গাউসে দাঁওরা হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী (রহঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
সংগ্রহে: আহমদ শাহ আদীল
“মানছে গােয়াম শরহে ওয়াছফে আঁ জনাব আফতাবস্ত, আফতাবস্ত, আফতাব।”
অর্থাৎ, আমি সে সম্মানিত ব্যক্তির গুণাবলীর কি ব্যাখ্যা দেব, তিনিই সূর্য, সূর্যই সুর্য।
জন্ম:
গাউসিয়াতে কোবরা ও বেলায়তে ওজমা’র উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত মহান সাধক হযরত ফকির মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির ঔরসে ১২৬২ হিজরিতে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জিলার হরিপুর শহরের নিকটবর্তী চৌহর শরীফে আব্দুর রহমান চৌহরভী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত খিজির আলায়হিস সালাম থেকে ফয়ূজাত লাভ করায় তিনি সকলের নিকট খিজিরী উপাধি নিয়ে পরিচিত হন।
পিতা হারানো:
হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভে সমর্থ হননি। শুধুমাত্র পবিত্র কুরআন শরীফ পড়তে জানতেন। তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন পিতা হযরত ফকির মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, ‘এক কোষে দুই তলােয়ার রাখা যায় না, এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি কিছুদিনের মধ্যে স্রষ্টার সান্নিধ্যে গমন করেন।
রিয়াজত ও চিল্লা:
আট বছর বয়সে তিনি ‘চিল্লা’ সাধনা করার ইচ্ছা পােষণ করে কেউ তাঁকে সেবা করতে চান কিনা জানতে চাইলে প্রতিবেশী একজন তাঁর ‘খেদমত’ করবেন বলে ওয়াদা করলেন। হুযূরের নির্দেশ মতাে পাশে একটি ‘থালা’ রাখা হলাে, প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট সময়ে তিনি থালায় রক্ত বমি করতেন। পানাহার সম্পূর্ণ বন্ধ। একসময় শরীরের এমন জীর্ণ দশা হল যে, রক্তবমির বদলে পানি বমি হতে লাগল। এভাবে চল্লিশ দিন পূর্ণ হলে বমি বন্ধ হল। এ রকম অকল্পনীয় ও অভাবনীয় রিয়াজত দেখে এলাকাবাসী বিস্মিত হন। এ থেকে সকলেই নিশ্চিত হল যে, এ ছেলেটি ভবিষ্যতে মস্তবড় ওলী’ হবেন।
রূহানী ফয়েজ হাসিল ও বায়াত গ্রহণ:
এ রকম কষ্টসাধ্য রিয়াজত দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক ত্রুটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও নিশ্চিত হয়ে পরিপূর্ণ রূহানী শক্তি হাসিল হয়। চাশতের নামাযের সময় হযরত আখুন ছাহেব হুজরার দরজা খুলে খাদেমকে নির্দেশ দিলেন “আগত মুসাফিরদের মধ্যে হাজারা জিলার এক ব্যক্তি আছেন তাকে খোঁজ করে নিয়ে এসাে।” খাদেম ভিড়ের মধ্যে হাজারা জিলার কেউ আছেন কি, তাঁকে হযরত আখুন ছাহেব স্মরণ করেছেন। তালাশকারী কোলে করে হুযূরকে হযরত আখুন ছাহেবের হুজরায় নিয়ে যান। বেলায়তের সূর্য হযরত চৌহরভী ছাহেবকে দেখেই হযেরত আখুন ছাহেব পশতু ভাষায় দাগাদি, দাগাদি, দাগাদি, অর্থাৎ ইনিই তিনি, ইনিই তিনি, ইনিই তিনি, যাঁকে আমি তালাশ করছি। সুবহানাল্লাহ!
হযরত আখুন ছাহেব বললেন, “ওহে বেলায়তের পরশমনি, দোয়া কর।” হযরত চৌহরভী ফরমান ‘হযরত আখুন ছাহেব যখন হাত উঠালেন তখন মনে হল সমস্ত আসমানের বােঝা আমার ওপর ন্যস্ত হল। যখন দোয়া শেষ করলেন, তখন ওই বােঝা মহা আনন্দের কারণ হল: এক জামানা ছােহবতে বা-আউলিয়া বেহতর আজ ছদ ছালাহ তা-আত বে-রিয়া এক মুহূর্ত আউলিয়া কেরামের সঙ্গ লাভ করা শত বছরের কবুল হওয়া ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। তিনি স্বপ্নযােগে রাতে কিছু দেখেছেন কিনা জানতে চাইলেন হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে। প্রত্যুত্তরে বললেন, হ্যা, তাঁর চিল্লাস্থলটিই দেখেছেন, “আপনি ওখানেই অবস্থান করুন, অন্য কোথাও যাবেন না। পীর ছাহেব আপনার বাড়িতে এসে আপনাকে মুরিদ করাবেন।” কিছুদিন পর ‘নুরে মােতলাক’ হযরত এয়াকুব শাহ গিনছাতরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কাষ্মীর হতে হাজারা জিলায় নির্দিষ্টস্থানে চৌহর শরীফে এসে খাজা আবদুর রহমান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’কে বায়াত করান।
জাহেরী শিক্ষা:
হযরতের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছিল না। পবিত্র ‘কুরআন’ পাঠ করতে ও লিখতে পারতেন। মােটামুটি ‘কুরআন’ পাঠ শিক্ষা উস্তাদের নিকট থেকে হলেও প্রচলিত ইলমে হাদিস, তাফসীর, ফিকহ, উসুল ইত্যাদি শিক্ষা কোন জাহেরী উস্তাদ হতে লাভ করেন নি এবং লিখার পদ্ধতিও কোন শিক্ষকের নিকটে শিখেন নি। তিনি অল্প বয়সে সম্মানিত পিতা হযরত ফকির মুহাম্মদ খিজরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির স্থলাভিষিক্ত হয়ে ‘গাউসিয়াত’ ও কুতুবিয়াত’র সর্বোচ্চ পদে আসীন হন। তিনি স্বল্প ও মিষ্ঠভাষী ছিলেন। শ্রুতিমধুর বাক্যালাপে সিলসিলার কার্যাদি সমাপ্ত করতেন। অনর্থক কথা-বার্তা বলতেন না। একদিন এক মাওলানা জটিল মাসআলার সমাধান খুঁজতে হুজুরের নিকট আসলে অতি সরল পদ্ধতিতে সমাধান করে দিলেন এবং এ কথা কাউকে না বলার জন্য অছিয়ত করলেন। তিনি ‘জজবাত’ ও ‘জালালিয়াত মুক্ত ছিলেন।
তাঁর অনবদ্য রচনা মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসুল (দঃ)
তাঁর অবিস্মরণীয় কিতাব দরূদ সম্বলিত ত্রিশপারা ‘মুহাইয়্যিরুল উকুল ফী বয়ানে আওছাফে আকলিল উকুল’ মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) অনেক বছর পূর্বে লেখা হলেও জীবদ্দশায় তিনি এটা লুকিয়ে রাখেন।
ইন্তেকালের কয়েক বছর পূর্বে রেঙ্গুন (ইয়াংগুন) প্রবাসী প্রধান খলিফা হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটির নিকট জানালেন এ অপূর্ব বিস্ময়কর সৃষ্টির কথা। এটা বােখারী শরীফের মতাে ত্রিশপারা সম্বলিত, পারাগুলাে কুরআন শরীফের পারা হতে একটু বড়। এ বিশাল দরূদ শরীফ লেখা সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল ১২ বছর ৮ মাস ২০ দিন অথচ ঘুর্ণাক্ষরেও এটা প্রণয়নের কথা কেউ জানতে পারেননি।
স্বভাব ও চরিত্র:
বিশ্বখ্যাত এ ওলীর বাসগৃহ ছিল কাঁচা, ছাদ ছিল ফুটো, বৃষ্টির পানিতে ঘরের ভিতরে পানি এসে গেলে রাতে তিনি থালায় করে পানি বাইরে ফেলতেন। মেহমানদের আপ্যায়ন করতে তিনি অধিক মনােযােগী থাকতেন। ঘরে তৈরি রুটি তরকারি নিয়ে তিনি প্রতিদিন খানকায় যেতেন। অবশিষ্ট থাকলে খাওয়া হতাে, না হয় উপােস থাকতেন। দ্বীনি এলম শিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর আন্তরিক মুহাব্বত ছিল। হুযুরের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা-এ ইসলামিয়া রহমানিয়া হরিপুরের ছাত্রদের জন্য লঙ্গরখানা হতে রুটি পাঠানাে হতাে। তিনি সর্বদা খদ্দরের কাপড় পরিধান করতেন। হুজুর ২টি জিনিষ হতে তাওবা করেছিলেন। ১. ‘কাশফ’ হতে, ২. নিজের প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি হতে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সংযমী ও চরম ধৈর্যশীল। অভাবগ্রস্ত লােকদের সান্নিধ্য বেশী পছন্দ করতেন, আলেম ও ফকির দরবেশ আগমন করলে তাদের সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতেন, সাক্ষাতের কোন নির্দ্ধারিত সময় ছিল না। যে কোন সময় যে কেউ দেখা করতে পারতেন।
