জুমার-খুৎবা

সুন্নি ও শিয়া: ঐতিহাসিক বিভক্তি এবং তার প্রভাব

ইসলামের ইতিহাসে সুন্নি এবং শিয়া দুটি প্রধান মুসলিম সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। যদিও এই দুটি সম্প্রদায় একই মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাস ও কিতাব শেয়ার করে, তাদের মধ্যে একাধিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলোর মূল কারণ ঐতিহাসিক বিভক্তি এবং তার প্রভাব, যা আজও বিশ্ব মুসলিম সমাজের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলছে। এই আর্টিক্যালটি সুন্নি ও শিয়া ইসলামের ঐতিহাসিক বিভক্তি এবং তার প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে।

সুন্নি ও শিয়া: পরিচিতি

সুন্নি ইসলাম

সুন্নি মুসলিমরা ইসলাম ধর্মের বৃহত্তম সম্প্রদায়। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ইসলামের নেতৃত্ব (খিলাফত) নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে হবে, এবং তারা বিশ্বাস করে যে, প্রথম চারটি খলিফা, যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পর ইসলামি সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা বৈধ খলিফা ছিলেন। সুন্নি মুসলিমদের মূল বিশ্বাস এবং অনুশীলন কুরআন এবং হাদীসের উপর ভিত্তি করে থাকে।

শিয়া ইসলাম

শিয়া মুসলিমরা ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায়, যারা বিশ্বাস করে যে ইসলামের নেতৃত্ব শুধুমাত্র আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) এবং তার উত্তরাধিকারীদের অধিকারী হতে হবে। শিয়া মুসলিমদের মতে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পর আলীই প্রকৃত নেতা ছিলেন, এবং তার সন্তানদের মধ্যেই ইসলামের নেতৃত্বের অধিকার থাকা উচিত।

ঐতিহাসিক বিভক্তির উৎস

খিলাফতের প্রশ্ন

ইসলামের প্রথম শতকগুলিতে যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর খলিফার নির্বাচনের বিষয়টি উঠেছিল, তখনই সুন্নি এবং শিয়া মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। সুন্নি মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের নেতা নির্বাচিত হতে হবে এবং এটি ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা আবু বকর (রাঃ)-এর খিলাফতের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছিল। অন্যদিকে, শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পর নেতৃত্বের জন্য আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন, এবং তাকে সৃষ্টির জন্য আল্লাহর আদেশ ছিল।

কারবালা: শিয়ার শোকের উৎস

এটি ছিল ঐতিহাসিক মুহূর্ত যখন শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে তাদের নেতা, ইমাম হুসাইন (রাঃ), কারবালার প্রান্তরে ইসলামী শাসনব্যবস্থার অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ হন। এই ঘটনাটি শিয়া মুসলিমদের জন্য একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা প্রতি বছর আশুরা (হিজরি সালের ১০ই মহররম) উপলক্ষে গভীর শোক ও স্মরণ করা হয়।

সুন্নি ও শিয়া বিভক্তির প্রভাব

ধর্মীয় ও সামাজিক পার্থক্য

সুন্নি এবং শিয়া মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় অনুশীলন, বিশ্বাস, এবং কিছু ধর্মীয় বিধান নিয়ে পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, শিয়া মুসলিমরা মুতাহ (শর্তযুক্ত বিবাহ) এবং তাওয়াল্লু (ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা) সহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন, যা সুন্নি মুসলিমরা করেন না। এছাড়া, শিয়া মুসলিমদের মধ্যে ইমামতের ধারণা রয়েছে, যেখানে তারা বিশ্বাস করেন যে, আলী এবং তার বংশধররা ইসলামের প্রকৃত নেতা, যা সুন্নি বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

রাজনৈতিক প্রভাব

প্রথমদিকে, সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে পার্থক্য ছিল মূলত ধর্মীয় এবং ধর্মীয় নেতৃত্বের বিষয়ে। তবে সময়ের সাথে সাথে এই বিভক্তি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে। উসমানীয় খিলাফত এবং সাফাবিদদের শাসনামলে শিয়া ও সুন্নি মুসলিমরা রাজনৈতিকভাবে একে অপরের বিরোধী হয়ে ওঠে, যা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্তির সূচনা করে।

যুদ্ধ এবং সহিংসতা

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে, সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিভক্তির কারণে বহু সংঘর্ষ ও সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে। এই সহিংসতা বিশেষত ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং পাকিস্তানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে, একাধিক দেশেই সুন্নি ও শিয়া মুসলিমরা দীর্ঘ সময় ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে।

সুন্নি ও শিয়া বিভক্তির আধুনিক প্রেক্ষাপট

আধুনিক মুসলিম বিশ্বে প্রভাব

আজকের দিনে, সুন্নি এবং শিয়া বিভক্তি শুধুমাত্র ধর্মীয় পার্থক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সমাজের সাধারণ জীবনকে প্রভাবিত করছে। মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষত ইরাক, সিরিয়া, এবং লেবাননে, সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলশ্রুতিতে একাধিক যুদ্ধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে।

সুন্নি-শিয়া সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা

বিশ্বের কিছু অংশে সুন্নি এবং শিয়া মুসলিমরা একে অপরকে সহ্য করে এবং একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেন। তবে, বিশেষ কিছু অঞ্চলে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দুর্বলের কারণে এই বিভক্তি এখনো বজায় রয়েছে। ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং বাহরাইনসহ বেশ কিছু দেশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে সুন্নি এবং শিয়া মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে সহায়তা করেছে।

সুন্নি ও শিয়া বিভক্তির সামাজিক প্রভাব

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং ঐক্য

সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি পৃথিবীজুড়ে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং ঐক্যের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, একাধিক মুসলিম দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশ, তুরস্ক, এবং মিশরসহ অন্যান্য দেশে, একসঙ্গে বসবাসের প্রচেষ্টা চলছে। এইসব অঞ্চলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহিষ্ণুতা প্রচারের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

মুসলিম বিশ্বে শান্তির প্রচার

বর্তমান সময়ে, বহু মুসলিম চিন্তাবিদ এবং ধর্মীয় নেতারা সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন। তারা ইসলামি মূল্যবোধ এবং শান্তির প্রতীক হিসেবে ইসলামের মুলনীতি পুনরায় তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, যাতে বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার

সুন্নি এবং শিয়া ইসলামের মধ্যে ঐতিহাসিক বিভক্তি একটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে এবং এটি বিশ্ব মুসলিম সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই বিভক্তির প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, তবে একই সাথে শান্তি, ঐক্য এবং সহিষ্ণুতার প্রচেষ্টা চলছে। মুসলিম বিশ্বে সুন্নি এবং শিয়া মুসলিমদের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠিত হলে তা বিশ্বের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।