ইসলামে কুরবানীর বিধান ও ফযীলত
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
হে মানবমণ্ডলি!
আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করুন! কুরবানীর পশু জবেহের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করুন। কেননা কুরবানী হলো আমাদের পিতা ইবরাহীম (আ:)’র সুন্নত, যাঁর মিল্লাতের অনুসরণ করতে আমরা আদিষ্ট। কুরবানী আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরও সুন্নাত। সুতরাং কুরবানী আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহর সুন্নাত ও ওলামায়ে মিল্লাতে ইসলামিয়ার ঐক্যমতের ভিত্তিতে শরীয়ত সম্মত উত্তম ইবাদত।
কুরবানী হযরত ইবরাহীম (আ:)’র আত্মত্যাগের স্মৃতিবহ স্মারক, ঈদুল আযহার দিনে অন্যতম প্রধান ইবাদত হলো, আল্লাহর নামে কুরবানী করা। কুরবানী শব্দের অর্থ নৈকট্য লাভ, ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ পাকের রেজামন্দি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু যবেহ করাকে কুরবানী বলা হয়। কুরবানীর তাৎপর্য হলো প্রিয় বস্তু আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের কুরবানীর অবিস্মরণীয় ঘটনাকে জীবন্ত করে রাখার জন্যই মহান আল্লাহ পাক উম্মতে মোহাম্মদীর উপর কুরবানীর বিধান ওয়াজিব করে দিয়েছেন। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানী হযরত আদম আলায়হিম সালাম’র দুই পুত্র হাবিল ও কাবীল’র কুরবানী। দুজনই কুরবানী দিল, আল্লাহ তা’য়ালা হাবীলের কুরবানী কবুল করলেন, হাবীলের যে দুম্বাটি আল্লাহ কবুল করেছিলেন, সেটিকে আল্লাহর হুকুমে হযরত ইসমাঈল (আ:)’র বদলায় কুরবানী দেয়া হয়। ইব্রাহীম (আ:) কে ঈমানের কঠিন পরীক্ষায় শতভাগ সাফল্য দান করে হযরত ইসমাঈল (আ:)’র পরিবর্তে এ দুব্বাটি আল্লাহ তা’য়ালা কুরবানী হিসেবে কবুল করেন।
আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের চতুস্পদ জন্তু ও মাংসের দিকে দেখেন না। তিনি বান্দার অন্তরের নিষ্ঠা, বিশুদ্ধতা দেখেন। কেবল মাংস ভক্ষণ ও পশু জবেহ করার মাধ্যমে রক্তপাত করার নাম কুরবানী নয়, বরং আল্লাহর রাস্তায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তত থাকার মানসিকতা লালন করা এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে ইসলামের বিধানের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শন করাই কুরবানীর মূল শিক্ষা। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহর নিকট পৌছায় না এর গোশত ও রক্ত, পৌছায় তোমাদের তাক্বওয়া।” (সূরা: হাজ্ব, আয়াত: ২২, ৩৭)
হাদীস শরীফের আলোকে কুরবানীর ফযীলত:
কুরবানীতে গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনায় অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে। হযরত যায়িদ ইবন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ কুরবানী কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ:)’র সুন্নত, তাঁরা আবার বললেন, এতে আমাদের কি কল্যাণ নিহিত আছে? তিনি বললেন, এর প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে, তাঁরা পূনরায় জিজ্ঞেস করলেন, বকরীর পশমেও কি তাই? জবাবে নবীজি বললেন, বকরীর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি রয়েছে। (ইবনে মাযাহ ২য় খন্ড, পৃ: ২২৬, তিরমিযী ও মিশকাত শরীফ)
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্বেও কুরবানী করেনা, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (ইবনে মাযাহ শরীফ)
উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা হতে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আদম সন্তান কোরবানীর দিন কুরবানীর চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় কোন আমল করেনা। কিয়ামতের দিবসে আল্লাহ তায়ালা কুরবানীর পশুকে তার শিং ক্ষুর ও পশম সমূহসহ উপস্থিত করবেন, কুরবানীর পশুর রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার পুর্বেই আল্লাহর নিকট কুরবানী কবুল হয়। অতএব তোমরা খুশীমনে কুরবানী করো। (ইবনে মাযাহ শরীফ, হাদীস নং ৩১২৬)
মালিকে নিসাব অর্থাৎ যতটুকু সম্পদের মালিক হলে সাদক্বাহ-ই ফিতর ওয়াজিব হয়। ততটুকু সম্পদের মালিক হলেই তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। অর্থাৎ ঋন ব্যতীত যার নিকট মৌলিক জিনিষপত্র তথা প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া সাড়ে সাতভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা থাকবে অথবা সে পরিমান অর্থ থাকবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। (আলমগীরি ৫ম খন্ড)
মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। মুসাফির কুরবানী করলে তা নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। (বাহারে শরীয়ত)
•মুসলমান হওয়া। অমুসলিমের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
•মুক্বীম হওয়া। কাজেই মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
•আযাদ বা স্বাধীন হওয়া, ক্রীতদাস দাসীর উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। (বাহারে শরীয়ত)
•গরু কুরবানীতে কাউকে শরীক করলে মাংস ওজন করে বণ্টন করাই বাঞ্চনীয়, অনুমান করে নয়। হতে পারে কেউ বেশী বা কেউ কম পাবে। তা নাজায়েজ। (বাহারে শরীয়ত)
কুরবানীর সময় কাল ১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদিকের পর হতে ১২ যিলহজ্বের সুর্যাস্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ তিনদিন দুই রাত্রি ওই দিন গুলোকে “আইয়্যামে নাহর” বা কুরবানীর দিবস বলা হয়। ১১ জিলহজ্ব হতে ১৩ যিলহজ্ব পর্যন্ত তিনদিনকে আইয়্যামে তাশরীক বলা হয়। (বাহারে শরীয়ত)
ঈদুল আযহার নামাযের পূর্বে কুরবানী করা দুরস্ত নয়। যে সব স্থানে ঈদের নামায ও জুমার নামায হয়। সে সব স্থানে ঈদের নামায ও খোতবার পর কুরবানী করা উত্তম। তবে নামায হয়েছে এখনো খোৎবা হয়নি এমতাবস্থায় কুরবানী করলে হয়ে যাবে তবে এরূপ করা মাকরুহ। (বাহারে শরীয়ত)
চামড়ার বিধান:
কুরবানীর চামড়া দান করে দিবে, ইচ্ছা করলে নিজেও ব্যবহার করতে পারবে, বিক্রি করলে তার মূল্য গরীব মিসকীনকে দান করে দিতে হবে। (বাহারে শরীয়ত)
পশু যবেহ করার বিধান:
কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করা মুস্তাহাব। নিজে করতে না পারলে অন্যদের দ্বারা করাবে, তবে সামনে নিজে উপস্থিত থাকা উত্তম। (শামী ৫ম খন্ড)
যবেহ করার সময় পশুকে ক্বিবলামুখী করে শোয়াবে অতঃপর (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর) বলে যবেহ করবে।
তাকবীর তাশরীক:
জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখের ফজর হতে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত ফরজ নামাযের পর উচ্চস্বরে একবার তাকবীর পাঠ করা ওয়াজিব, তিনবার পড়া উত্তম। তাকবীর: “আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।” হে আল্লাহ আমাদের কে তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কুরবানী করার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।