলেন এবং নামাযের মধ্যে এসব কাজ ফরয করে দেন।

সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছা

আল্লামা নিযামউদ্দীন নিশাপুরী (র.) সিদরাতুল মুনতাহার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন-
فالمنتهي حينئذ موضع لا يتعده ملك وا يعلم ما وراءه أحد واليه انتهي ارواح الشهداء
এটি এমন স্থান যার অতিক্রম ফেরেশতারা করতে পারেন না এবং এর পরে কি আছে। তাও কারাে জানা নেই। শােহদাগণের রূহ এ পর্যন্ত আসতে সক্ষম। (মিশকাত শরীফ)

মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে-
إليها ينتهى ما يعرج به من الارض م فيقبض منها، وإليها ينتهى ما يهبط به من فوقها فيقبض منها
অর্থাৎ পৃথিবী থেকে যে সব আমল উপরে যায় তা সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌছতে পারে অতঃপর সেখান থেকে বিশেষভাবে গ্রহণ করা হয় আর উপর থেকে যেসব আহকাম অবতীর্ণ হয় তাও এখান পর্যন্ত আসে অতঃপর সেখান থেকে তা গ্রহণ করা হয়। (মিশকাত শরীফ)

তিনি আরাে বলেন- ان جبرائيل تخلف عنه في مقام ولو دنوت انملة لا حترقت  একস্থানে পৌঁছে জিব্রাইল (আ.) পিছনে পড়ে গেলেন এবং (বললেন) যদি আমি এক আঙ্গুল পরিমাণও অগ্রসর হই তাহলে আমি পুরে যাবাে। (শরহে শেফা)

আল্লামা আব্দুল ওহাব শা’রানী (র.) মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী (র.) থেকে বর্ণনা করেন, অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সিদরাতুল মুনতাহার দিকে উর্দ্দ্ধগমন করানো হয়েছে। এটি একটি বৃক্ষ। এটির ফল মােটকার ন্যায় বৃহদাকারের এবং এটির হাতির কানের ন্যায়। তিনি তা দেখেছেন এবং আল্লাহর নূর দ্বারা তা আবৃত ছিল । এর পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বর্ণনা দিতে কেউই সক্ষম নন। নূরের প্রচণ্ড তজল্লীর কারণে চোখ পূর্ণাঙ্গভাবে আয়ত্ব করতে পারে না। তিনি দেখলেন যে, সিদরাতুল মুনতাহার শিকড় থেকে চারটি নদী প্রবাহিত হলাে। দু’টি নদী প্রকাশ্য ছিল বাকী দু’টি ছিল বাতেনী। জিব্রাইল (আ.) বলেছেন, প্রকাশ্য নদী দু’টি হলো নীল নদ এবং ফুরাত নদী আর অপ্রকাশ্য দু’টি জান্নাতের দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল। নীল ও ফুরাত নদীদ্বয়ও কিয়ামতের দিন জান্নাতে চলে যাবে এবং এ দু’টি জান্নাতে মধু ও দুধের নদী হবে। ইবনে আরবী (র.) আরো বলেন-এ নদীদ্বয় থেকে পানকারীগণের বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান অর্জিত হবে। বনী আদমের আমলসমূহ সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছে স্তব্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ সম্মুখে অগ্রসর হতে পারে না। এটি আত্মাসমূহের অবস্থান স্থল। যা কিছু নীচে অবতরণ করে এটি সেগুলাের প্রান্ত সীমা এবং উপর থেকে কোন কিছু এর নীচে আসতে অক্ষম। আর যা কিছু নীচ থেকে উপরে উঠে এটি সেগুলোরও প্রান্তসীমা। নীচ থেকে কোন বস্তু উঠতে অক্ষম। এখানেই জিব্রাইল (আ.) ‘র অবস্থানস্থল। সেখানে পৌঁছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বােরাক থেকে অবতরণ করেন এবং তাঁর জন্য সবুজ রঙের রফরফ নামক আসন পেশ করা হয়েছে। তিনি রফরফে উঠে বসলে জিব্রাইল (আ.) রফরফের সাথে অবতীর্ণ ফেরেশতাদের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সোর্পদ  করে দেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাইল (আ.)কে সঙ্গে সম্মুখে অগ্রসর হতে বললেন, কিন্তু জিব্রাইল (আ.) বললেন, আমি সক্ষম নই। যদি আমি এক কদম অগ্রসর হই তাহলে জ্বলে যাবাে। আমরা প্রত্যেক ফেরেশতাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে। হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দর্শনসমূহ দেখানাের জন্য আপনাকে ভ্রমণ করাচ্ছেন। আপনি তাতে অমনযােগী হবেন না। তারপর জিব্রাইল (আ.) তাঁকে বিদায় জানান আর তিনি রফরফে ঐ ফেরেশতার সাথে রওয়ানা হলেন। রফরফ তাঁকে নিয়ে ‘মকামে ইস্তাওয়া’ পর্যন্ত পৌঁছে। সেখানে তিনি কলম চালনার শব্দ শুনেছেন যেগুলাে দিয়ে আল্লাহর সে সব বিধান লেখা হচ্ছে, যা তিনি তার স্বীয় সৃষ্টির জন্য প্রেরণ করেন। তিনি ঐসব ফেরেশতাদেরকে দেখেছেন যারা আমলসমূহ লিখেন। প্রত্যেক কলম একজন ফেরেশতা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- তােমরা যা কিছু আমল কর আমি সেগুলাে লিখে রাখি। অতঃপর তিনি নূরের মধ্যে তীব্রগতিতে অগ্রসর হলেন।

