প্রবন্ধ

ঈদুল ফিতরের দর্শন ও শিক্ষা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

ঈদ শব্দটি ‘আউদুন’ থেকে উদ্ভত। আওদুন অর্থ ফিরে আসা, পুনঃ পুনঃ আসা। ঈদ অর্থ খুশি, আনন্দ, আমোদ, উৎসব ইত্যাদি। মুসলমানদের জাতীয় জীবনে খুশি ও আনন্দের সওগাত নিয়ে ঈদ বারবার আসে। ঈদুল ফিতর অর্থ হলো, উপবাস ভঙ্গকরণের আনন্দ। সুদীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালনার্থে এ দিনটিতে রোজা ভঙ্গ করে মুসলমানগণ ঈদগাহে বা মসজিদে সমবেত হয়ে মহানন্দে যে দু’রাকাত নামায আদায় করে তা ঈদুল ফিতরের নামায। এ নামাযের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এতে আযান ও ইকামত নেই। প্রত্যেক জাতির আনন্দ উৎসবের দিন রয়েছে মুসলমানদের আনন্দ উৎসবের দু’টি দিনের মধ্যে ঈদুল ফিতর এক অনন্য মর্যাদায় ঐতিহ্যমন্ডিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, প্রত্যেক জাতির আনন্দ উৎসবের দিন রয়েছে। আর এ দিনটি আমাদের ঈদ। (বোখারী ও মুসলিম)

আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন: আপনার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলুন, এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজ্জের সময় ঠিক করার মাধ্যম। (সূরা: বাকারা: আয়াত: ১৮৯)।

 

ইসলামে চন্দ্র দর্শনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চাঁদ ইসলামের প্রতীক ও অন্যতম নিদর্শন। ইসলামী বর্ষ, মাস ও তারিখের হিসাব জানার অবলম্বন চাঁদ। চন্দ্র মাসের হিসাবই ইসলামে নির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সব ইবাদত রোজা, হজ¦, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, মহররম, আশুরা, শবে বরাত, শবে কদর, শবে মিরাজ, ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ অসংখ্য ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালন, উদযাপন চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং ‘রুইয়াতে-হেলাল’ তথা নতুন চাঁদ দেখার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং তদানুযায়ী ইসলামী দিবসসমূহ উদযাপনের গুরুত্ব অপরিহার্য। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীস শরীফ দ্বারা চাঁদ দেখে রোজা রাখা ও ঈদ করার নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোজা সমাপ্ত কর (ঈদ কর)। তোমাদের উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে শাবান মাসের দিন সংখ্যা ত্রিশ দিন পূর্ণ কর।’ (বোখারী শরীফ)।

 

চাঁদ দেখার বিষয়টিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চর্ম চোখে দেখার সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন।

 

ঈদুল ফিতর হচ্ছে মূলত দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা ও তারাবীহ সমাপ্তির শোকরিয়া তথা আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক মহিমান্বিত দিবস। ঈদুল ফিতরের শিক্ষা ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘যাতে তোমরা যেন রোজার সংখ্যা পূরণ করো এবং তোমাদের হেদায়ত দান করার দরুণ আল্লাহ তা’য়ালা মহত্ব বর্ণনা কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সূরা আল বাক্বারা, আয়াত: ১৮৫)। আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) কর্তৃক ‘নুরুল ইরফানে’ বর্ণিত হয়েছে, ঈদের দিবসে আল্লাহর মহানত্ব প্রকাশে তাকবীর বলা, ইবাদতে মনোযোগী হওয়া, শরীয়ত সম্মত আনন্দ উদযাপন করা, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের বহিঃপ্রকাশ। এ কৃতজ্ঞতা রমজান মাস বিদায়ের কারণে নয় বরং রমজান মাসে সিয়াম সাধনা, কুরআন তিলাওয়াত, ইবাদত বন্দেগী, তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, হালাল উপার্জন দ্বারা সেহেরী ইফতারী, দান-সাদকা ইত্যাদি করতে পারার কারণেই।

