জুমার-খুৎবা

পবিত্র রমজানের শিক্ষা ও তাৎপর্য

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার বয়ান

২৮ শাবান|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার |১ এপ্রিল, ২০২২ 

পবিত্র রমজানের শিক্ষা ও তাৎপর্য 

পবিত্র কুরআনের আলোকে রোজার গুরুত্ব:

ইসলামী আইনের উৎস মহাগ্রন্থ আলকুরআনে সিয়ামের বিধান ফরজ করা হয়েছে। এর অস্বীকারকারী কাফির। আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তির ভয়বহতা থেকে আত্মরক্ষার অনুশীলন ও প্রশিক্ষণের মাস রমজান, সুবহি সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম। পাঞ্জেগানা নামায, কুরআন তিলওয়াত, যিকর আযকার, তসবীহ, তাহলীল, দুআ, দরুদ, তাওবা, এস্তেগফার, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল, মুস্তহাব সকল প্রকার শরীয়ত সম্মত পুণ্যময় নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যয়ে রমজান মাসের ফযীলত ও তাৎপর্য অপরিসীম। মহান আল্লাহ তা’আলা রোজার বিধান সম্পর্কে এরশাদ করেছেন,

“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনি ভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর তা ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

কুরআন নাযিলের মাস রমজান:

সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ব শেষ আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল কুরআন বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ। মুক্তিকামী মানুষের জীবন চলার পাথেয় নিরেট ত্রুটিমুক্ত অভ্রান্ত নির্দেশিকা ঐশীগ্রন্থ আলকুরআন। নুযুলে কুরআন তথা কুরআন অবতরণের মাস হিসেবে এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত ও প্রতিটি মসজিদে হাফিজে কুরআনের মাধ্যমে খতমে তারাবীহ আয়োজনে অতিরিক্ত সওয়াব ও বরকত রয়েছে। মহান আল্লাহ এ মাসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বর্ণনায় এরশাদ করেছেন,

 “রমজান হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল কুরআন, যা মানুষের জন্য হিদায়ত ও সুস্পষ্ট পথ নির্দেশক, আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।”( সূরা: বাক্বারা: আয়াত: ১৮৫)

 

 

হাদীস শরীফের আলোকে রমজানের বহুমাত্রিক তাৎপর্য:

অনন্য বরকত মন্ডিত সাধনার মাস রমজানের গুরুত্ব ও ফযীলত প্রসঙ্গে নবীজির অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে, এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ হতে সাতশগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন, কিন্তু রোযা একান্তভাবে আমারই জন্য। এবং আমিই এর প্রতিদান দেব। রোযা পালনে আমারই সন্তুষ্টি বিধানের জন্য বান্দা স্বীয় ইচ্ছা প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করে থাকে। সাওম পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে, একটি আনন্দ তার ইফতারের সময়, অন্যটি তার প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ লাভের সময়। অবশ্যই রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ্‌র কাছে মিশকের সুগন্ধি থেকেও উত্তম।’’ (সহীহ বুখারী শরীফ:: হাদীস নং ১৯০৪)

 

 

সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য:

সিয়াম সাধনা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। এটি এমন এক বরকতপূর্ণ মাস যে মাসের প্রতিটি মুহূর্ত দিনে হোক, রাতে হোক, ইবাদতে অতিবাহিত করার এক সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। রোযা ইবাদত, ইফতার ইবাদত, তারাবীহ ইবাদত, তারাবীহ শেষে নিদ্রা যাওয়াও ইবাদত, সেহেরীর জন্য জাগ্রত হওয়াটা ইবাদত। সেহেরী গ্রহণ করা ইবাদত। [তাফসীরে নঈমী]।সিয়াম ফরয করার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌ তা‘আলা এরশাদ করেছেন

 

 

 “যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।” (আল কোরআন- ২:১৮৩)

ইমাম গাজ্জালী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বর্ণনা মতে সিয়ামের কল্যাণের দিক হলো- সিয়াম রুহানী রোগের চিকিৎসা করে। আল্লাহ্‌র সাথে মানুষের গভীর সম্পর্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে তাক্বওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনে বান্দাকে অভ্যস্ত করে তোলাই সিয়াম ফরয করার অন্যতম উদ্দেশ্য। (ইমাম গাজ্জালী (রাহ.) এইইয়াই উলুমিদ্দীন: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২১১)

 

 

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মতে সিয়াম দারিদ্র পীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে। মানুষের শারীরিক সুস্থতা ও আত্মিক শক্তির উন্নতি সাধন করে। পাশবিকতার প্রাবল্য অবদমিত করে। (আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রাহ.) যাদুল মা’আদ: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫২)

এ মাসের নফল অন্য মাসের ফরয সমতুল্য:

 

 

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের লক্ষ্যে কোন ভাল (নফল) কাজ করে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে অন্য মাসে একটি ফরয আদায় করে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করে। (বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান: হাদীস-৩৩৩৬)

ধৈর্য ও সহমর্মিতার মাস রমজান:

 

 

তীব্র গরমে প্রচন্ড হাহাকার পিপাসায় কাতর, ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত বান্দা, প্রাণ ওষ্ঠাগত, খোদাভীতি ও তাক্বওয়ার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে বান্দা অটল অবিচল, ধৈর্য যেন ঈমানের প্রতীক। ধৈর্যের অনুশীলন সিয়াম সাধনার অনন্য শিক্ষা। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লা রোযার বহুমাত্রিক শিক্ষা তুলে ধরে এরশাদ করেছেন- এটা সবরের (ধৈর্যের) মাস। আর সবরের প্রতিদান হলো জান্নাত। এটা সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। এটা সেই মাস যাতে মু’মিনের রিযক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। (সহীহ ইবনি খুযাইমা: হাদীস-১৮৮)