ফলে যে ফেরেশতা তাঁর সঙ্গে ছিলেন তিনিও পশ্চাতে রয়ে গেলেন। যখন তিনি সঙ্গে কাউকে দেখতে পান নি তখন সামান্য বিচলিত হয়ে উঠেন এবং তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন আর বুঝতে পারছেনা এখন কি করবেন? এখানে ফেরেশতা ও রফরফ কিছুই নেই কেবল তিনি একাকী আর সব দিকে নূর আর নূর। তিনি অস্থির হয়ে ডানে-বামে ঝুঁকছেন। এসময় তিনি দীদারে এলাহীর অনুমতি প্রার্থনা করেন যাতে আল্লাহর বিশেষ অবস্থার সম্মুখে প্রবেশ করতে পারেন। তখন আবু বকর (রা.)’র আওয়াযের ন্যায় আওয়ায আসল –قف يا محمد فان ربك يصلي ” হে মুহাম্মদ থামুন, আপনার প্রতিপালক সালাত পড়তেছেন।

তিনি এ আওয়াজ শুনে অবাক হলেন এবং মনে  মনে ভাবলেন – আমার প্রতিপালক কি নামা পড়েন? তাঁর অন্তরে যখন অবাক সৃষ্টি হলো এবং আবু বকর (রা.)’র আওয়ায শুনে তিনি কিছুটা স্বস্তিবোধ  করলেন তখন তাঁর সামনে هو الذي يصلي عليكم وملائكته আয়াত পাঠ করা হল যার অর্থ হল, “তিনি (আল্লাহ) এমন সত্তা যিনি তােমাদের উপর সালাত (রহমত) পড়েন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও সালাত পড়েন। “তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত দ্বারা নামায উদ্দেশ্য নয় বরং আল্লাহর রহমত নাযিল হওয়া উদ্দেশ্য। অতঃপর এর মনে আসল যে, এখানে তিনি আল্লাহর বিশেষ সম্মুখে প্রবেশের অনুমতিপ্রাপ্ত হন এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর উপর অহী নাযিল করেন অর্থাৎ কথা বললেন, যা যা বলার ছিল। তিনি আল্লাহর সেই নুরানী তজল্লী দেখেছেন যা তিনি ব্যতীত অন্য কেউ দেখেননি। (আল ইয়াওয়াকীত ওয়াল জাওয়াহির)

কোন কোন বর্ণনায় আছে আল্লাহ তায়ালা আহবান করেছিলেন- ادن يا احمد ادن يا محمد হে আহমদ ও মুহাম্মদ! আরাে নিকটে এসাে। তখন আমার রব আমাকে এত নিকটে নিয়ে গেলেন যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ثم دنا فتدلى، فكان قاب قوسين أو أدنى অর্থাৎ তিনি আল্লাহর অতি নিকটে গেলেন। তখন উভয়ের মাঝে মাত্র দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরাে কম। (সূরা নাজম, আয়াত – ৮,৯)

আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভীতি দূরীভূত করার জন্য আবু বকর (রা.)’র আকৃতিতে একজন ফেরেশতা সৃষ্টি করে তাঁরই আওয়াযের ন্যায় আওয়ায করে এরূপ বলার ব্যবস্থা করেছেন। (মাদারেজুন নবুয়্যত)

রাসূল এর আগে-পরের সকল জ্ঞান অর্জন

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আরশ এলাহীতে অবস্থান করেন তখন আরশ থেকে এক ফোঁটা তাঁর মুখে প্রদান করা হয়। ফলে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল জ্ঞান তাঁর অর্জিত হলাে। যেমন হাদিস শরীফে আছে-
ثم دل لي قطرة من العرش فوقعت على لسانى فما ذاق الذائقون شيئا قط أحلى منها فانبأني الله بها نبأ الأولين والاخرين ونور قلبى

অতঃপর আমার জন্য এক ফোঁটা আরশ থেকে ফেলা হয়েছে যা আমার মুখে পতিত হলাে। কোন স্বাদ গ্রহণকারী কখনাে এরূপ স্বাদ গ্রহণ করেনি। এর ফলে আল্লাহ তায়ালা আমাকে আগে- পরের সব সংবাদ প্রদান করেন এবং আমার অন্তরকে আলােকিত করেছেন। (নুযহাতুল মাজলিস)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সকল গুণে গুণাম্বিত হওয়া

আলেমে রাব্বানী আল্লামা ইমাম শা’রানী (র.) বলেন-
انه اذا مر على حضرات الاسماء الألهية صار متخلقا بصفاتها فاذا مر على الرحيم كان رحيما أو على الغفور كان غفورا أو على
الكريم كان كريما أو على الحليم كان حليما أو على الشكور كان شكورا او على الجواد كان
جوادا وهكذا انما يرجع من ذالك المعراج الا هو في غاية الكمال

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  যখন আল্লাহর বিশেষ নামসমূহ অতিক্রম করেছেন তখন তিনি ঐ নামসমূহের বিশেষণে বিশেষিত হয়েছিলেন, ‘গাফুর এর উপর দিকে অতিক্রম করার সময় ‘গাফুর’ করিম এর উপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় ‘করিম’, ‘হালিম’ এর উপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় ‘হালিম’ ‘শাকুর’ এর উপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় ‘শাকুর’, ‘জাওয়াদ’ এর উপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় ‘জাওয়াদ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মি’রাজ থেকে ফিরেছেন সকল গুণে পূর্ণ গুণান্বিত হয়ে।

