ইমাম হুসাইন জয়ী, বিজয় হুসাইনীদের জন্যই | সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
“কাতলে হুসাইন আসল মে মারগে ইয়াজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কে বাদ”
অর্থাৎ, ইমাম হুসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে ইয়াজিদেরই মৃত্যু ঘটেছে; ইসলাম প্রতিটি কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়। মুখে মুখে সমাদৃত এ সত্য উক্তি কারবালার দর্শনকে শানিত করে। মোহাম্মদ আলী জওহারের এ পংক্তিটি বিজয়ী ও পরাজিত শক্তিকে এড্রেস করে দেয়। পরিস্কার জানিয়ে দেয় ইমাম হুসাইনই (রা.) বিজয়ী। বিজয়ী হুসাইনের অগ্রজ ইমাম হাসান (রা.)। বিজয় হুসাইনের গর্বিত পিতা বেলায়তের সূর্য মওলা আলী (রা.)’র। সফলতার সৃষ্টি হুসাইনের রত্নগর্ভা জননী খাতুনে জান্নাত মা-ফাতেমা (রা.)’র জন্য। বিজয় হুসাইনের নানিজান আল্লাহর সালাম পাওয়া সৌভাগ্যবতী খাদিজাতুল কোবরা (রা.)’র। বিজয় ধ্বনি হুসাইনের নানাজান ইমামুল আম্বিয়া নূর নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দ.)’র দান। বিজয় হুসাইন খান্দানের। বিজয়ের সৃষ্টিই হুসাইনের সাওয়ারি মদিনার মুনিবের কদমে পাক থেকে। বিজয় শুধু ৬১ হিজরি সনে নয়। এ বিজয়ের সূচনা নীলগগন সৃষ্টির আগে। মালিকে হাকিকি মহান আল্লাহ জীব সৃষ্টির বহুকাল আগে সযত্নে নূরে মুহাম্মদি (দ.)-কে সৃষ্টি করে বিজয়ের বার্তা দিয়েছেন; অসত্য যত প্রখর হবে সত্যের সূর্যোদয় তত করিব হবে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে তিমিরাছন্ন মক্কা নগরী মোনাওয়ার করে এ বিজনে সৃষ্টিমূল নূরে মোস্তাফা (দ.)’র আগমন মূলত মিথ্যার তিমির বিনাশী সত্যের নূর বিচ্ছুরণ। সমস্তপ্রকার সৃষ্টির মূলভিত্তি রহমতের কামেলার শুভাগমন। তাই তো মুমিন আত্মা গেয়ে উঠে ‘মোস্তফা জানে রহমাত পে লাখোঁ সালাম’।
ইমাম হুসাইন একটি বিপ্লবের নাম। একটি সফল আন্দোলনের নাম। যে আন্দোলন একষট্টি হিজরির ১০ই মুহররম কারবালার প্রান্তর (ইরাকের ফোরাত প্রান্তর) থেকে চূড়ান্তভাবে শুরু হয়ে চলমান আছে আজ অবধি। চলবে কিয়ামততক। দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, মাদক, দর্শন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইমাম হুসাইন নিসন্দেহে তেজোদীপ্ত প্রেরণা। অভিশপ্ত ইয়াজিদের হাতে বায়াতের (আনুগত্য) অফার অগ্রাহ্য করে তার দুঃশাসন, স্বৈরাচারনীতি, অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড, ব্যভিচার, ঘৃণিত পদক্ষেপ ও গর্হিত অপরাধের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নাম ইমাম হুসাইন। ইমাম হুসাইন একটি সাহসিকতার নাম। যে সাহসের কাছে ২২ হাজার সশস্ত্র জাহান্নামি ইয়াজিদী সৈন্য ভয়ে তরতর। ইমামে হুসাইন ধৈর্যের ইস্পাত-দৃঢ় সুউচ্চ মিনারের নাম। ইমাম হুসাইন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান পাঠ ধৈর্যের অনুশীলন। ধৈর্যের গুরুত্বারোপ করে সুরা বাকারার ১৫৩ নং আয়াতে আল্লাহর ঘোষণা- ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আ-মানুছতা’ঈনূ বিসসাবরি ওয়াসসালা-তি; ইন্নাল্লা-হা মা’আসসাবিরীন। ধৈর্যই ইমাম হুসাইনের প্রধান ভূষণ। সে ধৈর্যের পাহাড়ের সামনে খোদার দ্বীন বাঁচাতে নিজের শক্তি আব্বাস আলমদারের দুই হাত কর্তিত নিথর দেহ; নিজের বুকের ধন আলী আকবরের রক্তাক্ত নিশ্চুপ শরীর; আদরের ভাই, স্নেহের ভাতিজা ও ভাগিনাদের রক্তস্নাত নিস্তব্ধ জিসিম; নবীবাগের নিষ্পাপ গোলাপ ছয়মাসের শিশু আলী আজগরের বিষাক্ত তীর বিদ্ধ নিষ্প্রাণ নূরানী শরীর; কন্যা সৈয়দা সকিনার তৃষ্ণার্ত শুকনো মুখ; স্ত্রী শাহরবানুর সন্তান হারানো বোবাকান্না; বোন জয়নাবের শোকাভিভূত চেহেরা; হুসাইন শিবিরে স্বজনহারানো গগনবিদারী আর্তনাদ ইমাম হুসাইনের সবরের