দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলামী দিক-নির্দেশনা
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা, মেহনত কর সবে। ইরশাদ হচ্ছে- আমি দুনিয়াতে তাদের মধ্যে জীবিকা সামগ্রী বণ্টন করি যাতে তারা একে অপরকে সেবকরূপে গ্রহণ করে।’ আল্লাহ তাআলা মানুষকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে সৃষ্টির সেরা করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের সুখ-শান্তির জন্য এ ধরণীকে ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন। সম্পদ বণ্টনে তিনি কাউকে প্রাধান্য দিয়েছেন আবার কাউকে করেছেন নিঃস্ব। কাউকে সম্পদ দিয়ে আবার কাউকে সম্পদ নিয়ে পরীক্ষা করছেন তিনি। তাই মানুষের দায়িত্বই হচ্ছে সুখ ও শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। আলোচ্য নিবন্ধে দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামী দিক নির্দেশনা সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।
‘টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা’র স্নোগানে প্রতি বছর ১৭ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস। সাধারণ অর্থে আমরা দারিদ্রে বলতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক মানবাধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব; বিশেষ করে প্রতিদিনের খাদ্যের অভাবকেই বুঝি। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে, বর্তমান বাংলাদেশের ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আর চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে প্রায় ২ কোটি মানুষ। দারিদ্রতার প্রশ্নে বিশ্বব্যাংক বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে, ‘দৈনিক কোনো মানুষ যদি গড়ে ১ থেকে দেড় ডলার পর্যন্ত আয় করে তবে তাকে দারিদ্র্যের তালিকায় রাখা হয়।’ ইসলাম দারিদ্র্যের মূলে কুঠারাঘাত করে ক্ষুধা ও অভাবমুক্ত সুন্দর সমাজ উপহার দিতে শরয়ী বিধি-বিধান নির্ধারণ করছে। মূলত, সমাজে শোষণ ও নির্যাতনমূলক প্রচলিত নিম্নোক্ত অর্থ ব্যবস্থা দারিদ্র্যকে ত্বরান্বিত করে। যেমন-
২। হারাম উপায়ে উপার্জন।
৩। ব্যবসায়িক অসাধুতা।
১. সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা:
সুদ শোষণ ও নির্যাতনমূলক হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে- এটি সমাজে ধনী গরীব বৈষম্য সৃষ্টি করে। এতে ধনী আরও ধনী হয়, দরিদ্র্য হয় আরও দরিদ্র্য। এটি ভুমিহীন কৃষক বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা গড়ে ওঠার প্রধান প্রতিবন্ধক। পৃথিবীর বরেণ্য অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় সুদও যে চরম ক্ষতিকর তা প্রমাণিত হয়েছে। তাই ইরশাদ হচ্ছে” আল্লাহ তায়ালা সুদকে হারাম করেছেন।” বিত্তবান মনে করে, সম্পদ আহরন করে সুদী ব্যবসায়ে নিয়োগ করলে সম্পদ বেড়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে- না, সুদের মাধ্যমে বরং সম্পদ কমে যায়। সৎকাজে অর্থ নিয়োগ করলেই সম্পদ বেড়ে যায়। ইরশাদ হচ্ছে-“আল্লাহ সুদ নির্মূল করেন ও দান-সাদকাকে প্রতিপালন ও ক্রমবৃদ্ধি করেন।” অন্যত্র বলা হয়েছে, “তোমরা এই যে সুদ দাও মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির আশায়, জেনে রাখো, আল্লাহর নিকট তা কখনো বৃদ্ধি লাভ করে না। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাকাত বাবদ যে দান করে থাকো একমাত্র তার মধ্যেই ক্রমবৃদ্ধি হয়ে থাকে।”
২. হারাম উপায়ে উপার্জন:
হারাম তথা অবৈধ পন্থায় উপার্জন সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর যেমন-মদ,জুয়া,অশ্লীল সিনেম গান ও চোরা কারবারি ইত্যাাদ। এগুলোর মাধ্যমে একটি শ্রেণী বিপুল ভিত্তবৈভের মালিক হয়,অন্যদিকে সাধারণ মানূষ হয় প্রতারিত। এসব বিবেচনা করে ইসলাম এমন উপার্জনকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনকে হালাল করেছে। ইরশাদ হচ্ছে-আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন।