মিরাজের প্রমাণ

হাফিয ইবনে কাসীর (র.) মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের সূত্রে হযরত উম্মে হানী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি’রাজ থেকে এসে এর পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করেন এবং তিনি কুরাইশদের এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করার লক্ষ্যে ঘর থেকে বের হতে চাইলে আমি তাঁর দামান ধরে বললাম, তারা এ ঘটনা শুনলে আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। কিন্তু তিনি গিয়ে কুরাইশদের নিকট এ ঘটনা বর্ণনা করলে তারা তা অস্বীকার করল। বায়হাকীর বর্ণনামতে আবু জেহেল সকলকে বলতে লাগল যে, বাইতুল মােকাদ্দাস এখান থেকে এক মাসের পথ। যাওয়া-আসা করতে কমপক্ষে দুই মাস সময় লাগবে। আর মুহাম্মদ নাকি রাতের অল্প সময়ে তা ভ্রমণ করে এসেছেন। জুবাইর ইবনে মুতআম বলেন- হে মুহাম্মদ! সত্যিই যদি আপনি এ রাতে সেখানে গিয়ে থাকেন তাহলে এই মুহূর্তে আপনি এখানে থাকতেন না। এক ব্যক্তি বলল, হে মুহাম্মদ! আপনি কি অমুক জায়গায় আমাদের উটগুলাে দেখেছেন? তিনি বললেন হ্যাঁ আমি দেখেছি যে, তাদের একটি উট হারিয়ে গেছে আর তারা সেটি খুঁজছে। ঐ ব্যক্তি বলল -অমুক গোত্রের  উটগলাের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তাদেরকে অমুক জায়গায় দেখেছি। তাদের লাল রঙের একটি উটের পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাদের নিকট পানি ভর্তি পেয়ালা ছিল যা আমি পান করে ফেলেছি। তখন লােকটি বলল, আচ্ছা বলুনতাে তাদের উটনী কয়টি ছিল এবং এদের রাখাল ছিল কারা? তিনি বললেন, আমি ঐগুলাের গণনার দিকে দৃষ্টি দেইনি। তবে এ সময় ঐ সব উট ও রাখালকে আমার সামনে উপস্থিত করা হয়েছে। তিনি গুণে গুণে উটের সংখ্যা ও রাখালের নাম বলে দিলেন। তিনি আরাে বললেন- আবু কুহাফার সন্তান তথা আবু বকরের রাখালও রয়েছে এবং সকালে এরা ওয়ারদীয়ে সানিয়ায় পৌছে যাবে। তারা সকালে সেখানে গিয়ে তার কথা সত্য কিনা যাচাই করতে অপেক্ষা করতে লাগল। ঠিকই যথাসময়ে উটগুলাে এসে গেল। তারা রাখালদের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বর্ণিত কথাগুলাে জিজ্ঞাসা করলে তারা সবগুলাে সত্য বলে সাক্ষ্য দিল। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমি এই ঘটনাকে বিশ্বাস করি। সুতরাং ঐ দিনই তার উপাধি সিদ্দিক হলাে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সকালে মুশরিকদেরকে মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করলেন, তারা হযরত আবু বকর (রা.)’র নিকট গিয়ে বলল, হে আবু বকর! তােমাদের নবী বলছেন যে, তিনি নাকি গতরাতে এক মাসের দূরত্বের সফর করে পুনরায় ফিরে এসেছেন। এখন তুমিই বল তিনি এগুলো কি বলছেন ? হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, তিনি যদি সত্যিই এরূপ বলে থাকেন তবে সত্য বলেছেন। আমি তা বিশ্বাস করি। আমি তাঁর এর চেয়েও অসম্ভব কথাও বিশ্বাস করি। তিনি আসমান থেকে আগত বিষয়ের সংবাদ দেন আর আমি তাও বিশ্বাস করি। (প্রাগুক্ত)  বায়হাকীর বর্ণনায় আছে- মুশরিকদের এক ব্যক্তি বলল, বাইতুল মােকাদ্দাস সম্পর্কে আমি সবচেয়ে অধিক জ্ঞাত। সে বলল- হে মুহাম্মদ! আপনি বলুন বাইতুল মােকাদ্দাসের দালান, অবস্থা, স্বরূপ ও সেটি পাহাড়ের কতটুকু নিকটে? তখন আল্লাহ তায়ালা বাইতুল মুক্কাদাসকে তুলে এনে তাঁর সামনে রাখলেন তিনি চোখে দেখে দেখে বাইতুল মােকাদ্দাস সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। লােকটি শুনে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। তখন সে তার সঙ্গীদের নিকট গিয়ে বলল, মুহাম্মদ নিজের দাবীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

ইমাম বুখারী (র.) হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যখন কুরাইশরা আমার মি’রাজকে অস্বীকার করল তখন আমি কা’বার  মীযাবে রহমতের নীচে দাঁড়িয়ে গেলাম।
فجلى الله لي بيت المقدس، فطفقت أخبرهم عن آياته وانا أنظر إليه 
আল্লাহ তায়ালা আমার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাসকে উন্মুক্ত করে দিলেন। অতঃপর দেখে দেখে আমি এর নির্দর্শনসমূহের সংবাদ দিলাম। (সহীহ বুখারী)