পর্দায় একটুও আঘাত হানতে পারেনি। ফোরাতের পানি বন্ধ, পানির জন্য হাহাকার হৃদয়ে প্রশান্তির ফোয়ারা ইমাম হুসাইন। তৃষ্ণার্ত প্রাণে একটাই ভরসা নানাজান রহমাতুল্লিল আলামীন অমিয়সুধা হাউজে কাউসার নিয়ে অপেক্ষায় আছেন! একে একে ৭১টি তাজাপ্রাণের নিরুত্তাপ দেহ ইমামের কাঁদে উঠেছে। এ করুন দৃশ্য অন্তরকে ভেঙে চুরমার করে দিলেও ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান ইমামে হুসাইন একটুও সাহস হারাননি। রক্তস্নাত ফোরাততীর সেদিন হু হু করে কেঁদেছিল নবী বংশের পবিত্র রক্ত বুকে মেখে। আকাশ বাতাস বৃক্ষলতা হুসাইন শোকে মাতম করেছিল সেদিন। এ করুন দৃশ্য নাড়া দিয়েছে ইতিহাসবিদ গিবনের জ্ঞানে। তাই তিনি বলেছে, In a distant age and climate the tragic scene of the death of Husayn will awaken the sympathy of the coldest reader. অর্থাৎ “সেই দূরবর্তী যুগে ও পরিবেশে ইমাম হুসাইনের মৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের হৃদয়ে, সমবেদনার সঞ্চার করবে।”
ইমাম হুসাইন একটি প্রেরণার নাম। ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়েও শান্তির বার্তা দিতে শেখায়। ইতিহাসবিদ ইবনে জারির তাবারির মতে, রক্তপাত বন্ধের দৃঢ় হৃদয়ে ইমাম হুসাইন ইয়াজিদ বাহিনীকে অসাধারণ তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন। ইমামকে মদিনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক কিংবা পাশ্ববর্তী যেকোনো সীমান্তে যেতে দেয়া হোক অথবা ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্য তাকে দামেস্কে পাঠানো হোক। তার সাথে তিনি (ইমাম) বোঝাপড়া করে নেবেন। এতে সারা মিল্লাতের কল্যাণ নিহিত। কিন্তু ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে নির্লজ্জ আদেশ দেয়। সত্যের জিবন্ত উদাহরণ ইমাম হুসাইন ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম মুর বলেন, Well had it been for the Umayyad house, if the prayer had been agreed to. অর্থাৎ “ইমাম হুসাইনের সংলাপের এ অনুরোধ যদি মেনে নেয়া হতো, উমাইয়াদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনত।”
তাই ‘হুসাইন’ নামের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মুসলিম বিশ্বের প্রায় ব্যক্তির নামের আগে পরে ‘হুসাইন’ শব্দের অলঙ্করণযুক্ত। ইমাম হুসাইনের বিজয় আজও চলমান। মুসলিম প্রাণের রাজপ্রাসাদে ইমাম হুসাইনেরই বসবাস। পক্ষান্তরে ক্ষমতা দখলের সাড়ে তিন বছরের মাথায় বুজুর্গ পিতা আমিরে মোয়াবিয়া (রা.)’র অসিয়ত অমান্যকারী ইয়াজিদের ভাগ্যে করুন পরিনতি নেমে আসে। মাত্র অর্ধশত বছরের মধ্যেই নবী পরিবারকে কষ্ট দিয়ে উল্লাস করা নরপিশাচদের মর্মান্তিক মৃত্যুর স্বাক্ষী হয়েছিল সৃষ্টিকুল। সীমালঙ্ঘনকারী ইয়াজিদের কবর অযত্নে পড়ে আছে সিরিয়ার এক কবরস্থানে। কুফার সেই লোভী গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদেরও হয়েছিল মর্মান্তিক মৃত্যু। তার মস্তকও করা হয়েছে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন। তার আলোকিত রাজপ্রাসাদও কালের আবর্তে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। আর ইমাম হুসাইন ও কারবালার শহীদগণ আমাদের স্মৃতির ক্যাম্পাসে চির অমলিন। আমাদের হৃদয়ের আকাশে ধ্রুবতারা।
চিরকাল হুসাইনী শক্তির কাছে ইয়াজিদী পরাশক্তি বধ হবেই। হায়দারী হাক শয়তানি ডাককে পরাভূত করবেই। সর্বজয়ী ইমাম হুসাইন শঙ্কিত আত্মায় প্রশান্তির আবেহায়াত। সত্য, সভ্য ও সুন্দরের জয় মানে হুসাইনের জয়। কারণ সত্য, সভ্য ও সুন্দরের বাস্তব সংজ্ঞা ইমামে হুসাইন। দুনিয়াবাসীর স্থীর বিশ্বাস ন্যায় ও ত্যাগের সুউচ্চ মিনার নন্দিত ইমাম হুসাইন। আর শয়তানের আপডেট ভার্সন হলো নিন্দিত ইয়াজিদ।