ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী
জুমার খুতবা
২১ শাবান|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|২৫ মার্চ’২২
“ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য”
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। নামায আদায়ের জন্য পবিত্রতা অর্জনকে অপরিহার্য শর্ত মনে করুন। জেনে রাখুন পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ বাহ্যিক অপবিত্রতা হতে শারীরিক পরিত্রতা অর্জন, পোশাক পরিচ্ছদ ও স্থান পবিত্র থাকা অপরিহার্য। বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জনে পবিত্র পানি দ্বারা অযু ও গোসল করার উপর ইসলাম বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। শরীয়ত অনুযায়ী অযু গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা ইসলামেরই নির্দেশ। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, বাবুত তাহারাত, ১ম খন্ড)
আল কুরআনের আলোকে পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব:
ইসলামে পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব এতো বেশী যে, ঈমানের পর দ্বীনের প্রধান স্বম্ভ নামায, বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ, কুরআন মজীদ তিলাওয়াতের জন্য পবিত্রতা অবলম্বন তথা অযু গোসল অপরিহার্য করা হয়েছে। এ বিষয়ে ইসলামী আইনজ্ঞ মুজতাহিদ ফকীহগণ ফিক্হ শাস্ত্রে “কিতাবুত তাহারাত” পবিত্রতা শীর্ষক অধ্যায় শিরোনাম নির্ধারণ করে সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছে।
মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ ভালবাসেন তাওবাকারীদের এবং তিনি ভালবাসেন পবিত্রতা অর্জন কারীদের।” (বাক্বারা, আয়াত: ২২২)
পবিত্রতার বিষয়কে নিছক ক্ষুদ্র পরিসরে চর্চা ও অনুশীলন করার নির্দেশ করেনি বরং এর পরিধি ব্যাপক। এরশাদ হয়েছে, “নিজের পোশাক পরিচ্ছদ পাক-পবিত্র ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন” (মুদ্দাস্সির-৪)
আয়াতে বর্ণিত “ছিয়াব” শব্দ দ্বারা কেবল মাত্র পোশাক বুঝানো হয়নি বরং শরীর, পোশাক, পরিচ্ছদ, মন, মস্তিস্ক, চিন্তা, চেতনা, সবই আয়াতের অন্তর্ভূক্ত। এর দ্বারা শারীরিক পবিত্রতা ও পোশাক পরিচ্ছদ যেভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ রয়েছে, তেমনিভাবে মন, মস্তিস্ক, মনন মেধা ও চিন্তা চেতনাকে কুফরী আক্বিদা বিশ্বাসের মলিনতা ভ্রান্ত মতবাদ ও বাতিল আক্বিদা পোষণ থেকে নিজের অন্তরাত্নাকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আল্লাহর নির্দেশিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত সাহাবায়ে কেরাম ও মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসৃত ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মাতদর্শের আলোকে জীবনাদর্শ গঠনের লক্ষ্য স্থির করতে হবে।
পবিত্রতা অর্জনকারী সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন অনুসরণীয় আদর্শ:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্রতার মূর্তপ্রতীক। তাঁর পদাঙ্ক অনুসারী সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার এক অতুলনীয় অনুপম দৃষ্টান্ত। নবীজির পদধূলিতে ধন্য পবিত্র মদীনা নগরীর কুবা পল্লীতে বসবাসকারী প্রিয় সাহাবীদের প্রশংসা বর্ণনায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তথায় (মসজিদে কুবায়) এমন লোক রয়েছে যারা পবিত্রতা অর্জন করাকে ভালবাসে, আর আল্লাহ ভালবাসেন পবিত্রতা অর্জনকারীদের। (৯:১০৮)
হাদীস শরীফের আলোকে পবিত্রতার গুরুত্ব:
পবিত্রতা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, পঞ্জেগানা নামায, দুই ঈদের নামায, বিতরের নামায, তারাবীহ নামায, পবিত্র হজ্বের আহকাম পালনে ও বায়তুল্লাহর তাওয়াফে ও কুরআন তিলাওয়াতে তাহারাত তথা পবিত্রতাকে শর্ত করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “পবিত্রতা ঈমানের অংশ।” (মুসলিম শরীফ)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, “বেহেস্তের চাবি নামায এবং নামাযের চাবি হলো পবিত্রতা।” (মুসনাদে আহমদ)
পবিত্র থাকা সত্ত্বেও অযু করার ফযীলত:
অযু দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা হয়। অযু থাকা সত্ত্বেও অযু করলে অধিক সওয়াবের সুসংবাদ রয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অযু থাকাতে অযু করবে তার জন্য (অতিরিক্ত) দশটি সওয়াবে রয়েছে।” (তিরমিযী)
গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল:
নামাযের জন্য পবিত্রতা অপরিহার্য। পবিত্রতা ছাড়া নামায হবেনা। জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃত অপবিত্র অবস্থায় নামায আদায় করাকে ওলামায়ে কেরাম কুফরী বলেছেন, গোসল বিহীন ও অযু বিহীন নামায আদায়কারী ইবাদতের প্রতি ধৃষ্ঠতা ও অসম্মান প্রদর্শন করেছে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ২য়, পৃ:৭)
