নবীজির রওজা শরীফ যিয়ারতের গুরুত্ব ও রওজা শরীফ নিয়ে চক্রান্তকারীদের পরিণতি | জুমার খুতবা
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
প্রিয় ইসলামী ভাই ও বোনেরা,
জেনে রাখুন! মদীনা মুনাওয়ারার অসংখ্য ফজিলত রয়েছে। এতে রয়েছে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র রওজা শরীফ। যা ভূখন্ডের সকল স্থান হতে উত্তম। এমনকি ক্বাবা শরীফ আরশ ও কুরছি অপেক্ষাও উত্তম। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মুজতাহিদ ওলামাগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা মোবারক যিয়ারত করা আল্লাহর নৈকট্যলাভের সর্বোত্তম মাধ্যম এবং তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার নিদর্শন। রওজা শরীফের যিয়ারত ইবাদত সমূহের মধ্যে উত্তম ইবাদত। হযরত ইমাম ফার্সী মালেকী রওজা পাকের যিয়ারতকে ওয়াজিব বলেছেন। হানফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা হাসান শারাম্বোলালী (র.)’র মতে রওজা পাকের যিয়ারত ওয়াজিবের কাছাকাছি।
কুরআন মজীদের আলোকে রওজা মুবারকের যিয়ারত:
মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআন মাজীদে এরশাদ করেছেন, “যখন তারা নিজেদের আত্মার উপর অত্যাচার করে তখন হে মাহবুব তারা আপনার নিকট আসলে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আর রাসূলও তাদের জন্য শাফায়াত করলে তারা আল্লাহকে তাওবা কবুলকারী এবং দয়াবান পাবে।” (সূরা নিসা, আয়াত: ৬৪)
হাদীস শরীফের আলোকে রওজা মোবারক যিয়ারতের গুরুত্ব:
রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যিয়ারতে শাফায়াতের স্বীকৃতি রয়েছে। এরশাদ হয়েছে, হযরত নাফে (রা.), হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে আমার রওজা যিয়ারত করেছে তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যায়। (বায়হাকী শরীফ, রাহাতুল কুলুব, পৃ: ২০৪)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্ব করল অত:পর আমার ওফাতের পর আমার রওজার যিয়ারত করল সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাক্ষাৎ করলো। (বায়হাকী সুনানে কুবরা, খন্ড ৫, পৃ:২৪৬)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসে এবং তার সফরে আমার যিয়ারত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকেনা, কিয়ামত দিবসে তার জন্য সুপারিশকারী হওয়া আমার দায়িত্ব হয়ে যায়। (তাবরানী, দারেকুতনী, খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ:৬০)
রওজা শরীফ নিয়ে ষড়যন্ত্র:
কাফের, মুশরিক, ইয়াহুদী, খৃষ্টানরা যেভাবে রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জীবদ্দশায় এক মূহুর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়নি। তেমনিভাবে তাঁর তিরোধানের পরও অদ্যাবধি তাঁদের বহুমুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই। যুগে যুগে ষড়যন্ত্র হয়েছে বর্তমানেও ষড়যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ইসলামী আকিদা হচ্ছে-রাসূলুল্লাহ হায়াতুন্নবী দুনিয়া থেকে স্থানান্তরিত হয়েছেন মাত্র। তিনি যে রওজা শরীফে শায়িত আছেন সেই রওজা শরীফের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা নিয়েছেন। এ কারণে রওজা শরীফ ধ্বংস করার চক্রান্ত অতীতেও বহুবার হয়েছে। বারবার হচ্ছে। কোনভাবে তারা সফল হয়নি। প্রতিবারে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়েও নজদী ওহাবী কর্তৃক ষড়যন্ত্রের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা থেকে বিশ্ব মুসলিমের প্রতিবাদের মুখে তারা সেই ঘৃণিত চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মাহান আল্লাহর কুদরতের ব্যবস্থাপনায় কিয়ামত অবধি তাদের এহেন চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