ব্যবস্যায়িক অসাধুতা দারিদ্র্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ। বস্তুবাদীরা বলে থাকে সুদ ও ব্যবসা একই জিনিস। ব্যবসায় নিয়োগ করা টাকার মুনাফা যদি বৈধ হয় তাহলে ঋণ স্বরূপ দেওয়া টাকার মুনাফা অবৈধ হবে কেন? এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের অবৈধ নীতির সাহায্যে বাজারে প্রভাব ফেলে যা সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির সম্মুখীন করে। যেমন অসাধু ব্যবসায়ীরা মন্দা বাজারে সস্তায় মালামাল ক্রয় করে গুদামজাত করে পরবর্তী চড়া মূল্যে বিক্রয় করার নীতি গ্রহণ করে থাকে। একটি দেশকে দারিদ্রতার দিকে টেলে দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট।
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতিঃ
অর্থ উপার্জনের যেসব পন্থা অবলম্বিত হলে এক ব্যক্তির লাভ ও অপর ব্যক্তির ক্ষতি হয় তা সবই অবৈধ। পক্ষান্তরে যেসব উপায় অবলম্বন করলে সম্পদ উপার্জনে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ন্যায়সঙ্গত সুফল ভোগ করতে পারে তা সবই বৈধ। এ মূলনীতিটি ইসলামী আইনে এভাবে বিবৃত হয়েছে-“হে ঈমানদারগন! তোমরা পরষ্পরের ধন-সম্পদ অবৈধ ভাবে ভক্ষন করো না। তবে পারষ্পরিক সম্মতি অনুযায়ী ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারো। আর তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে (অথবা পরষ্পরকে) ধ্বংস করো না। আল্লাহ তোমাদের অবস্থার প্রতি করুণাশীল। যে ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে যুলুম সহকারে এরূপ করবে তাকে আমি অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করবো। উপরোক্ত আয়াতে পারস্পরিক লেনদেনকে ব্যবসা বলা হয়েছে। পারস্পরিক সম্মতিকে এর সাথে শর্ত হিসাবে সংযুক্ত করে এমন সব লেনদেনকে অবৈধ গণ্য করা হয়েছে, যার মধ্যে চাপ সৃষ্টি ও প্রতারণার কোন উপকরণ থাকে অথবা এমন কোন চালবাজী থাকে যা দ্বিতীয় পক্ষ জানতে পারলে এ লেনদেনে নিজের সম্মতি প্রকাশে কোন দিনই প্রস্তুত হবেনা । এতে আরো বলা হয়েছে তোমরা পরষ্পরকে ধ্বংস করো না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজের লাভের জন্য অন্যের সর্বনাশ করে সে যেন তার রক্তপান করে এবং পরিনামে সে এভাবে নিজের ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করে।
২. সম্পদ সঞ্চয়ে নিষেধাজ্ঞা:
বৈধ উপায়ে যে সম্পদ উপার্জন করা হয় তা পুঞ্জিভূত করে রাখা যাবেনা। কেননা, এতে ধন-সম্পদের আবর্তন বন্ধ হয়ে যায় এবং সম্পদ বন্টনে ভারসাম্য থাকে না। যে ব্যক্তি অর্থ সঞ্চয় করে রাশীকৃত ও পুঞ্জীভূত করে রাখে সে নিজে যে কেবল মারাত্মক নৈতিক রোগে আক্রান্ত হয় তাই নয় বরং মূলত সে সমগ্র মানব সমাজের বিরুদ্ধে একটি জঘন্যতম অপরাধ করে। যার ফল তার নিজের জন্যও শুভ নয়। এজন্য ইসলাম কার্পণ্য এবং কারুনের ন্যায় সম্পদ কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত করে রাখার কঠোর বিরোধিতা করেছে। ইরশাদ হচ্ছে -“যারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহে কৃপনতা করে, তারা যেন একথা মনে না করে যে, তাদের এ কাজ তাদের জন্য মঙ্গলজনক এবং প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর।” অন্যত্র রয়েছে “যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।” একথা পুঁজিবাদের ভিত্তিতে আঘাত হানে। উদ্বৃত্ত অর্থ জমা করে রাখা এবং জমাকৃত অর্থ আরো অধিক পরিমান অর্থ সংগ্রহে খাটানো— এটিই হচ্ছে পুঁজিবাদের মূল কথা। কিন্তু ইসলাম আদতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ জমা করে রাখা পছন্দ করেনা। কেননা, কিয়ামতের ভয়াবহ দিবসে তা কোন উপকারেও আসবে না। রাব্বুল আলামীনের আযাব থেকে মুক্তি পেতে হলে সঠিকভাবে, সঠিক খাতে যাকাত আদায় করতে হবে। তবেই তা মুক্তির পাথেয় হিসেবে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের নিকট গ্রহণীয় হবে।