হাফিয আবু নঈম ইস্পাহানী দালায়েলুন নবুয়্যত গ্রন্থে স্বীয় সূত্রে মুহাম্মদ ইবনে কা’ব কুরাইযী থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত দাহইয়া ইবনে খলিফাকে কায়সারে রােমের নিকট প্রেরণ করেন। হারকাল বাদশা আবু সুফিয়ান সখর ইবনে হারবকে ডেকে পাঠান। এ সুযােগে আবু সুফিয়ান হারকাল বাদশাহর নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস চালায়। সে বলল, হে বাদশা! আমি তার (মুহাম্মদ) সম্পর্কে এমন তথ্য দেবাে যাতে তিনি যে মিথ্যুক তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। হারকাল বললেন- বল, সে তথ্য কি? আবু সুফিয়ান বলল, তিনি (মুহাম্মদ) দাবী করেন যে, একরাতে নাকি তিনি মক্কা থেকে আপনাদের মসজিদ মসজিদে আকসায় এসেছেন এবং ঐ রাতেই সকাল হওয়ার পূর্বে আমাদের নিকট ফিরে এসেছেন। মসজিদে আকসার খাদেম এসময় বাদশা’র পাশে দণ্ডায়মান ছিলেন। তিনি বললেন, আমি ঐরাত সম্পর্কে জানি। বাদশা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান? তিনি বললেন, প্রতিরাতে আমি ঘুমানাের পূর্বে মসজিদের দরজা বন্ধ করি। ঐ রাতে আমি সব দরজা বন্ধ করেছি কিন্তু একটি দরজা বন্ধ করতে পারিনি। মিস্ত্রি ডাকলাম, তারা দেখে বলল- এই দরজার উপরিভাগের চৌকাঠ নীচের দিকে দাবিয়ে গেছে। এখন আমরা তা ঠিক করতে পারবাে না। সকালে এসে ঠিক করে দেবাে। ফলে ঐ রাতে দরজার উভয় কপাট খােলা রেখে আমি চলে গেলাম। সকালে এসে দেখি মসজিদের পাশে পাথরে একটি গর্ত এবং এখানে সাওয়ারী বাধার চিহ্ন পেয়েছি আর দরজা কোন মেরামত ছাড়াই বন্ধ করা গেল। আমি সঙ্গীদের বললাম গতরাত এই মসজিদে নামায আদায় করা হয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

দীদারে এলাহী ও আল্লাহর দর্শন লাভ

সকল আম্বিয়ায়ে কিরামের মধ্যে কেবল মুহাম্মদ মােস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় দীদার ও দর্শন দ্বারা ধন্য করেছেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে সূরা ‘নাজমে বর্ণিত হয়েছে। উক্ত সূরায় ثم دنا فتدلى আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী (রা.) বলেন, হযরত হাসান বসরী (রা.)’র মতে উক্ত আয়াতে উভয় সর্বনাম আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়েছে। এভাবে ولقد رآه نزلة أخرى، عند سدرة المنتهى  তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) তাঁকে (আল্লাহকে) দ্বিতীয়বার দেখেছেন সিদরাতুল মুনতাহায় ।(সূরা নাজম আয়াত-১৩) এ আয়াতেও ه  সর্বনাম আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হয়েছে। হযরত হাসান বসরী শপথ করে বলেন যে,  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  আল্লাহকে দেখেছেন। (তাফসীরে রূহুল মায়ানী)

ইমাম বুখারী (র.) আরাে স্পষ্টভাবে বিশুদ্ধ হাদিসে বলেছেন-
حتى جاء سدرة المنتهى، ودنا للجبار رب العزة، قتدلی حتى كان منه قاب قؤسین أو أدنى –
এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহায় পৌছেন এবং রাব্দুল ইজ্জত জাব্বার তাঁর নিকটবর্তী হলেন, অতঃপর আরাে নিকটবর্তী হলেন, ফলে তিনি তাঁর থেকে দুই ধনুকের কিংবা এর চেয়ে অধিক নিকটবর্তী হলেন। (সহীহ বুখারী)

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ما كذب الفؤاد ما رأى  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দেখেছন তা তাঁর অন্তর মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি। (সূরা নাজম, আয়াত-১১)

ইমাম নববী (র.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ذهب الجمهور من المفسرين الى ان المراد انه رأي ربه سبحانه  অধিকাংশ মুফাসসীরীনগণের মতে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলাে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতিপালককে দেখেছেন। (শরহে মুসলিম)

হযরত ইকরামা (রা.) ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, رايت ربي تبارك وتعالى  আমি আমার মহান পবিত্র প্রভুকে দেখেছি। (মুসনাদে আহমদ)

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে অনুরূপ হাদিস ইমাম তিরমিযী, ইমাম মুসলিম, ইবনে হিব্বান, ইবনে জারীর তাবারী, ইমাম হাকেম, হাফিয নুরুদ্দীন হায়শামী প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেছেন।

