আদর্শিক স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
আবাসগৃহ হচ্ছে এমন একটি ছোট্ট রাষ্ট্র, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার মৌলিক উপাদান তথা স্বামী, স্ত্রী, পিতা ও মাতা এবং সন্তান-সন্তুতি অন্তর্ভুক্ত করে; যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত নিয়ামতরাজির মধ্যে অন্যতম। ইরশাদ হচ্ছে : “আর আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেন তোমাদের আবাসস্থল।” – (সূরা নাহল, আয়াত: ৮০) আর এই ঘরের মর্যাদার কারণে ইসলাম তার বিষয় ও কার্যক্রমসমূহকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়েছে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহকে তার মৌলিক উপাদান অনুযায়ী বণ্টন করেছে; বিশেষত স্বামী-স্ত্রীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি।
আর বিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে একটি সুদৃঢ় বন্ধন। যা স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই পারস্পরিক অধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই অধিকারগুলো হচ্ছে শারীরিক অধিকার, সামাজিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক অধিকার। এ কারণেই স্বামী-স্ত্রী উভয়ের এটা অবশ্য কর্তব্য যে, তারা সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবন যাপন করবে এবং কোনো প্রকার মানসিক অসন্তুষ্টি ও দ্বিধা ব্যাতিরেকেই তাদের যা কিছু আছে একে অন্যের জন্য অকাতরে ব্যয় করবে! আলোচ্য নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।
وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَىٰ بَعْضُكُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنكُم مِّيثَاقًا غَلِيظًا
অর্থাৎ ‘তোমরা কীভাবে তা (মোহরানা) ফেরত নিবে ? অথচ তোমরা পরস্পর শয়ন সঙ্গী হয়েছ এবং তোমাদের নিকট সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে।’ [সূরা নিসা, আয়াত : ২১] এ চুক্তিপত্র ও মোহরানার কারণে ইসলাম স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মাঝে কিছু দায়দায়িত্ব ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। যা বাস্তবায়নের ফলে দাম্পত্য জীবন সুখী ও স্থায়ী হয়। শরী‘আত এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি নজর দেয়, যাতে উভয় গৃহকর্তা তাদের কল্যাণকর সীমারেখার মধ্যে ব্যাপক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে দায়বদ্ধ থাকে। পবিত্র কোরআনুল করীমে ইরশাদ হচ্ছে :
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ، وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ ، وَاللّهُ عَزِيزٌ حَكُيمٌ
অর্থাৎ ‘যেমন নারীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমন তাদের জন্যও অধিকার রয়েছে ন্যায্য- যুক্তি সংগত ও নীতি অনুসারে। তবে (আনুগত্য এবং রক্ষনা-বেক্ষন ও অভিভাবকত্বের বিবেচনায়) নারীদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব পুরুষদের। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা বাকারা, আয়াত : ২২৭] আর তা স্তর ও মানের ভিত্তিতে তিন প্রকার। প্রথমত: স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সমান। যেমন-
১.দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক সততা, বিশ্বস্ততা ও সদ্ভাব প্রদর্শন করা: যাদের মাঝে নিবিড় বন্ধুত্ব, অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক, অধিক মেলামেশা, সবচেয়ে বেশি আদান-প্রদান তারাই স্বামী এবং স্ত্রী। এ সম্পর্কের চিরস্থায়ী রূপ দিতে হলে ভাল চরিত্র, পরস্পর সম্মান, নম্র-ভাব, হাসি-কৌতুক এবং অহরহ ঘটে যাওয়া ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা এবং এমন সব কাজ, কথা ও ব্যবহার পরিত্যাগ করা অবশ্যম্ভাবী , যা উভয়ের সম্পর্কে চির ধরে কিংবা মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। তাই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
অর্থাৎ ‘তাদের সাথে তোমরা সদ্ভাবে আচরণ কর।’ [সূরা নিসা, আয়াত : ১৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي
‘অর্থাৎ তোমাদের মাঝে যে নিজের পরিবারের কাছে ভাল, সেই সর্বোত্তম। আমি আমার পরিবারের কাছে ভাল।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ১৯৬৭]
অন্যত্র ইরশাদ করেন ,
ما أكرَمَ النساءَ إلَّا كريمٌ ، ولَا أهانَهُنَّ إِلَّا لئيمٌ