সঞ্চয় করার পরিবর্তে ইসলাম সম্পদ ব্যয় করার শিক্ষা দেয়। কিন্তু ব্যয় করার অর্থ বিলাসিতা ও আয়েস-আরামের জীবনযাপন করে দু’হাতে অর্থ লুটানো নয়। বরং ব্যয় করার ক্ষেত্রটি আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ সমাজের কোন ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে উদ্বৃত্ত সম্পদ থাকে তা সমাজের জন্য কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে হবে। এটিই হবে আল্লাহর পথে ব্যয়। ইরশাদ হচ্ছে-“হে হাবীব! তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে যে, তারা কি ব্যয় করবে? তাদেরকে বলে দিন, যা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত (তাই ব্যয় করো)”। “আর সদ্ব্যবহার করো নিজের মা-বাপ,আত্মীয়-স্বজন, অভাবী-মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, নিজের মোলাকাতি বন্ধুবর্গ, মুসাফির ও মালিকানাধিন দাস-দাসীদের সাথে।” অন্যত্র রয়েছে “তাদের (ধনাঢ্যদের) অর্থ-সম্পদে ফকীর ও বঞ্চিতদের অধিকার আছে।” এক্ষেত্রে ইসলাম ও পুঁজিবাদের দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায়। বিত্তবান মনে করে, অর্থ ব্যয় করলে দরিদ্র হয়ে যাবে এবং সঞ্চয় করলে বিত্তশালী হবে। কিন্তু ইসলাম বলে, সম্পদ ব্যয় করলে কমে যাবেনা বরং বরকত ও বৃদ্ধি হবে। ইরশাদ হচ্ছে -“শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যের ন্যায় লজ্জাকর কাজের হুকুম দেয় কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট মাগফেরাত ও অতিরিক্ত দানের ওয়াদা করেন। ” বিত্তবান মনে করে কোনো কিছু ব্যয় করা হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে,না, তা নষ্ট হয়ে যায়নি বরং তার সর্বোত্তম লাভ তোমাদের নিকট ফিরে আসবে। ইরশাদ হচ্ছে -“সৎকাজে তোমার যা কিছু ব্যয় করবে তা তোমরা পুরোপুরি ফেরত পাবে এবং তোমাদের ওপর কোনোক্রমেই যুলুম করা হবেনা। ” যাকাত ও সাদকার মাধ্যমে ব্যয়কৃত অর্থ হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে- দুনিয়াতেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ মতাদর্শটি একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থ সঞ্চয় করে সুদি ব্যবসায়ে নিয়োগ করার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ চতুর্দিক থেকে অর্থ আহরিত হয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে আসবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা প্রতিদিন কমে যেতে থাকবে। কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায় সর্বত্র মন্দাভাব দেখা দেবে। জাতীয় অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে। অবশেষে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যার ফলে পুঁজিপতিরাও নিজেদের সঞ্চিত সম্পদ অর্থ উৎপাদনের কাজে লাগাবার সুযোগ পাবে না। তাই রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “সুদের পরিমাণ যত বেশীই হোক না কেন অবশেষে তা কম হতে বাধ্য”। পক্ষান্তরে অর্থ-সম্পদ সুনির্দিষ্ট শরয়ী পন্থায় ব্যয় করলে এবং যাকাত ও সাদকা আদায় করলে পরিণামে জাতির সকল ব্যক্তির হাতে এ সম্পদ ছড়িয়ে পড়ে, প্রত্যেক ব্যক্তি যথেষ্ট ক্রয়-ক্ষমতার অধিকারী হয়, শিল্পোৎপাদন বেড়ে যায়, সবুজ ক্ষেতগুলো শস্যে ভরে ওঠে, ব্যবসা- বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়, হয়ত কেউ লাখপতি-কোটিপতি হয় না কিন্তু সবার অবস্থা সচ্ছল হয় এবং প্রতিটি পরিবারই হয় সমৃদ্ধিশালী।