হাফিয নুরুদ্দীন ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলতেন- ان محمدا  صلى الله عليه وسلم رأي ربه مرتين مرة ببصَره وَمَرَة بفواده নিশ্চয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রবকে দু’বার দেখেছেন। একবার কপালের চোখে আরেকবার অন্তরের চোখে। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ)

তাফসীরে সাবী গ্রন্থে বলা হয়েছে -أختلف في تلك الروية فقيل راه بعينه حقيقة وهو  قول الجمهور الصحابة والتابعين  আল্লাহর সেই দর্শন নিয়ে ওলামাদের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন তিনি আল্লাহ তায়ালাকে বাস্তবিকভাবে স্বচক্ষে দেখেছেন। আর এটিই অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেঈদের মত। (তাফসীর সাবী)

اختلف في رويته صلى الله  عليه وسلم لربه تبارك وتعالى تلك الليلة فاكثر العلماء على وقوع ذالك إلى انه صلى الله عليه وسلم راه عز وجل بعين راسه

মিরাজের রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রবকে দেখার বিষয়ে মতবিরােধ রয়েছে। অধিকাংশ ওলামাগণের মতে তিনি আল্লাহকে কপালের চোখে দেখেছেন। (সীরাতে হালবী)
ان الراجع عند أكثر العلماء أن رسول الله   صلى الله  عليه وسلم رأي ربه بعين رأسه ليلة الاسراء –
অধিকাংশ ওলামাগণের বিশুদ্ধ ও প্রাধান্য মত হলাে মি’রাজ রাতে নবী করিম তাঁর প্রতিপালককে নিজের চোখে দেখেছেন। (শরহে মুসলিম)

এ ব্যাপারে ফায়সালামূলক সিদ্ধান্ত দেন আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (র.)। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি  মিরাজের রাতে আল্লাহ তায়ালাকে কপালের চোখে দেখেছেন কিনা তা সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) তা অস্বীকার করেন কিন্তু ইবনে আব্বাস (রা.)এর পক্ষে মত দিয়েছেন। এ দু’জনের প্রত্যেকের সাথে একদল সাহাবী যােগ দিয়েছেন। এভাবে তাবেঈগণের মধ্যেও দু’দলে বিভক্ত হয়েছেন আবার একদল এ ব্যাপারে নিরবতা পালন করেন। তবে অধিকাংশ ওলামা ইবনে আব্বাস (রা.)এর মতের পক্ষ অবলম্বন করেন। ইমাম নববী (র.) লিখেছেন যে, অধিকাংশ ওলামাগণের পছন্দনীয় মত হলাে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তায়ালাকে দেখেছেন। আর ইবনে আব্বাস (রা.) এই মত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্ৰবণ করে বলেছেন। পক্ষান্তরে হযরত আয়েশা (রা.) এটিকে কেবল নিজস্ব ইজতিহাদ দ্বারা অস্বীকার করেছেন। ইবনে ওমর (রা.) ইবনে আব্বাস (রা.)’র কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তায়ালাকে দেখেছেন আর ইবনে ওমর (রা.) তার কথাটি মেনে নিয়েছেন। অধিকাংশ সুফীয়ায়ে কিরামের মতও অনুরূপ। (আশআতুল লুমআত)

কেউ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র.)কে জিজ্ঞাসা করেছেন হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মনে করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় রবকে দেখেছেন, তা হলে সে আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। এখন কোন দলীল দ্বারা হযরত আয়েশা (রা.)’র মত খণ্ডন করা যাবে? উত্তরে তিনি বলেন, স্বয়ং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বাণী দ্বারা খণ্ডন করা হবে। কেননা তিনি বলেছেন, আমি আমার রবকে দেখেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বাণী আয়েশা (রা.)’র বাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। (মাদারেজুন নুবয়্যত)

মােটকথা হলাে- ইমাম হাসান বসরী, ইবনে দাহইয়া, ইমাম আহমদ, আবুল হাসান আশআরী, ইমাম নববী, কাযী আয়ায, শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী, শিহাবউদ্দিন সুহরাওয়ার্দী, সাহল ইবনে আব্দুল্লাহ তাসতারী, মুজাদ্দিদে আলফেসানী (র.) প্রমুখ ওলামা মাশায়েখগণ ইবনে আব্বাস (রা.)’র মত গ্রহণ করেছেন। (আওয়ারিফুল মাআরিফ)

সূত্র- বার মাসের আমল ও ফযিলত