পবিত্রতার প্রকারভেদ:
পবিত্রতা দু: প্রকার-
১. বড় পবিত্রতা,
২. ছোট পবিত্রতা। বড় পবিত্রতা হলো গোসল করা, ছোট পবিত্রতা হলো অযু করা, বড় ধরনের নাফাকীর কারণে গোসল ফরজ হয়। ছোট নাপাকীর কারণে অযু অপরিহার্য হয়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ২য়, পৃ: ৭)
অযু দ্বারা শাহাদতের মর্যাদা নসীব হয়:
হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, যখন আমাদের আক্বা সরকারে দোআলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা মনোওয়ারা শুভাগমন করেন, তখন আমার বয়স ছিল আট বৎসর। নবীজি আমাকে বললেন, প্রিয় বৎস! সব সময় অযুর সাথে থাকার চেষ্টা করো, যার মৃত্যু অযু অবস্থায় হবে তাকে শহীদের মর্যাদা দান করা হবে। (আওয়ারিফুল মাআরিফ, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২য়, পৃ: ৫৪২)
পবিত্র অবস্থায় থাকার ফযীলত:
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.) বলেন, যে ব্যক্তি সর্বদা পবিত্র অবস্থায় অযু সহকারে থাকে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সাতটি মর্যাদা দান করেন। ১. ফেরেস্তাগণ তাঁর সাথে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন, ২. কলম তাঁর নেকী লিখতে থাকে, ৩. তাঁর অঙ্গগুলো তাসবীহ পাঠ করে, ৪. তাঁর তাকবীরে উলা প্রথম তাকবীর হাতছাড়া হয় না, ৫. ঘুমন্ত অবস্থায় ফিরিস্তারা তাঁকে জ্বীন ইনসানের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করেন, ৬. তাঁর মৃত্যু যন্ত্রণা সহজতর হয়ে যায়, ৭. যতক্ষণ পর্যন্ত অযু অবস্থায় থাকবে আল্লাহ তা’আলার নিরাপত্তায় থাকবে। (ফতোওয়ায়ে রিজভীয়্যাহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৭০২-৭০৩)
পানির পবিত্রতা নিরূপণে রাসূলুল্লাহর নির্দেশনা:
পানির পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা নিরূপণে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা বর্তমান আধুনিক যুগের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। নবীজি এরশাদ করেছেন, যে পানির রং, গন্ধ ও স্বাদ তিনটিই বিকৃত হয়ে গেছে তা পান করা উচিত নয়। (আবু দাউদ)
পানির বিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ন রাখতে নবীজি পানি পান করার সময় নি:শ্বাস ফেলতে ও পানির মধ্যে ফুক দিতে নিষেধ করেছেন। (হাকেম, আল মুস্তাদরাক)
একদিকে ধর্মীয় বিধান নামায, তাওয়াফ, তিলাওয়াত ইত্যাদি ক্ষেত্রে পানির পবিত্রতা অপরিহার্য। তেমনিভাবে জীবন রক্ষার জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম। শারীরিক সুস্থতা রক্ষায় পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নবীজি পানি পান করার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন, যে পানিতে কোন ভাসমান জৈব বা অজৈব পদার্থ থাকেনা, কোন প্রকার রোগ জীবাণু থাকেনা এ প্রকৃতির পানিকে পবিত্র পানি, স্বাস্থ্যসম্মত বিশুদ্ধ পানি বলা হয়। (স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ইসলাম, পৃ: ১৭০)
মানুষের শরীরের তিনভাগের দু’ভাগ বা সত্তর শতাংশ হচ্ছে পানি, খাদ্য সংকট দেখা দিলে কিছু দিন বেঁচে থাকা সম্ভব। পানি ছাড়া একদিনও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, পানির অপর নাম জীবন। পানি কেবলমাত্র খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় না, ধোঁয়া, মোছা, রান্না ও গোসল করাসহ প্রায় সব কাজেই পানির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিভিন্ন প্রকার সংক্রামক ব্যাধি থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশুদ্ধ ও পবিত্র পানি পান করা অপরিহার্য। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, আমাশয়, বদহজম, কৃমি রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ। “পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ” রাসূলুল্লাহ এ অমূল্য বাণীর যথার্থ যৌক্তিকতা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর ক্রান্তিকালে শতভাগ প্রমাণিত। আমাদের জীবন যাত্রার চলার পথে, শহরে, নগরে, ঘরে, বাইরে, অফিসে, আদালতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে, অলিতে গলিতে, হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান পাটে সর্বত্র সুন্দর পবিত্র পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্য উপযোগী পরিবেশ সুনিশ্চিত করার জন্য নবীজির একটি হাদীসের আমল কার্যকর করা হলে একটি আদর্শ জাতি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে আমরা সক্ষম হবো।
হে আল্লাহ! আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আপনার মনোনীত জীবন বিধান পবিত্র ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পবিত্রতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।