বস্তুত ইসলাম পুঁজিবাদী মানসিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর মানসিকতা তৈরি করে- যা পুঁজিপতি কখনো কল্পনাই করতে পারেনা যে, সুদ ছাড়া এক ব্যক্তি তার অর্থ সম্পদ আর এক ব্যক্তিকে কেমন করে দিতে পারে। সে অর্থ ঋণ দিয়ে তার বিনিময়ে কেবল সুদই আদায় করে না, বরং নিজের মূলধন ও তার সুদ আদায় করার জন্য ঋণগ্রহীতার বস্ত্র ও গৃহের আসবাবপত্রাদি পর্যন্ত ক্রোক করে নেয়। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, অভাবীকে কেবল ঋণ দিলে হবেনা বরং তার আর্থিক অনটন যদি বেশী থাকে তাহলে তার নিকট কড়া তাগাদা করা যাবেনা, এমন কি ঋণ আদায়ের ক্ষমতা না থাকলে তাকে মাফ করে দিতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে- “ঋণ গ্রহিতা যদি অত্যধিক অনটন পীড়িত হয় তাহলে তার অবস্থা সচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত তাকে সুযোগ দাও, আর যদি তাকে মাফ করে দাও তাহলে তা হবে তোমাদের জন্য উত্তম। যদি তোমরা কিছু জ্ঞান রাখতে, তাহলে এর কল্যাণকারিতা উপলব্ধি করতে পারতে। ”
ধন-সম্পদ একস্থানে পুঞ্জীভূত ও জমাটবদ্ধ হয়ে থাকতে পারবে না; ইসলামী সমাজের যে কয়জন লোক তাদের উচ্চতর যোগ্যতা ও সৌভাগ্যের কারণে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ আহরণ করেছে ইসলাম চায় তারা যেন এ সম্পদ পুঞ্জীভূত করে না রাখে বরং এগুলো ব্যয় করে এবং এমন সব ক্ষেত্রে ব্যয় করে যেখান থেকে অর্থের আবর্তনের ফলে সমাজের স্বল্প বিত্ত ভোগীরাও যথেষ্ট অংশ লাভ করতে সক্ষম হবে। ইরশাদ হচ্ছে-“যাকাত তো কেবল ১. নিঃস্ব, ২. অভাবগ্রস্থ ৩. তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য,৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, ৫. দাসমুক্তির জন্য, ৬. ঋণ ভারাক্রান্তদের,৭. আল্লাহর পথে ও ৮. মুসাফিরের জন্য ।” আর কেউ যদি তার ব্যতিক্রম করে তবে তার যাকাত আদায় হবে না। তাই ইসলাম একদিকে উন্নত নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং উৎসাহ দান ও ভীতি প্রদর্শনের শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করে দানশীলতা ও যথার্থ পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগীতার প্রবণতা সৃষ্টি করে। ফলে মুসলিম বিত্তবানগণ নিজেদের মনের স্বাভাবিক ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকে খারাপ জানে এবং তা ব্যয় করতে উৎসাহী ও ও আগ্রহী হয়। অন্যদিকে ইসলাম এমন সব আইন প্রণয়ন করে, যার ফলে বদান্যতার এ শিক্ষা সত্তে¡ও নিজেদের অসৎ মনেবৃত্তির কারণে যেসব লোক সম্পদ আহরণ করতে ও পুঞ্জীভূত করে রাখতে অভ্যস্ত হয় অথবা যাদের নিকট কোনোভাবে সম্পদ সঞ্চিত হয়ে যায়, তাদের সম্পদ থেকে সমাজের কল্যাণ ও উন্নতি বিধানার্থে কমপক্ষে একটি অংশ অবশ্যই কেটে নেয়া হবে। আর একেই বলা হয় যাকাত। অর্থাৎ মালিকে নিসাব তথা রূপা ৬১২.২৫ গ্রাম (৫২.৫০ভরি) কিংবা স্বর্ণ ৮৭.৪৫ গ্রাম (৭.৫০ ভরি) অথবা স্বর্ণ বা রূপা যে কোন একটির নিসাবের মূল্য (১৫ এপ্রিল’২২ এর বাজার দর অনুপাতে বর্তমান রূপার মূল্য ১৫১৬/-*৫২.৫=৭৯৫৯০/-) পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বা ব্যবসায়িক সামগ্রী যদি কোন মুসলিম প্রাপ্ত বয়স্ক স্বাধীন ব্যক্তির মালিকানায় পূর্ণ একবছর থাকে, তবে তার উপর হাজারে ২৫ টাকা করে যাকাত আদায় করা ওয়াজিব। নামযের পরে এ যাকাতের ওপরই সবচেয়ে বেশী জোর দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনুল করিমের বত্রিশ জায়গায় যাকাতের কথা এসেছে এবং দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে- যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করে, যাকাত না দেয়া পর্যন্ত তার ঐ সম্পদ হালাল হতে পারেনা। ইরশাদ হচ্ছে -“(হে নবী!) তাদের ধন-সম্পদ থেকে একটি সাদকা গ্রহণ করুন, যা ঐ ধন-সম্পদকে পাক-পবিত্র ও হালাল করে