 

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে যে, হযরত জাবের ইবনে সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সাথে একবার নয় দুইবার নয় (অনেকবার) দুই ঈদে সালাত আদায় করেছি, আযান ও ইক্বামত ছাড়া। (মুসলিম)। এ নামাযের আরো অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো: খুতবার আগে এ নামায আদায় করা হয়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা দুই ঈদের সালাত খুতবার পূর্বে আদায় করতেন। (বুখারী ও মুসলিম)।

 

ঈদের দিন মুসলিম মিল্লাতের জন্য সার্বজনীন আনন্দ ও উৎসবের দিন। পরস্পর ভ্রাতৃত্ব ভালবাসার প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে এক অনুপম দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের অপূর্ব সম্মিলন ঈদুল ফিতর। এ দিন মুসলিম সমাজে বিভিন্নভাবে খুশি ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নতুন সুন্দর জামা কাপড় পরিধানে বন্ধু-বান্ধব, আপনজন, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন ও ঘনিষ্টজনদের মাঝে পোশাক পরিচ্ছদ ও উপহার সামগ্রী বিতরণ বৈচিত্র্যময় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন, সন্তানদের জন্য খেলাধুলা ও আনন্দ বিনোদন ও উপহার বণ্টনে উৎসব মুখর পরিবেশে নিজে আনন্দিত হওয়া ও অন্যজনকে আনন্দ দেয়া ইসলামের এক অনুপম শিক্ষা। ইসলাম পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ধনী-নির্ধন, আমীর-ফকিরের শুভেচ্ছা বিনিময়ের যে অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে, তা পৃথিবীর অন্যকোন ধর্মে পরিদৃষ্ট হয় না। ঈদুল ফিতরের নামাযের গুরুত্ব বর্ণনাতীত। ঈদ আসে সীমাহীন ভালোবাসা ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে। সেই ঈদকে যথার্থ মর্যাদায় উদ্যাপন করা, ঈদের পবিত্রতা রক্ষা করা, ঈদের নামায যথাযথভাবে আদায় করা, প্রত্যেক মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য। এ দিবসের আরো অসংখ্য ফজিলত হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যেমন- হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে রাস্তা পরিবর্তন করতেন। অর্থাৎ গমনের সময় এক রাস্তা এবং প্রত্যাবর্তনের সময় ভিন্ন ঈদের দিন মুসলমানদের পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় ইসলামের প্রাচীনতম ঐতিহ্য। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, তাবিয়ী হযরত জুবায়র ইবনে নুফায়র রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ ঈদের দিনে সাক্ষাৎ হলে একে অপরকে বলতেন আল্লাহ্ আমাদের ও আপনাদেরকে কবুল করুন।

 

ইসলামী শরীয়তে পবিত্র চেতনা সমৃদ্ধ আনন্দ উৎসবে বাধা নেই। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানদের জন্য ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপহার স্বরূপ। রুচিসম্মত শালীন পবিত্র ও উত্তমপন্থায় আনন্দ ফুর্তি ইসলামে অনুমোদিত। তবে ঈদের আনন্দের নামে নগ্নতা, অশ্লীলতা, কুরুচিপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আপত্তিকর সাজসজ্জা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, যুবক-যুবতীদের লাগামহীন উম্মাদনা কোনোভাবেই ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের খুশি আনন্দ ইসলাম কোনভাবেই সমর্থন করে না। এবার কিন্তু বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারি আক্রান্তের ভয়াবহতায় সমাজ চিত্রে কিছুটা ব্যাতীক্রম হওয়ার আশা করা যায়। বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে মুসলিম ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। অপসংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আদর্শ ও ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। এ পাশবিক প্রবৃত্তি অবদমিত করে মানবিকতা জাগ্রত করতে পারলেই প্রকৃত ঈদের আনন্দ প্রতিষ্ঠিত হবে।