সিয়াম পালন ও লায়লাতুল ক্বদর উদযাপনে ক্ষমা প্রাপ্তি:

 

 

হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী রয়েছে পবিত্র রমজানে। গুনাহ্‌গার-পাপী-তাপী বান্দাদের মার্জনার জন্য অনুপম সূবর্ণ সযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। বান্দা অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে কায়মনোবাক্যে মহান প্রভূর দরবারে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ করতে জানলে বান্দার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। মহান প্রভূর মাগফিরাত তথা ক্ষমা নসীব হলে চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাতের পথ সুগম হবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ক্বদরের রজনীতে ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় সালাত আদায় করবে, তার অতীতের গুনাহ্‌ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় রমজানের সিয়াম পালন করবে তার অতীতের গুনাহ্‌ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (বোখারী শরীফ: খন্ড-১, হাদীস- ১৯০১, পৃষ্ঠা-৬৫৮, মুসলিম শরীফ: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৫৯, সুনানি আবূ দাঊদ: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৯৪)

রোযাদারকে ইফতার করানোর সওয়াব:

 

 

রোযাদার বান্দাকে ইফতার করালে অশেষ সওয়াব রয়েছে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে এ মাসে ইফতার করাবে তা তার গুনাহসমূহের ক্ষমার কারণ হয়ে যাবে।” (মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা-১৭৪)

খেজুর ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ইফতার করা সুন্নাত

 

 

হযরত সালমা ইবনি আমের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের কেউ রোযা রাখলে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে, এতে বরকত রয়েছে। খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে, কেননা পানি পবিত্রকারী।” (তিরমিযী শরীফ: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৪৯, সুনানে আবু দাউদ: হাদীস-২৩৫৫)

বিলম্বে ইফতার করা নিষেধ:

 

 

সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা মুস্তাহাব। ইফতার বিলম্বে করা নিষেধ। হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “দ্বীন ইসলাম সর্বদা বিজয়ী থাকবে যতদিন লোকেরা শীঘ্র ইফতার করবে। কেননা ইহুদী নাসরাগণ বিলম্বে ইফতার করে।” (আবূ দাউদ: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২৩, মিশকাত: পৃষ্ঠা ১৭৫)

সেহ্‌রী খাওয়া সুন্নাত:

 

 

হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত তোমরা সেহরী খাও, কেননা সেহরীতে বরকত রয়েছে। (বুখারী শরীফ: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৫৭, মুসলিম: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৫০)

হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত নবীজি এরশাদ করেছেন সেহরী গ্রহণকারীদের উপর আল্লাহ্‌ ও ফিরিশতারা রহমত বর্ষণ করেন। (তাবরানী, ইবনে হিব্বান: খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৯৪)

 

 

হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সেহরী গ্রহণের দ্বারা রোযার শক্তি অর্জিত হয়। (ইবনে মাজাহ্‌: পৃষ্ঠা-১২১)

পূর্ববর্তী উম্মতদের উপরও রোযা ফরয ছিল:

হযরত আদম আলায়হিস্‌ সালাম প্রতিমাসের তের, চৌদ্দ, পনের, তারিখ রোযা রাখতেন। হযরত নূহ্‌ আলায়হিস্‌ সালাম সারা বছর রোযা রাখতেন। হযরত দাঊদ আলায়হিস্‌ সালাম একদিন ছেড়ে একদিন রোযা রাখতেন। হযরত ঈসা আলায়হিস্‌ সালাম দুই দিন পর একদিন রোযা রাখতেন। (তাফসীরে আযিযী: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৩৯)

রমজান মাসে আসমানী কিতাব সমূহ নাযিল হয়:

আল্লামা কাযী সানাউল্লাহ্‌ পানিপথি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত “তাফসীরে মাযহারীতে” উল্লেখ রয়েছে, রমজান শরীফের ১ম তারিখে ইবরাহীম আলায়হিস্‌ সালাম’র উপর সহীফা নাযিল হয়েছে। তার সাতশত বছর পর হযরত মুসা আলায়হিস্‌ সালাম-এর উপর ৬ রমজান তাওরাত শরীফ নাযিল হয়েছে। তার পাঁচশত বছর পর হযরত দাঊদ আলায়হিস্‌ সালাম-এর উপর ১৩ রমজান যবুর শরীফ নাযিল হয়েছে। তার বারশত বছর পর হযরত ঈসা আলায়হিস্‌ সালাম-এর উপর ১৮ রমজান ইঞ্জিল শরীফ নাযিল হয়েছে। ইঞ্জিল শরীফ অবতরণের ছয়শত বছর পর ২৪ রমজান লওহ মাহফুজ থেকে পূর্ণ কোরআন মজীদ একসঙ্গে দুনিয়ার আসমানে নাযিল হয়। আর রমজান মাসের সেই তারিখেই রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উপর ক্বোরআন শরীফ নাযিলের সূচনা হয়। (তাফসীরে মাযহারী: খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১৮১, তাফসীরে রুহুল মাআনী: খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৬১)

হে আল্লাহ্‌! আমাদেরকে রমজান মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আপনার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উসিলায় এ মহিমান্বিত মাসের বরকত আমাদেরকে নসীব করুন-আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।