জীবনী

ইমাম শেরে বাংলা আল্লামা গাযী সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (রা.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী

আল্লামা এম.এ মান্নান, বিশিষ্ট গবেষক ও রাজনীতিবিদ

কোন আদর্শ এবং ওই আদর্শের অনুসারী জনগােষ্ঠীর যখন ক্রান্তিকাল অতিবাহিত হয়, যুগােপযােগী ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে যখন ওই আদর্শ ও আদর্শের অনুসারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিরুদ্ধবাদী চক্র যখন তৎপর হয়ে নিজেদের অবস্থান গড়ে নেয় এবং ওই আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সেটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সমাজে আদর্শ বিরােধী মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়, তখন ওই আদর্শের কোন প্রকৃত কর্ণধার নির্বিকার হয়ে বসে থাকতে পারেন না। তখন তিনি ওই সব প্রতিকূলতা ও আশঙ্কার সফল মােকাবেলার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন, পালন করেন অতন্দ্র সিপাহসালারের ভূমিকা। এদেশে সুন্নিয়াতের ইতিহাসে ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হিও এমনি একজন প্রকৃত কর্ণধার (ইমাম) ছিলেন। সুন্নিয়াতের ক্রান্তিকালে তিনিও সুন্নিয়াতের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও অসাধারণ ত্যাগের চির অম্লান উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আদর্শের সৈনিকরা তাঁর আদর্শ জীবন থেকে সত্য প্রতিষ্ঠার ও বাতিলের মােকাবেলার অনুপ্রেরণা লাভ করেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর মধ্যে বংশীয় গৌরব, জ্ঞান-গভীরতা, আত্মবিশ্বাস ও অসাধারণ সৎসাহসসহ বহু গুণ ও বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন। তিনি বেলায়তের উঁচু মর্যাদারও অধিকারী ছিলেন।

জন্ম

আল্লামা গাযী শেরে বাংলা বিগত ১৩২৩ হিজরী/১৯০৬ ইংরেজীর একটি বিশেষ দিনের এক শুভ মুহূর্তে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার মেখল গ্রামে এক সন্ত্রান্ত ‘সাইয়্যেদ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত সাইয়্যেদ আবদুল হামীদ আল-কাদেরী এবং দাদা হযরত সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হাশমত উল্লাহও ছিলেন যুগখ্যাত আলিম-ই দ্বীন ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তাঁর আম্মাজান সাইয়্যেদা মায়মুনা খাতুনও ছিলেন বিদূষী, পুণ্যবর্তী ও রত্নগর্ভা। পিতা ও মাতা উভয়ের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন খাঁটি আওলাদে রসূল।

 

শিক্ষাজীবন

 

হযরত আল্লামা আজিজুল হক আল্-কাদেরী ছিলেন অসাধারণ মেধাশক্তি ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী। তিনি স্থানীয় মাদ্রাসাগুলাে থেকে নিয়মিতভাবে অধ্যয়ন করে টাইটেল পাশ করার পর ভারতের প্রসিদ্ধ ফতেহপুর মাদরাসা থেকে হাদীস ও ফিক্বহ ইত্যাদি শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। পুঁথিগত ও অধ্যয়নগত শিক্ষায় তিনি ছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী আলিম-ই দ্বীন। ভারতে অধ্যয়নকালে তিনি দেওবন্দ মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকমণ্ডলীর জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে জানার জন্য সেখানে যান। বাংলাদেশসহ এতদঞ্চলে প্রসারিত ওহাবিয়াতের সুতিকাগার এ দেওবন্দ মাদরাসার অবস্থান যাচাই করা ভবিষ্যতে তাঁর কর্মময় জীবনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ এতদৃঞ্চলের মুসলিম সমাজ থেকে ইসলামী আল-খেল্লা পরিহিত, আল্লাহ ও রসূলের দুশমনদের উৎখাত কিংবা চিহ্নিত করে সুন্নিয়াতের পতাকাকে উড্ডীন করতে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি প্রথমে ছাত্র বেশে দেওবন্দ মাদরাসায় গিয়ে মুহাদ্দিস আশফাকুর রহমান সহ তাদের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় শিক্ষকদের মুখােমুখি হন। তারা তাঁকে ভর্তিচ্ছু ছাত্র মনে করে কতিপয় প্রশ্ন করেন। তিনি তাদের সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব দেন। অতঃপর তাদের অনুমতি নিয়ে তিনিও কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। কিন্তু তারা তাঁর একটি প্রশ্ন ব্যতীত বাকী প্রশ্নগুলাে এড়িয়ে যান। সুতরাং তিনি ওই দিনই বলে এসেছিলেন, “আল্-হামদু লিল্লাহ! আমি আপনাদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ নয়, বরং আপনাদেরকে শিক্ষা দেওয়ারই উপযােগী।” তিনি তা-ই করেছিলেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। ওহাবী-দেওবন্দীসহ সমসাময়িক সব ধরনের বাতিলের সফল মােকাবেলা করেছিলেন তিনি।