দেবে।” উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিত্তশালী ব্যক্তির নিকট যে অর্থ সম্পদ সঞ্চিত হয় ইসলামের দৃষ্টিতে তা অপবিত্র এবং তার মালিক তা থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে একটি বিশেষ পরিমাণ আল্লাহর পথে ব্যয় না করা পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারেনা। অর্থাৎ বিত্তশালীদের সম্পদ ব্যয় করে জাতির দরিদ্র ও অভাবি লোকদেরকে সচ্ছল করার চেষ্টা করতে হবে এবং এমন সব কল্যাণমূলক কাজে এ সম্পদ নিয়োগ করতে হবে যা থেকে সমগ্র জাতি লাভবান হতে পারবে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দুর্বল, অসহায় ও নিঃস্বদের ওসিলাতেই সচ্ছ্বল মানুষরা (আল্লাহর) সাহায্য ও রিজিকপ্রাপ্ত হয়।’
আর এই ফান্ড থেকেই মুসলিম সমাজের বেকারদের সাহায্য করা হয়। তাদের অক্ষম, বিকলাঙ্গ, রুগ্ন, এতিম, বিধবা ও কর্মহীনদেরকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিপালন করা হয়। এর সহজ সরল নীতি হচ্ছে, আজ এক ব্যক্তি বিত্তবান কাজেই সে অন্যকে সাহায্য করবে, আগামীকাল যখন সে অভাবী হয়ে পড়বে তখন অন্যরা তাকে সাহায্য করবে। দরিদ্র হয়ে পড়লে আমার কি অবস্থা হবে। একথা চিন্তা করার আমার কোন প্রয়োজন নেই যে, মরে গেলে স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতিদের কি অবস্থা হবে? কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার কবলে পড়লে, পীড়িত হয়ে পড়লে ঘর-বাড়ীতে আগুন লেগে গেলে, বন্যা কবলিত হয়ে পড়লে, দেউলিয়া হয়ে গেলে তখন কি উপায় হবে? সফর অবস্থায় টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেলে জীবিকা নির্বাহের কি উপায় হবে? একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই এ সমস্ত চিন্তা থেকে মানুষকে চিরন্তন মুক্তি দান করে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী সমাজের সদস্যের কাজ কেবল এতটুকুই থাকে যে, সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদের একটি অংশ আল্লাহ তাআলার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে জমা দিয়ে বীমা করা নেবে। প্রকৃতপক্ষে এ সময় এ অর্থের তার কোন প্রয়োজন নেই। এ অর্থ এখন যাদের প্রকৃত প্রয়োজন তাদের কাজে লাগবে। কাল যখন তার বা তার সন্তান-সন্তুতিদের প্রয়োজন দেখা দেবে তখন কেবল তার নিজের প্রদত্ত সম্পদই নয় বরং তার চেয়েও অনেক বেশী সম্পদ ফেরত পাবে।
৫. মীরাসী আইন: নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনে অর্থ ব্যয়, আল্লাহর পথে ও যাকাত আদায় করার পরও যে অর্থ-সম্পদ কোন একস্থানে কেন্দ্রভূত হয়ে যাবে তাকে বিকেন্দ্রীভূত করার জন্য ইসলাম আর একটি পন্থা অবলম্বন করেছে- যাকে বলা হয় মীরাসী আইন। এ আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদ রেখে মৃত্যুবরণ করবে তা যত কম বা বেশী হোক না কেন, তা নিয়মানুযায়ী ক্ষুদ্রাংশে ভাগ করা হবে এবং নিকট-দূরের সকল আত্মীয়ের মধ্যে ক্রমানুসারে বন্টন করা হবে। যদি এমন কোন ব্যক্তি থাকে, যার কোনো ওয়ারিস নেই বলে তাকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করার অধিকার দানের পরিবর্তে তার সম্পদ মুসলমানদের বায়তুল মালে জমা করে দিতে হবে। তাহলে সমগ্র জাতি এ থেকে লাভবান হতে পারবে। মীরাস বণ্টনের এ আইনের অস্তিত্ব একমাত্র ইসলামেই দেখা যায়, অন্য কোন নীতিতে এর অস্তিত্ব নেই। অন্যান্য অর্থব্যবস্থা এ ব্যাপারে যে নীতি নির্ধারণ করেছে তা হচ্ছে, এক ব্যক্তি যে অর্থ সঞ্চিত করে রেখে যায় তার মৃত্যুর পর তা এক বা একাধিক ব্যক্তির নিকট কেন্দ্রীভূত থাকে। কিন্তু ইসলাম অর্থ কেন্দ্রীভূত করার পরিবর্তে তার বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষপাতি, এর ফলে অর্থের আবর্তন সহজতর হয়।
লেখক-
আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা।