জীবনী

হযরত ইমাম হাসান (রা.)’র আদর্শ জীবন

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

২৪ মহররম|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|৩ সেপ্টেম্বর’২১

“নবী দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান (রা.)’র আদর্শ জীবন”

হযরত ইমাম হাসান (রা.)’র জন্ম

হযরত ইমাম হাসান (রা.) তৃতীয় হিজরির ১৫ রমজান রাতে মদীনা মনোওয়ারায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নূর নবীজি রাহমাতুল্লীল আলামীনের প্রিয় দৌহিত্র। নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমাতুজ যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন তাঁর মাতা। ইসলামের চতুর্থ খলিফা আমিরুল মু’মেনীন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তাঁর পিতা। তাজেদারে কারবালা শহীদে কারবালা হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন তাঁর ছোট ভাই।

হাসান(রা.)’র জন্মের পর কানে আযান

জান্নাতী যুবকদের সরদার হযরত হাসান (রা.) ভূমিষ্ট হওয়ার পর স্বয়ং প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কানে আযান দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু রাফে (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, যখন হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.) জন্ম গ্রহণ করেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের দুজনের কানে আযান দিয়েছেন। (আল মুজামুল কবীর, হাদীস:-৯২৬)

বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত নবজাত শিশু সন্তান জন্মের পর তাদের কানে আযান দেওয়া নবীদের সুন্নাত। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদীসে এরশাদ হয়েছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হযরত ফাতেমার তিন সন্তানের নাম আমি হযরত হারুন আলাইহিস সালাম এর সন্তান শাব্বার, শাব্বীর ও মুবাশশার এর অনুকরণে আরবিতে হাসান, হোসাইন ও মুহসিন রেখেছি। (মুসতাদরাক, হাদীস: ৪৭৭৩)

হাসান জান্নাতী নাম

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত ইমরান ইবন সোলায়মান (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হাসান ও হোসাইন জান্নাতবাসীদের নাম সমূহের দুটি নাম, জাহেলী যুগে হাসান ও হোসাইন নামে কারো নাম ছিলনা। (তারিখুল খোলাফা, পৃ: ২৭৭)

হারুন (আ:)’র পুত্র শাব্বার’র অর্থ সৌন্দর্য, এজন্য নবীজি স্বীয় দৌহিত্রের নাম রাখেন হাসান, আরবিতে হাসান অর্থ সৌন্দর্য, নবীজির জীবনাদর্শের অনুসরণে প্রিয় দৌহিত্রের জীবন ছিল সৌন্দর্যমন্ডিত, আদর্শ জীবন, উত্তম জীবন, তাঁদের সুন্দরতম জীবন ধারা ও আদর্শিক গুণাবলীর মৌলিক সৌন্দর্য হলো আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পার্থিব স্বার্থে আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করা। তাঁদের সুন্দর জীবন প্রণালী, রীতিনীতি, আচার আচরণ, ভদ্রতা, শিষ্টাচারিতা, কর্ম পন্থা ও কর্মনীতি ছিল নবীজির আদর্শের বাস্তব নমুনা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা: আহযাব, আয়াত: ৩৩)

নবীজির আদর্শ অনুসরণেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, (হে প্রিয় মাহবুব) আপনি বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস আমাকে অনুসরণ কর। (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ৩১)

হাদীস শরীফের আলোকে ইমাম হাসানের মর্যাদা

নবীজির প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হাসানকে অধিক ভালবাসতেন, আল্লাহর দরবারে দুআ করতেন, হে আল্লাহ আমি তাকে ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালবাস। (বুখারী, পৃ: ৫৩০, বরকাতে আলে রসূল: পৃ: ১৩৬)

নবীজি এরশাদ করেছেন, হাসান ও হোসাইন জান্নাতী যুবকদের সর্দার। (তিরমিযী)

দো’জাহানের নবী নিজের দৌহিত্রকে এতো অধিক ভালবাসতেন পৃথিবীতে যার তুলনা বিরল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি ইমাম হাসানকে নিজের কাঁধে উঠালেন তখন এক ব্যক্তি বলল, ওহে বালক, তুমি কত উত্তম সওয়ারিতে আরোহণ করেছে? জবাবে নবীজি বললেন, আরোহীও তো কতই উত্তম। (তিরমিযী, হাদীস: ৪১৫৩)

ইমাম হাসান (রা.) অসাধারণ বৈশিষ্ট্য

খাতুনে জান্নাত ফাতেমাতুজ যাহরা (রা.)’র বড় ছেলে ইমাম হাসান (রা.) মাতৃক্রোড়েই লালিত পালিত হন। তাঁর পুরো জীবন তাকাওয়া, ইবাদত, বন্দেগী, বিশ্বস্ততা, ন্যায়-পরায়নতা, মানবতার কল্যাণ কামনা, দয়া অনুগ্রহ, ধৈর্য সহনশীলতা, মহানুভবতা ও দানশীলতার অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলো। তিনি কোন সাহায্য প্রার্থীকে কোন অবস্থায় নিজ গৃহ থেকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। ইবনে সাদ আলী বিন যায়দ যাদআন থেকে বর্ণনা করেন, হযরত ইমাম হাসান (রা.) তাঁর সমুদয় সম্পদ দু’বার আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছেন, তিনবার তাঁর অর্ধেক সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় সাদকা করে দিয়েছেন। তিনি পদ ব্রজে, কখনো নগ্ন পায়ে ২৫ বার মদীনা মনোওয়ারা থেকে মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্বব্রত পালন করেছেন। (বরকাতে আলে রাসূল, পৃ: ১২৮, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ১ম, পৃ: ১৪৯)

ইমাম হাসান(রা.)’র প্রতি হযরত আবুবকর সিদ্দিক(রা.)’র ভালবাসা

হযরত উকবা বিন হারেছ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমিরুল মুমেনীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আমাদেরকে আসর নামায পড়িয়ে বের হলেন, বাইরে হযরত ইমাম হাসান বিন আলী (রা.) কে খেলতে দেখে তাঁকে নিজ কাঁধে তুলে নিলেন, আমিরুল মুমেনীন বললেন, চেহারা আকৃতি অবয়বে নবীজির সাদৃশ্য হযরত ইমাম হাসান (রা.)’র উপর আমার পিতা মাতা উৎসর্গ হোক। ইনি [ইমাম হাসান (রা.)] হযরত আলী (রা.)’র সদৃশ্য নহে, এ কথা শুনে হযরত আলী (রা.) মুসকি হেসেছেন। (বরকাতে আলে রসূল, পৃ: ১৩৭)

কারবালা প্রান্তরে ইমাম হাসান(রা.)’র পুত্রগণের শাহাদাত

কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)সহ যে ৭২ জন শাহাদাত বরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে হযরত ইমাম হাসান (রা.)’র নিম্নোক্ত পুত্রগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, ১. হযরত যায়েদ (রা.), ২. হযরত আবদুল্লাহ (রা.), ৩. হযরত কাসেম (রা.), ৪. হযরত আবু বকর (রা)।

জান্নাতে অবস্থান

নবীজির আহ্‌লে বায়ত সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় ফাতেমা, আলী, হাসান ও হোসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহ আনহুম) বেহেস্তে সাদা গুম্বজে অবস্থান করবেন, যে জান্নাতের ছাদ হবে, রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তা’আলার আরশে আজীম। (মুজামুল আউসাত, হাদীস:৩৩৭)

ইমাম হাসান (রা.)’র শাহাদাত

হযরত সদরুল আফাযিল সৈয়দ নাঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী (র.) উল্লেখ করেন, হযরত ইবনে সাদ (রা.) হযরত ইমরান বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, একদা কোন একব্যক্তি হযরত ইমাম হাসান (রা.) কে স্বপ্নে দেখলেন যে, ইমামের দু’ কপালের মধ্যখানে “ কুল হুয়াল্লাহু আহাদ” লিখা রয়েছে, আহলে বায়তের সদস্যগণ, এ স্বপ্নের সংবাদ শুনে খুশী হলেন কিন্তু যখন হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়য়্যিব (রা.)’র সামনে এ স্বপ্নের কথা বর্ণনা করা হলো তখন তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন ইমাম হাসান (রা.)’র হায়াতের আর কয়েকদিন অবশিষ্ট আছে, বর্ণনা সত্য প্রমাণ হলো, এর কিছুদিন পরই ইমাম হাসান (রা)’র খাবারে বিষ মিশ্রিত করে তাঁকে শহীদ করা হলো। (আনোয়ারুল বয়ান, ১ম খন্ড, পৃ:১৫৬)

ইমাম হাসান (রা.)’র অমূল্য বাণী

হযরত ইমাম হাসান (রা.) এরশাদ করেন, আল্লাহর রাস্তায় কোন ভাইয়ের অভাব পূরণ করে দেওয়া আমার নিকট এক মাস ইতিকাফের চেয়েও উত্তম। (খোলাফায়ে রাশেদীন, পৃ: ৫৩৫)

শিক্ষাদীক্ষা

নবীজি রাহমাতুল্লীল আলামীনের ওফাতের সময় হযরত ইমাম হাসান’র বয়স ছিল সাড়ে সাত বৎসর। শেরে খোদা, মুশকিল কোশা, হযরত মাওলা আলী (রা.)’র অতলান্ত বিস্তৃত জ্ঞান সমুদ্রের তিনি ওয়ারিশ ছিলেন। তিনি বাল্যকাল থেকে নবীজির সান্নিধ্য প্রাপ্ত খাতুনে জান্নাতের সার্বিক তত্বাবধান ও মাওলা আলী (রা.)’র নিবিড় পরিচর্যায় জ্ঞান প্রজ্ঞায় ও পান্ডিত্যে গভীর ব্যুৎপত্তি ও পূর্ণতা অর্জন করেন। হাদীস শরীফের কিতাবগুলোতে তাঁর বর্ণিত তেরটি হাদীসের সন্ধান পাওয়া যায়। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড ১ম, পৃ: ১৫৭)

আল্লামা ইবনে হাজর হায়তমী মক্কী (র.) বর্ণনা করেন, ইমাম হাসান (রা.) রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশায় ছিলেন সাত বছর, পিতা হযরত মাওলা আলী (রা.)’র সাথে ৩০ বৎসর। ছয় মাস খলিফাতুল মুসলেমীন ছিলেন, তারপর সাড়ে নয় বছর মদীনা মনোওয়ারায় অবস্থান করে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন। (আস সাওয়ায়েকুল মুহরাকা, পৃ: ৩৪৬)

খলিফা হিসেবে হযরত ইমাম হাসান (রা.)

হযরত ইমাম হাসান (রা.) স্বীয় পিতা হযরত মাওলা আলী (রা.) শাহাদাতের পর খেলাফতে রাশেদার পঞ্চম খলিফা ছিলেন। তিনি প্রায় ৬ মাস খলিফা হিসেবে ইসলামী খিলাফতে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

ইমাম হাসান (রা.)’র কারামত

ইমাম হাসান (রা.)’র অসংখ্য কারামত রয়েছে, একদা ইমাম হাসান (রা.)’র সাথে কোন এক সফরে হযরত যুবাইর (রা.) তার এক পুত্র সঙ্গে ছিল। তাঁরা কোন এক খেজুর বাগানের নিকটে গিয়ে বসেন খেজুর বৃক্ষটি শুকিয়ে গিয়েছিল ইবনে যুবাইর বললেন এ খেজুর বৃক্ষটি যদি জীবিত থাকতো আমরা তা থেকে খেজুর খেতে পারতাম। হযরত ইমাম হাসান (রা.) বললেন, তুমি কি তাজা খেজুর খেতে ইচ্ছে করছো? ইবনে যুবাইর বললো হ্যাঁ, হযরত ইমাম হাসান দু হাত তুলে দুআ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে খেজুর বৃক্ষটি সবুজ হয়ে যায় তাতে খেজুরও দেখা যায়। লোকেরা গাছে উঠে খেজুর ছিড়ে নিল, সবাই পেটভরে খেয়ে নিল। (শাওয়াহেদুন নবুওয়াত, পৃ: ৩০২, কারামাতে আহলে বায়তে আতহার, পৃ: ৩৬)

ইন্তেকাল

তিনি ৪৫ বৎসর ৬ মাস কিছু দিন বয়সে ৫ রবিউল আউয়াল শরীফ ৪৯ হিজরিতে মদীনা মুনাওয়ারায় ইন্তেকাল করেছেন। জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে আম্মাজান সৈয়্যদা ফাতেমা যাহরা (রা.)’র পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। হযরত সাঈদ ইবনুল আস (রা.) তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন। (আসসাওয়াহেকু মুহরাকা, পৃ: ৩৪৬, তারিখুল খোলাফা, সাওয়ানেহে কারবালা, পৃ: ৬১,৬২, খুতবাতে মুহররম, পৃ: ২৭৮, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড ১ম, পৃ: ১৫৯)

মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহলে বায়তের আদর্শ আমাদের নসীব করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী)
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।