খৃষ্টানদের ষড়যন্ত্র:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে স্বীয় রওজা মোবারকে জীবিত আছেন ইয়াহুদী নাসারা খৃষ্টান বিশেষজ্ঞরাও তা মনোপ্রাণে বিশ্বাস করত, তারা এটাও জানতো যে মুসলমানদের সফলতা ও বিজয়ের মূলে মুসলমানদের নবীই বেশি সক্রিয়। মুসলমানদের নবীকে রওজা শরীফে ধ্বংস করে দিতে পারলেই মুসলমানদেরকে পরাজিত করা কোন ভাবেই অসম্ভব হবে না। এ ভ্রান্ত ধারণা বাস্তবায়নে দুইজন খৃষ্টানকে মুসলিম দরবেশ বানিয়ে তাদেরকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দিয়ে মদীনা শরীফে রওজা শরীফের সন্নিকটে তাদের দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নে পাঠানো হলো। তারা রওজা শরীফের সন্নিকটে নীরবে নিবৃত্তে ইবাদত বন্দেগীর বাহানায় দরবেশী বেশ ভুষায় ইয়াহুদী চক্রের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করে। কিছু দিনের মধ্যে মদীনাবাসীর নিকট তারা দানশীল দরবেশ লোক হিসেবে সকলের নিকট প্রিয় হয়ে উঠে। এ দিকে ৫৫৭ সালে নবী প্রেমিক শাসক সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গী পর পর তিনদিন রাতে তিনবার নবীজিকে স্বপ্নে দেখেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই লোকের চেহারার প্রতি সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে সুলতানকে নির্দেশ দিলেন এ দুই অত্যাচারীর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে সুলতান আতঙ্কিত হলেন নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি বিচলিত হলেন এবং প্রত্যুষেই মদীনা শরীফ যাত্রার প্রতীজ্ঞা করলেন। ২০জন অশ্বারোহী বীরযোদ্ধা সৈনিকসহ বিপুল পরিমান নগদ অর্থ ও মালামাল নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। ষোলদিন অবিরাম পথ চলার পর তিনি মদীনায় পৌছলেন। মদীনায় উপস্থিত হয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি মদীনাবাসীদেরকে দান করবেন, সকলে যেন তাঁর দান গ্রহণ করে। কেউ যেন তাঁর দান গ্রহণ থেকে বঞ্চিত না হয়। নির্দেশনুসারে সকলে হাজির হলো সুলতান ঐ দুষ্ট দুইজন লোক যাদের চেহারা স্বপ্নযোগে নবীজি সুলতানকে দেখিয়ে ছিলেন তাদেরকে দেখতে না পেয়ে সুলতান ভীষণ চিন্তিত হলেন। সুলতান বললেন, তাঁর দান গ্রহণ করতে আসেন নি এমন কোন লোক মদীনা শহরে অবশিষ্ট আছে কি? লোকেরা বলল সবাই এসেছে জনাব, কেবল দুইজন লোক আসেনি তারা কোথাও গমন করেন না। সর্বদা ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকে। তারা দানশীল দরবেশ, তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা, কোথাও বের হয় না। সর্বদা হুজরায় অবস্থান করেন। সুলতান বললেন, আমাকে তাদের নিকট নিয়ে চলুন, সুলতান তাদেরকে দেখা মাত্রই চিনতে পারলেন। তারা সেই লোক যাদেরকে প্রিয়নবী স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন। সুলতান নিশ্চিত হলেন এরাই নবীজির চিহ্নিত শত্রু। সুলতান তাদেরকে বিছানা থেকে সরে দাঁড়াতে বললে বিছানার নীচে দেখা গেল বিছানার তক্তার নীচের দিকে একটি সুড়ঙ্গ পথ রওজা শরীফের দিকে চলে গেছে। সম্মুখ দিকে অগ্রসর হয়ে দেখতে পেলেন সুড়ঙ্গটি রওজা শরীফের নিকটে চলে গেছে আর কয়দিন পর দেহ মোবারক পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এ আলেমদ্বয় দিনের বেলায় ইবাদতের বাহানা করত। রাত্রিবেলা সুড়ঙ্গ খনন করে বস্তাভর্তি মাটি গুলো জন্নাতুল বাকীর কবর স্থানে রেখে আসতো। সুলতান হতবাক হলেন, তাদের গ্রেফতার করলেন। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিলেন। প্রকাশ্য জনসম্মুখে এ পাপিষ্টদ্বায়ের লাশ জ্বালিয়ে ফেললেন। সুলতান নবীজির দরবারে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন, নবীজির প্রতি অন্তরাত্মার গভীর শ্রাদ্ধাবোধ নিবেদন করলেন। মাটির সুগভীর থেকে রওজা শরীফের চারপাশে সীসাঢালা প্রাচীর নির্মাণ করলেন। ভবিষ্যতে যেন কোন অশুভ শক্তি, দুষ্ট চক্র, নবী দ্রোহী, জালিমরা নবীজির রওজা শরীফ থেকে দেহ মোবারক সরিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র করে সফল হতে না পারে। এভাবে তিনি রওজা শরীফের সংরক্ষণ ও সুরক্ষায় বিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। (ড. মুহাম্মদ ইলিয়াছ আব্দুল গণি, মসজিদে নবভী, পৃ: ১৩৫-১৩৭ ও জযবুল কুলুব, পৃ: ১২৬-১৩১)
রাফেজীদের ষড়যন্ত্র:
ইসলামের নামে আরেক ভ্রান্ত মতবাদের নাম রাফেজী সম্প্রদায় বিখ্যাত ইতিহাসবিদ তাবারী “আররিয়াদিন নদরাতি ফি ফদায়িলিল আসরাতি” নামক গ্রন্থে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেন। রাফেজী সম্প্রদায়ের কতেক জালেম প্রচুর উপহার উপটৌকন সামগ্রী নিয়ে মদীনার লোভী তৎকালীন গভর্নরের নিকট অর্পণ করলো। গভর্নর ছিলো রাফেজীদের প্রতি অনুরক্ত। ঐ দূর্বৃত্তরা গভর্নরকে নিজেদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করল। তারা রওজা শরীফে প্রবেশ করে হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত ওমর (রা.) এর দেহ মোবারক চুরি করে নিয়ে যাবে। তারা এ জঘন্য কাজে গভর্ণরের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করে। গভর্ণর তাদের দাবী পূরণে সম্মত হলেন, সাড়া দিলেন। রওজা শরীফের খাদেমকে বলে দিলেন রাতে একদল লোক রওজা শরীফের ভেতরে প্রবেশ করতে আসলে তাদেরকে যেন কোন প্রকার বাধা দেয়া না হয়, তারা তাদের কর্ম সম্পাদন শেষে যেন চলে যেতে পারে। তাদেরকে যেন যথাযথ সহযোগিতা প্রদান করা হয়। রওজা শরীফের খাদেম নির্দেশ মানতে বাধ্য। মুসল্লিরা এশার নামায শেষে বিদায়ের পর ষড়যন্ত্রকারী ৪০ জনের এক বিশাল কাফেলা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে হাতুড়ি কোদাল ইত্যাদি যন্ত্রপাতি নিয়ে রওজা শরীফের ভেতরে ঢুকে পড়ল এবং নবীজির রওজা শরীফের দিকে অসৎ উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। খাদেম এ জঘন্য অন্যায় অপরাধ শুধু দেখছিলেন আর ক্রন্দন করছিলেন, দুষ্কৃতকারীরা মসজিদে নবভী শরীফের দিকে মিম্বর পর্যন্ত অগ্রসর হতে না হতেই হঠাৎ করে ৪০ জনের বিশাল দলের প্রত্যেকই মাটির মধ্যে তলিয়ে গেল। এ দিকে আমীর তাদের আগমনের অপেক্ষায় অপেক্ষমান। খাদেমকে বিলম্বতার কারণ জিজ্ঞেস করলে, খাদেম আমীরকে বিস্তারিত ঘটনা ব্যক্ত করলেন। আমীর স্বচক্ষে ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন, এ ধরনের আরো অনেক ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। সংক্ষেপে দুটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো। এতে প্রমাণিত হলো নবীজির রওজা শরীফ থেকে দেহ মোবারক সরানোর কোন চক্রান্ত কোনদিন সফল হবে না।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে হারামাঈন শরীফাইনের যিয়ারত, ফয়ুজাত ও বরকত নসীব করুন, আল্লাহ আমাদের সকলকে মহান কুরআনের বরকত দান করুন। কুরআন মজীদের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা আমাদের নাজাত দান করুন। নিশ্চয় তিনি মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল দয়ালু। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।