নির্জনে খোদাপ্রেমের সুদাপান ইতিকাফ
লেখকঃ এম সাইফুল ইসলাম নেজামী
ঈমানদারদের সৌভাগ্যের পূর্ণচন্দ্র আস্তে আস্তে হেলে পরছে। মুমিন হৃদয়ে প্রাণোচ্ছল ইবাদতের ভরা মৌসুম মাহে রমজান শেষ হয়ে যাচ্ছে। রহমতের দশক শেষ হয়ে মাগফিরাতেরও যবনিকালগ্নে মাহে রমজান।
এ লগ্নে অসংখ্য মুমিন মুসলমান প্রস্তুতি নিচ্ছেন, দুনিয়ার মোহনিদ্রা ত্যাগ করে আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াসে মসজিদের কোনে অবস্থান নেবার। আল্লাহর জিকির, নবী (দ.)-এর দরুদ, ইবাদাত বান্দেগীর মাধ্যমে খোদাভীতি ও রসুলপ্রীতির সমন্বয় ঘটানোর সময় মাহে রমজানের শেষাংশে (নাজাত) তথা ইতিকাফ। ইবাদতের ভরা বসন্ত মাহে রমজানের অংশ পবিত্র ইতিকাফ। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সুরা বাকারার ১২৫ নং আয়াতে মহান আল্লাহ ঘোষণা “এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।”জাহানের রহমত আ’কা মুহাম্মদ (দ.) এরাশাদ করেন, “রমজান মাসের প্রথম দশদিন হলো রহমত (দয়া), মাঝের দশদিন হলো মাগফিরাত (মাফ), শেষের দশদিন হলো নাজাত (মুক্তি)।”
মোহমুক্তির অন্যতম উপায় হচ্ছে নিজেকে পাপ থেকে দূরে রাখা। আর ইতিকাফ হচ্ছে পাপ-পঙ্কিলতা হতে দূরে থাকার পরীক্ষার মাধ্যম। ইতিকাফে বান্দাহ দুনিয়ার সব মোহ-মায়া ত্যাগ করে একাগ্রচিত্তে মহান আল্লাহর মহানুভবতার সান্নিধ্যে চলে যায়। ইবনে মাজাহ শরীফের বর্ণনা মতে ইতিকাফকারী গুনাহ্ থেকে বিরত থাকে এবং নেক আমল দ্বারা এতো অধিক পরিমাণে পুণ্য হাসিল করে যেন সে সকল নেক আমল সম্পন্ন করলো। সুবহানাল্লাহ। অপর এক হাদিসে শান্তিদূত প্রিয় নবী (দ.) ইরশাদ করেন, আমি (প্রথমে) এ রাতের সন্ধানে প্রথম দশে ইতিকাফ পালন করি। হাদিসে এ রাত বলতে লাইলাতুলকদরকে বুঝানো হয়েছে। অতঃপর ইতিকাফ পালন করি মাঝের দশে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে (এ দশে) ইতিকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সাথে ইতিকাফ পালন করল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান প্রিয় নবী (দ.) বলেন, আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অতঃপর রসুলে পাক (দ.) একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এল, এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত। উম্মুল মুমিনীন আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, “রাসূলে পাক (দ.) মাহে রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন।” উল্লেখিত হাদিসের আলোকে এটাই দিবালোকের মত স্পষ্ট হয় যে, ইতিকাফ একটি উত্তম ইবাদত। এর বদৌলতে গুনাহ্ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থাকার সৌভাগ্য নসীব হয় এবং দুনিয়ায় থেকে দুনিয়াবিমুখ জীবন যাপনের একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য মুসলমান বিবেক সম্পন্ন এবং নারীর ক্ষেত্রে হায়েস ও নেফাস থেকে মুক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। ইতিকাফের জন্য জুমা মসজিদ শর্ত নয়। যে কোন মসজিদে ইতিকাফ যায়েয। ইতিকাফ অবস্থায় বিনা অযুহাতে মসজিদ থেকে এবং মহিলাদের বেলায় নির্ধারিত কামরা থেকে বের হওয়া সম্পূর্ণ রূপে হারাম। মসজিদুল হারামে আদায়কৃত ইতিকাফ ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতিকাফ। তারপর মসজিদে নববীর ইতিকাফ এবং তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস। তারপর উৎকৃষ্ট ইতেকাফ হলো- কোনো জামে মসজিদে ইতিকাফ করা যেখানে রীতিমতো জামাআতে নামায হয়। এরপর মহল্লার মসজিদে। ইতিকাফকারি গোসল, পায়খানা, প্রস্রাব, অযু, জুমার নামাজের জন্য (যদি এটা জুমা মসজিদ না হয়) এবং আজানের জন্য বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে। অন্য কোন কারণে, যেমন পানাহারের জন্য, এমনকি জানাযার নামাজের জন্যও ইতিকাফকারী বের হওয়া যায়েজ নেই। ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীকে স্পর্শ করা চরমভাবে নিষিদ্ধ। সহবাসের কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়।
একইভাবে যতদিন রমজানের ইতিকাফ ভঙ্গ করবে বা হবে, ততদিন রমজানের পরে রোজাসহ ইতিকাফ ক্বাযা আদায় করবে। সম্পূর্ণ দশদিনের ক্বাযা ওয়াজিব নয় এবং পরের রমজানেও ক্বাযা করা জরুরী নয়। যে কোন মাসে ক্বাযা আদায় করা যায়। ইতিকাফ একটি মহান ইবাদত, মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছরই ইতিকাফ অন্যান্য সকল বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়।