অর্থাৎ ‘শুধুমাত্র সম্মানিত লোকেরাই নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে। আর যারা অসম্মানিত, নারীদের প্রতি তাদের আচরণও হয় অসম্মানজনক।” (জামে তিরমিযী)
২.পরস্পর একে অপরকে উপভোগ করা:
এর জন্য আনুষঙ্গিক যাবতীয় প্রস্তুতি ও সকল উপকরণ গ্রহণ করা। যেমন সাজগোজ, সুগন্ধি ব্যবহার এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ দুর্গন্ধ ও ময়লা কাপড় পরিহার ইত্যাদি। অধিকন্তু এগুলো সদ্ভাবে জীবন যাপনেরও অংশ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা বলেন-
إني لأحب أن اتزين للمرأة کما أحب أن تتزين لي
অর্থাৎ আমি যেমন আমার জন্য স্ত্রীর সাজগোজ কামনা করি, অনুরূপ তার জন্য আমার নিজের সাজগোজও পছন্দ করি।’
তবে পরস্পর এ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উভয়কেই হারাম সম্পর্ক ও নিষিদ্ধ বস্তু হতে বিরত থাকতে হবে।
৩.বৈবাহিক সম্পর্কের গোপনীয়তা রক্ষা করা: সাংসারিক সমস্যা নিয়ে অন্যদের সাথে আলোচনা না করাই শ্রেয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে উপভোগ্য বিষয়গুলো গোপন করা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন –
إن من أشر الناس عند الله يوم القيامة الرجل يقضي إلی إمراته وتقضي إلیه ثم ینشر سرها
অর্থাৎ ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে সে ব্যক্তিই সর্ব নিকৃষ্ট, যে নিজের স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার পর এর গোপনীয়তা প্রকাশ করে বেড়ায়।‘ [সহিহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৯৭]
৪.পরস্পর শুভ কামনা করা, সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়া: আল্লাহর আনুগত্য এবং দাম্পত্য জীবন রক্ষা করা উভয়েরই কর্তব্য। আর পরস্পর নিজ আত্মীয়দের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করাও এর অন্তর্ভুক্ত । ইরশাদ হচ্ছে – تعاونوا علی البر والتقوی
অর্থাৎ ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ব্যপারে পরস্পরকে সহযোগিতা কর।’ [সূরা মায়েদা, আয়াত : ২]
৫. সন্তানদের লালন-পালন ও সুশিক্ষার ব্যাপারে উভয়েই সমান, একে অপরের সহযোগী:
১. স্বামীর আনুগত্য: স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর কর্তব্য। তবে যে কোন আনুগত্যই নয়, বরং যেসব ক্ষেত্রে আনুগত্যের নিম্ন বর্ণিত তিন শর্ত বিদ্যমান থাকবে।
(ক) ভাল ও সৎ কাজ এবং আল্লাহর বিধান বিরোধী নয় এমন সকল বিষয়ে স্বামীর আনুগত্য করা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِغَيْرِ اللَّهِ ، لَأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا
অর্থাৎ “যদি আমি কোনো মানুষ অপর কারও জন্য সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তবে মহিলাকে তার স্বামীকে সিজদা করতে নির্দেশ দিতাম।” সুনানে [ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৮৫৩; জামে তিরমিযি, হাদীস : ১১৫৯]
তবে শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াবলীতে স্বামীর আনুগত্য করবে না। বরং স্বামীকে বুঝানো চেষ্টা করবে। ইরশাদ হচ্ছে –
لاطاعة لمخلوق في معصیة الخالق
অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন সৃষ্টির আনুগত্য বৈধ নয়।
لا يکلف الله نفسا إلا وسعها
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার সাধ্যের বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্বারোপ করেন না। অন্য হাদীসে এসেছে,
إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَلَمْ تَأْتِهِ فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا لَعَنَتْهَا الْمَلَائِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ
যদি কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে তার সাথে শয্যাশায়ী হতে আহ্বান জানায় এবং যদি উক্ত স্ত্রী তা অস্বীকার করে এবং স্বামী তার ওপর রাগাম্বিত অবস্থায় রাত কাটায়, তাহলে সকাল পর্যন্ত ফিরিশতাগণ তার ওপর অভিশম্পাত বর্ষণ করেন’। [বুখারি, ৩২৩৭]
(গ) যে নির্দেশ কিংবা চাহিদা পূরণে কোন ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, সে ব্যাপারে স্বামীর আনুগত্য করা আবশ্যক করে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন – وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ
অর্থাৎ ‘নারীদের উপর পুরুষগণ শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী।’ [সূরা বাকারা, আয়াত : ২২৭] অন্যত্র ইরশাদ করেন –
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ
অর্থাৎ “পুরুষগণ মহিলাদের অভিভাবক এবং দায়িত্বশীল। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তাআলা তাদের একের ওপর অন্যদের বিশিষ্টতা দান করেছেন এবং যেহেতু পুরুষগণ তাদের সম্পদ থেকে তাদের স্ত্রীদের জন্য ব্যয় করে থাকে।” [সূরা নিসা, আয়াত : ৩৪] উপরন্তু এ আনুগত্যের দ্বারা বৈবাহিক জীবন স্থায়িত্ব পায়, পরিবার চলে সঠিক পথে। আর স্বামীর কর্তব্য, এ সকল অধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে আল্লাহর বিধানের অনুসরণ করা। স্ত্রীর মননশীলতা ও পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে সত্য- কল্যাণ ও উত্তম চরিত্রের উপদেশ প্রদান করা কিংবা হিতাহিত বিবেচনায় বারণ করা। এক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ ও উন্নত মননশীলতার পরিচয় দেয়া । ফলে সানন্দ চিত্তে ও স্বাগ্রহে স্ত্রীর আনুগত্য পেয়ে যাবে।
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
‘তোমরা স্ব স্ব গৃহে অবস্থান কর, প্রাচীন যুগের সৌন্দর্য প্রদর্শনের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না। ’ [সূরা আহযাব,আয়াত : ৩৩]
স্ত্রীর উপকার নিহিত এবং যেখানে তারও কোন ক্ষতি নেই, এ ধরনের কাজে স্বামীর বাধা সৃষ্টি না করা। যেমন পর্দার সাথে, সুগন্ধি ও সৌন্দর্য প্রদর্শন পরিহার করে বাইরে কোথাও যেতে চাইলে বারণ না করা।
৩. নিজের ঘর এবং সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখা: স্বামীর সম্পদ সংরক্ষণ করা। স্বামীর সাধ্য নেই এমন কোন আবদার কিছু না করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ
অর্থাৎ ‘স্ত্রী স্বীয় স্বামীর ঘর ও সন্তানের জিম্মাদার। এ জিম্মাদারির ব্যাপারে তাকে জবাবদেহিতার সম্মুখীন করা হবে।’ [সহিহ বুখারী,হাদীস: ২৫৪৬]
المرأة إذا صلت خمسها وصامت شهرها واحصنت فرجها واطاعت بعلهادخلت من أبواب الجنة شاءت
অর্থাৎ ‘যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রমজান মাসের রোজা রাখে, নিজের লজ্জাস্থান হেফাজত করে এবং স্বীয় স্বামীর আনুগত্য করে, সে,নিজের ইচ্ছানুযায়ী জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবে।‘ [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৫৭৩]
৫. স্বামীর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করা: স্বামীর অনুমতি ব্যতীত নফল রোজা না রাখা। কেননা, রোজা নফল—আনুগত্য ফরজ। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন –
لاَ يَحلُّ لامْرَأَةٍ أَنْ تَصُومَ وَزَوْجُهَا شَاهِدٌ إِلا بِإِذْنِهِ ولا تأذن في بیته إِلا بِإِذْنِهِ
অর্থাৎ ‘নারীর জন্য স্বামীর উপস্থিতিতে অনুমতি ছাড়া রোজা রাখা বৈধ নয়। অনুরূপ ভাবে অনুমতি ব্যতীত তার ঘরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়াও বৈধ নয়।‘ [সহিহ বুখারী, হাদীস : ৪৭৬৯] অন্যত্র হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন –
أَنْ لا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُونَهُ
অর্থাৎ ‘তোমাদের অপছন্দনীয় কাউকে বিছানায় জায়গা না দেয়া স্ত্রীদের কর্তব্য।’ [সহিহ মুসলিম, হাদীস : ২১৩৭]
১. দেন মোহর: নারীর দেন মোহর পরিশোধ করা ফরজ। এ হক তার নিজের, পিতা-মাতা কিংংবা অন্য কারো নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً ۚ
অর্থাৎ ‘তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে স্ত্রীদের মোহরানা দিয়ে দাও।’ [সূরা নিসা, আয়াত : ৪]
২. ভরণ পোষণ: সামর্থ্য ও প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী স্ত্রীর ভরন-পোষণ করা স্বামীর কর্তব্য। স্বামীর সাধ্য ও স্ত্রীর মর্তবার ভিত্তিতে এ ভরন-পোষণ কম বেশি হতে পারে।অনুরূপ ভাবে সময় ও স্থান ভেদে এর মাঝে তারতম্য হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন –
لِيُنفِقْ ذُو سَعَةٍ مِّن سَعَتِهِ ۖ وَمَن قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ ۚ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا ۚ سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا
অর্থাৎ ‘বিত্তশালী স্বীয় বিত্তানুযায়ী ব্যয় করবে। আর যে সীমিত সম্পদের মালিক সে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত সম্পদ হতেই ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে পরিমাণ দিয়েছেন, তারচেয়ে’ বেশি ব্যয় করার আদেশ কাউকে প্রদান করেন না।‘ [সূরা তালাক, আয়াত : ৭]
وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا، فَإِنَّهُنَّ خُلِقْنَ مِنْ ضِلَعٍ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلَعِ أَعْلَاهُ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ، فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا
অর্থাৎ ‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী। কারণ, তারা পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্ট। পাঁজরের উপরের হাড়টি সবচে’ বেশি বাঁকা। (যে হাড় দিয়ে নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে) তুমি একে সোজা করতে চাইলে, ভেঙে ফেলবে। আবার এ অবস্থায় রেখে দিলে, বাঁকা হয়েই থাকবে। তাই তোমরা তাদের কল্যাণকামী হও, এবং তাদের ব্যাপারে সৎ-উপদেশ গ্রহণ কর।’ [সহিহ বুখারি, হাদীস: ৩৩৩১; সহিহ মুসলিম, হাদীস:১৪৬৮]
৪. স্ত্রীর ব্যাপারে আত্মমর্যাদাশীল হওয়া: হাতে ধরে ধরে তাদেরকে হেফাজত ও সুপথে পরিচালিত করা। কারণ, তারা সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল, স্বামীর যে কোন উদাসীনতায় নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ কারণে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীর ফেতনা হতে খুব যত্ন সহকারে সতর্ক করে ইরশাদ করেন-
ما ترکت بعدي فتنة أضر علی الرجال من النساء
‘আমার অবর্তমানে পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর কোন ফেতনা রেখে আসিনি।’ [সহিহ বুখারী, হাদীস :৪৭০৬]
নারীদের ব্যাপারে আত্মম্ভরিতার প্রতি লক্ষ্য করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করেছেন -যার মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ নেই সে দাইয়ূছ (অসতী নারীর স্বামী, যে নিজ স্ত্রীর অপকর্ম সহ্য করে)। ইরশাদ করেন –
لا يدخل الجنة دیوث
অর্থাৎ ‘দাইয়ূছ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ [সুনানে দারামি,হাদীস : ৩৩৯৭]
৬. ভালো কাজের প্রতি উদ্ভূত করা।
৭. যাদের সঙ্গে দেখা দেয়ার ব্যাপারে ইসলামের অনুমতি রয়েছে, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগ প্রদান করা।
৮. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদ প্রদান করা।
৯. কোনো প্রকার ভুল বা অসাবধানতা হলে ধৈর্য ধারণ করা।
১০. শাসন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা।
১১. ইসলামি শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে স্ত্রীর মন জয় করা।
১২. একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে সমতা বজায় রাখা।
১৩. নির্যাতন না করা। যারা তাদের স্ত্রীর কাছে উৎকৃষ্ট। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে তারাই উৎকৃষ্ট, যারা তাদের স্ত্রীর কাছে উৎকৃষ্ট এবং আপন পরিবার-পরিজনের প্রতি স্নেনশীল। [তিরমিজি শরিফ] অপর এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণ করবে, মহান আল্লাহ তাকে হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের সমান ‘সওয়াব’ দান করবেন। স্ত্রীর সঙ্গে সুন্দর ও ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের আপন করে নিতে হবে। স্বামীর কাছ থেকে যখন কোনো স্ত্রী ভালোবাসা পাবে, তখন সে তার সবটুকু স্বামীর জন্য উজাড় করে দিবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর উভয়ে যখন একে অপরের দিকে ভালোবাসার নজরে তাকাবে, মহান আল্লাহ তাদের দিকে রহমতের নজরে তাকাবেন।’
পরিশেষে নির্ঘাত বাস্তবতার কথা স্বীকার করে বলতে হয়, কোন পরিবার সমস্যাহীন কিংবা মতবিরোধ মুক্ত নয়। এটাই মানুষের প্রকৃতি ও মজ্জাগত স্বভাব। জ্ঞানী-গুণীজনের স্বভাব ভেবে-চিন্তে কাজ করা, ত্বরা প্রবণতা পরিহার করা, ক্রোধ ও প্রবৃত্তিকে সংযমশীলতার সাথে মোকাবিলা করা।কারণ, তারা জানে যে কোন মুহূর্তে ক্রোধ ও শয়তানের প্ররোচনায় আত্মমর্যাদার ছদ্মাবরণে মারাত্মক ও কঠিন গুনাহ হয়ে যেতে পারে। যার পরিণতি অনুসূচনা বৈকি? আবার এমনও নয় যে, আল্লাহ তাআলা সমস্ত কল্যাণ ও সুপথ বান্দার নখদর্পে করে দিয়েছেন। তবে অবশ্যই তাকে মেধা, কৌশল ও বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
“কোন মুমিন পুরুষ যেন কোন মুমিন স্ত্রীকে তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা না করে। তার আচার-আচরনের কোনো একটি অপছন্দনীয় হলেও অন্যটি সন্তোষজনক হতে পারে।” [সহিহ মুসলিম, হাদীস:১৪৬৯] অন্যত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ خُلُقًا “পূর্ণ ঈমানদার সেই ব্যক্তি যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।” (জামে তিরমিযী, হাদীস: ১১৬২)