কাশফ ও কারামতঃ
হুযূর একদিন একস্থানে বিশ্রাম করছিলেন, সে সময় একজন লােক এসে গােসল করলাে, হুযুর তাকে বললেন, তুমি জেনা করেছ? লােকটি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে হুজুরের নিকট ক্ষমা চাইলাে। সঙ্গে সঙ্গে হুজুরের ভাবান্তর ঘটে, আল্লাহ পাক বান্দার পাপ কাজ দেখেও গােপন রাখেন, আর আমি আল্লাহর বান্দাদের গােপন দোষ- ক্রটি প্রকাশ করে দিচ্ছি। ওই দিন হতে হুজুর কাশফ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকেন। একদা, হুজুরের ছাহেবজাদা মুহাম্মদ ফজলে সােবহান জনৈক ব্যক্তির পরামর্শে জিজ্ঞেস করলেন হুজুরের পর কে গদীনশীন হবেন? একথা শুনে খুবই ক্রোধান্বিত হয়ে হুজুর বললেন, গাধা বসে, আমিত চাটাইতে বসার লােক। এক ভক্ত ‘গাউসে জমান’ কি জানতে চাইলে হুজুর বললেন সামনের ‘তুত’ গাছটিকে হেঁটে চলে আসতে হুকুম করলে চলে আসবে। কথা শেষ হতে না হতেই ‘তুত’ গাছটি শিকড় সমেত হাটা শুরু করে দিলে হুজুর ‘তুত’ গাছকে বললেন গেড়ে যেতে, তােমাকে আসতে বলিনি এ লােকটিকে দৃষ্টান্ত দেখালাম। সুবহানাল্লাহ!
সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মূল্যায়নঃ
তাঁর মধ্যে হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম’র উদ্দীপনা ও কর্মক্ষমতা বিদ্যমান ছিল। তিনি যখন যে ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে যে অবস্থারই প্রতিফলন ঘটাতে ইচ্ছে করতেন অতি সামান্য নেক নজরে তা সম্পন্ন করতেন এবং কামালিয়াতের ওপর পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও আধিপত্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁর রচিত অবিস্মরণীয় দুরূদ শরীফের অমূল্য কিতাব মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রত্যেকটি ছত্রে প্রিয় নবীজির কোন না কোন বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলীর বর্ণনা করা হয়েছে। সমগ্র কিতাবে চারিত্রিক সৌন্দর্য, মাধূর্য ও বৈশিষ্ট্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।
এ গ্রন্থ হুজুর চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির ইলম ও মারিফাত সমুদ্রের একটি বিন্দুমাত্র; যা তাঁর ইন্তেকালের পর বিশ্ববাসীর সামনে মহান আল্লাহর রহমত ও করুণার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ উন্মােচিত হয়েছে এবং উত্তম হচ্ছে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফ। এ গ্রন্থের আওরাদ ওজিফাগুলাে প্রায় ১০০টি নির্ভরযােগ্য কিতাব হতে সংকলিত। দুরূদ শরীফ রচনার এ অভিনব পদ্ধতি তাঁর নিজস্ব আবিস্কার। অদ্যাবধি কোন দুরূদ শরীফ রচয়িতার মধ্যে এমন রচনাশৈলী বিরল। এটা অধ্যয়নে তাফসীর, উসুলে তাফসির, হাদীস ও উসুলে হাদীস, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, মানতেক, দর্শন প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞান অধ্যয়ন ও বুঝার সক্ষমতা সৃষ্টি হয়। এখানে এমন কিছু বিষয় আছে যা শুধু হুজুর চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সাথেই সম্পৃক্ত ও নির্দিষ্ট। এ মহান মুর্শিদের জ্ঞান ‘কামালিয়াতের স্তর ও কারামতের বর্ণনা দেয়া দুঃসাধ্য। কেননা যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন গাউসে জমান আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কবির ভাষায় ব্যক্ত করেছেন- মানছে গােয়াম শরহে ওয়াছফে আঁ জনাব আফতাবস্ত, আফতাবস্ত, আফতাব। আমি সে সম্মানিত ব্যক্তির গুণাবলীর কি ব্যাখ্যা দেব, তিনিই সূর্য, সূর্যই সুর্য।
দীদারে ইলাহী:
এ মহান পথ প্রদর্শক, মা’আরেফে লুদুন্নিয়ার প্রস্রবণ খাজায়ে খাজেগান গাউসে দাঁওরা হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী (রঃ)১ জিলহজ্ব ১৩৪২ হিজরি রােজ শনিবার বাদ নামাজে মাগরিব ইন্তেকাল করেন।