জ্ঞানগত দক্ষতা

আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির দৃঢ় প্রত্যয় ছিলাে যে, তিনি জ্ঞানাস্ত্র দ্বারাই সত্য প্রতিষ্ঠা ও সব ধরনের বাতিলের মােকাবেলা করবেন। তাই তিনি প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক ও পঁথিগত শিক্ষার ক্ষেতত্রে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হন। তাছাড়া আল্লাহ তা’আলা তাঁকে ইলমে লাদুন্নী দ্বারাও সমৃদ্ধ করেছিলেন। এক শুভ মুহুর্তে তিনি হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালাম-এরও সাক্ষাৎ পেয়ে যান। হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালাম তাঁর সাথে সস্নেহে আলিঙ্গন করেন এবং পবিত্র হাদীস শরীফ থেকে চারটি সবক পড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। এর মাধ্যমে তাঁর মধ্যে ইলমে লাদুন্নীও স্থান পায়। তদুপরি তাঁর ধমনীতে ছিলাে নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র বংশের রক্ত, হৃদয়ে ছিলাে অকৃত্রিম খােদা ও রসূলপ্রেম। অধিকন্তু তাঁর মধ্যে ছিলোে অসাধারণ ও নির্ভূল জ্ঞানানুসারে আমল করার অদম্য স্পৃহা। আরাে ছিলোে রূহানী শক্তি। সর্বোপরি, কুদরতিভাবে তাঁর মধ্যে খােদাপ্রেম ও ইশকে রসূল এমনভাবে স্থান পেয়েছিলাে যে, আল্লাহ্-রসূলের শানমান রক্ষার জন্য তিনি সত্যিকার অর্থে সব সময় অতন্দ্র-সচেষ্ট ও অকুতােভয় ছিলেন। এর ফলে তিনি তজ্জন্য নিজের জীবনের সবকিছু, এমনকি নিজের প্রাণটুকু পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্বিধাবােধ করেন নি। আল্লামা গাযী শেরে বাংলা ছিলেন জ্ঞানসমুদ্র। তিনি ইলমে লাদুন্নী দ্বারাও সমৃদ্ধ তাে ছিলেনই। যাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানের এ অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর মধ্যে। আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় ছিলাে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। ফার্সী ও উর্দূ ভাষায় তিনি উচ্চাঙ্গের কবি ছিলেন, ‘দীওয়ান-ই আযীয’ শরীফই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

 

কর্মজীবন

 

ভারত থেকে তিনি দেশে ফিরে দ্বীন ও মাযহাবের খিদমতে আত্মনিয়ােগ করেন। তাঁর কর্ম জীবনে দেখা যায় যে, রসূলে পাকের সুন্নাত পালনের জন্য তিনি বিবাহ-শাদী করেছেন। সত্য, কিন্তু যাবতীয় যােগ্যতাকে পুঁজি করে পার্থিব জীবনকে বর্ণাঢ্য করার দিকে তাঁর কোন আগ্রহই ছিলাে না। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি একথাই প্রমাণ করেছেন- “মাইতাে বীমারে নবী হোঁ!” (আমি তাে নবীর প্রেমরােগেই ভুগছি)। এ জন্য তিনি কতগুলোে বাস্তব ও ফলপ্রসু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছেন। স্বদেশে এসে তিনি দেখতে পান-

প্রথমতঃ এদেশে প্রকৃত দ্বীনি শিক্ষা (সুন্নী মতাদর্শের শিক্ষা)’র ব্যাপক প্রসার একান্ত দরকার। দ্বিতীয়তঃ মুসলিম সাধারণকে ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমেও হিদায়ত করা যেতে পারে। তৃতীয়তঃ বিক্ষিপ্ত সুন্নী মুসলমানদেরকে সুসংগঠিত করা প্রয়ােজন। চতুর্থতঃ রাজনৈতিক এবং সামাজিক অঙ্গনেও সুন্নীদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। পঞ্চমতঃ ভারতের দেওবন্দ মাদরাসা থেকে শিক্ষা ও দীক্ষা নিয়ে এসে কতিপয় লােক এদেশের বিভিন্ন এলাকায় ওহাবী-খারেজী মাদরাসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে বিনা বেতনে ও ফ্রি খােরপােষ দিয়ে এদেশের গরীব ও অসচেতন মুসলমানদের সন্তানদের ওহাবী-দেওবন্দী ভ্রান্ত চিন্তাধারায় শিক্ষিত ও উদ্ধুদ্ধ করার যেসব পাঁয়তারা চালাচ্ছিল সেগুলাে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা দরকার। উল্লেখ্য, বর্তমানে তাদের এ তৎপরতা এক আশঙ্কাজনক আকার ধারন করেছে। ষষ্ঠতঃ মি. মওদূদীর মারাত্মক ভ্রান্ত চিন্তাধারা রাজনীতির আদলে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করার যে অশুভ পাঁয়তারা চলছিলাে, সে সম্পর্কেও এ দেশের মানুষকে সচেতন করতে হবে। সপ্তমতঃ এদেশে কাফির ভণ্ডনবী গােলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারীরাও যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছিলো সেগুলো সম্পর্কে এদেশের মানুষকে সতর্ক করে দেওয়া আবশ্যক। অষ্টতমঃ ইসলামের সঠিক রূপরেখা (সুন্নী মতাদর্শ) প্রতিষ্ঠা এবং এর পরিপন্থী মতবাদগুলাের সফল মােকাবেলা করার জন্য শুধু আলিম তৈরি করে ক্ষান্ত না হয়ে তাঁদেরকে মুনাযির (তর্কযােদ্ধা) এবং সৎসাহসী করে তােলারও বিকল্প পথ নেই। নবমতঃ সুন্নীদের মধ্যে কোন উদাসীনতা ও সুন্নীয়তের প্রতি অপবাদ আসে এমন কিছু থাকলে সেগুলাের সংশােধন করারও প্রয়ােজন। দশমতঃ এদেশে ইসলাম প্রচারকারী অগণিত পীর-মুর্শিদের সন্ধান দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার মুসলিম সমাজকে ওইসব শরীয়ত ও তরীক্বতের কেন্দ্রগুলােতে কেন্দ্রীভূত করা অত্যন্ত ফলদায়ক হবে। একাদশতঃ সুন্নী সমাজে লেখনীর চাহিদা পূরণের প্রয়ােজনও অনস্বীকার্য ইত্যাদি। সুতরাং তিনি কালক্ষেপণ না করে এসব ক’টি বিষয় বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিলেন এবং বাস্তব ক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন। তাঁর সুচিন্তিত পদক্ষেপগুলােও ছিলো নিম্নরূপ:

 

প্রথমতঃ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর কর্মজীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বীন ও মাযহাবের প্রকৃত শিক্ষার প্রসারের দিকে মনযােগ দিলেন। তিনি ১৯৩২ ইংরেজীতে নিজ গ্রাম মেখলের ফকিরহাটে ‘এমদাদুল উলূম আজিজিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠা করে তাতে নিজেও শিক্ষকতা আরম্ভ করেন এবং তাঁর সঙ্গে দক্ষ সুন্নী-ওলামাকেও দ্বীনী শিক্ষার প্রসারে উদ্ধুদ্ধ করেন। তাছাড়া, ‘হাটহাজারী জামেয়া আজিজিয়া অদূদিয়া সুন্নিয়া বর্তমানে, ‘অদুদিয়া সুন্নিয়া’, ‘রাউজান ফতেহ নগর অদূদিয়া সুন্নিয়া’, রাঙ্গুনিয়ার ‘চন্দ্রঘােনা অদূদিয়া সুন্নিয়া’ (বর্তমানে চন্দ্রঘানা তৈয়্যবিয়া অদূদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা) এবং লালিয়ারহাট হামিদিয়া হুসাইনিয়া রায্যাকিয়া মাদরাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা পালন করেন।তাছাড়া,জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম এবং সোবহানিয়া আলিয়া মাদরাসা, চট্টগ্রাম’র মতাে শীর্ষস্থানীয় দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তিনি একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানেই যারা সুন্নী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন, সেখানে তাঁদের প্রায় সবারই প্রতি তিনি যথেষ্ট আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ লেখনী দেওয়ান-ই আযীয’- এ এ প্রসঙ্গে যাথেষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়।

 

দ্বিতীয়ত: ওয়াজ-নসীহতঃ বলাবাহুল্য, তখনাে সরলপ্রাণ সাধারণ মুসলমানদের, বিশেষ করে দ্বীনী শিক্ষার আলাে পাবার অন্যতম প্রধান উপায় ছিলাে ওলামা-ই কেরামের শিক্ষাদান ও ওয়াজ-নসীহত। আল্লামা গাযী শেরে বাংলার ওয়াযের প্রভাব ছিলাে অকল্পনীয়। তাঁর নির্ভীক বর্নাভঙ্গি, আকর্ষণীয় কণ্ঠ ও হৃদয়গ্রাহী যুক্তি-প্রমাণ শ্রোতাদের মনে অকল্পনীয়ভাবে রেখাপাত করতে। তিনি যেদিকেই যেতেন জ্ঞান-পিপাসুদের ঢল নামতাে। তিনিও ওয়াজ-নসীহতের প্রতি অতি আন্তরিকতা প্রদর্শন করতেন। উদ্যোগীদের আহবানে, দ্বীনী প্রয়ােজনে, দ্বীনের আলাে বিকিরণের জন্য তিনি চলে যেতেন দূর-দূরান্তরে। তাঁর ওয়ায মাহফিলগুলােও ছিলাে ওলামা-সাধারণের জন্য একেকটা নির্ভুল শিক্ষাক্ষেত্র। কারণ, তাঁর যুক্তি-প্রমাণগুলাে ছিলাে তার় বিরল ও সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও তথ্য ভাণ্ডারের নির্যাস। ওইগুলাে সাধারণ মানুষকে।করতে তৃপ্ত আর ওলামা ও জ্ঞানী সমাজকে করতাে আরাে জ্ঞানসমূদ্ধ।

 

তৃতীয়ত: তর্কযুদ্ধঃ বলাবাহুল্য, যেসব এলাকা বা অঞ্চলের সুন্নী মুসলিম সমাজ বাতিলমুক্ত ছিলাে তাদের জন্য তাে সুন্নী ওলামা-ই কেরামের ওয়ায-নসীহত ও শিক্ষাদান অনায়াসে ঈমানের সজীবতা, জ্ঞান ও আমলের সৌন্দর্য দান করতাে, কিন্তু যেসব এলাকায় ওহাবী-দেওবন্দীগণ (অবশ্য মওদূদী, কদিয়ানী ও শিয়া ইত্যাদি তখনাে এতদঞ্চলে তেমন পরিচিত ছিলাে না) তাদের অবস্থান গড়ার জন্য তৎপর ছিলাে, সেসব এলাকার সুন্নীগণ ওইসব বাতিলের কথাবার্তায় গরমিল ও বিভ্রান্তি অনায়াসে বুঝতে পারতেন। তাই, সচেতন সুন্নী মুসলমানগণ ওই ওহাবী মৌলভীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারতেন। আর তাদেরকে তর্কযুদ্ধের সম্মুখীন হতে যুক্তিগতভাবে বাধ্য করা হতাে। কারণ, দবান ও মামহাবের ক্ষেত্রে তাদের বিভ্রান্তি ছড়ানাের ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছিল। সুতরাং প্রকাশ্যে উভয় পক্ষের আলিমগণ তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে উভয়ের ত্ক ও আলােচনার ফলে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে যুগান্তকারী মীমাংসা হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। তদুপরি, দ্বীনের অসাধারণ জ্ঞান-সমৃদ্ধ আল্লামা গাযী শেরে বাংলাও নির্দিধায় ওহাবীসহ যাবতীয় বাতিলপন্থীকে তর্ক- মুনায়ারার দিকে আহবান করতেন। এভাবে জনসাধারণের চাপের মুখে কিংবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওহাবী ও কাদিয়ানী মতবাদীরা তকযুদ্ধে অবতীর্ণ হতাে। আল্লামা গাযী শেরে বাংলাই বেশীরভাগ তর্কযুদ্ধে সুন্নীদের পক্ষে অংশগ্রহণ করতেন। চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের বাইরে গিয়েও তিনি বিশাল বিশাল মুনাযারা সভায় নির্ভীকচিত্তে উপস্থিত হয়ে ওইসব বাতিলের সাথে তর্কযুদ্ধ করেছেন এবং প্রতিটি মুনাযারা থেকে তিনি বিজয়ী বেশে ফিরে আসেন। এসব মুনাযারার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকা, এমনকি দেশের গােটা মুসলিম সমাজ একথা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, সুন্নী মতাদর্শই ইসলামের একমাত্র সঠিক রূপরেখা। তাঁর এইসব বিজয়ের ফলে সুন্নীরা হয়েছে বহুগুণ বেশী উৎসাহী, আর সৌভাগ্যক্রমে অনেক বাতিলও তাওবা করে ওহাবিয়াত ইত্যাদি ত্যাগ করে সুন্নী হয়ে গেছে। আর যাদের ভাগ্যে হিদায়ত নেই তারা হয়ে রয়েছে ধর্মীয় অঙ্গনে একেকটা ভ্রান্ত সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত। ওইসব মুনাযারার মধ্যে তাঁর নিজ এলাকা পূর্ব মেখল, আনােয়ারার রুস্তমহাট, বাশখালীর বেলতলী, হাটহাজারীর মদনহাট, ফতেহপুর, মুহুরীহাট, মির্যাপুর ও কুমিল্লার আদালত ভবন ইত্যাদির মুনাযারা অতি প্রসিদ্ধ ও যুগান্তকারী ছিলো। তাছাড়া, গত শতাব্দির ৪০ দশকের প্রারম্ভে চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদে ক্বাদিয়ানীদের সাথেও এক যুগান্তকারী মুনাযারা (তর্কযুদ্ধ) অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। এতেও আল্লামা গাযী শেরে বাংলা অন্যতম প্রধান তর্কযােদ্ধা হিসেবে ছিলেন। এ মুনাযারায়ও সুন্নীরা আশাতীতভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওই তর্কযুদ্ধের ফলে বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে কাদিয়ানীরা প্রায় সম্পূর্ণ উৎখাতই হয়ে গেছে। আর সমস্ত দেশবাসী ক্বাদিয়ানীদের বে-দ্বীনী কুফরী সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছেন। আজ সবাই জানে যে, জামায়াতে ইসলামী’র প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদূদী একজন মহাভ্রান্ত লােক। তিনি যখন চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে জনসভা করার জন্য আসলেন তখন আল্লামা গাযী শেরে বাংলা অনেকটা একাকী গিয়ে তার ভ্রান্ত মতবাদগুলােকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। মওদূদী লা-জাওয়াব হয়ে সভা না করে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। ফলে তার ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা জনসমক্ষে একেবারে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। তাছাড়া, হজ্জের সফরে, ওহাবিয়াতের মূল সূতিকাগার সুদূর সৌদী আরবের নজদী- মুফতীদেরকেও আল্লামা গাযী শেরে বাংলা শােচনীয়ভাবে পরাজিত করে সুন্নী মতাদর্শের সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন। তবুও তদানীন্তন সৌদী সরকার তাঁকে তাঁর জ্ঞানগত যোগ্যতা ও অদম্য নির্ভিকতা ইত্যাদির ভিত্তিতে ‘শায়খুল ইসলাম’ এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় আলিমগণ সর্বসম্মতভাবে তাঁকে শেরে বাংলা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মােটকথা, তিনি একথা দিবালােকের ন্যায় স্পষ্ট করে গেছেন যে, সত্যের অনুসারীরা যদি সঠিক জ্ঞানার্জন করেন এবং তদসঙ্গে তাদের মধ্যে থাকে অকৃত্রিম ইশকে রসূল, আর তারা যদি দ্বীন-মাযহাবের প্রতি বিশেষ আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন, তাদের অন্তরে থাকে সৎসাহস, আর এ সৎসাহসের সাথে তারা বাতিলকে চ্যালেঞ্জ করেন, তবে সত্যের জয় অনিবার্য। এতে তখন একদিকে তাঁদের দৃঢ় ঈমানের পরিচয় পাওয়া যায়, অন্যদিকে বাতিলের তসমা দ্রুত অপসারিত হয়ে সেখানে সত্যই প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

 

চতুর্থত: অসাধারণ ত্যাগস্বীকারঃ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা সুন্নিয়াতের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার মােকাবেলায় কখনাে পার্থিব কোন কিছুকে প্রাধান্য দেননি। একদা তিনি ঘরে মৃত শিশু-সন্তানকে এক নজর দেখে দাফন করার জন্য অনুমতি দিয়ে মুনাযারায় চলে গিয়েছিলেন। যাবতীয় আয়ের বেশীর ভাগ ব্যয় করতেন তাঁর বিরুদ্ধে ওহাবীদের কৃত মামলা-মুকাদ্দমা চালাতে এবং ধর্মীয় কার্যাদিতে। তিনি ইনতিকালের সময় বিশেষ কোন সম্পদ কিংবা নগদ টাকা পয়সা রেখে যান নি। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুনাযারাগুলােতে নিয়মিতভাবে ওহাবীরা শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে আসছিলাে। তাছাড়া, অব্যাহত গতিতে সুন্নিয়াতের প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হতভাগা অস্বীকারকারীরা তাদের ভ্রান্তচিন্তা পরিহার করার পরিবর্তে বেছে নিলাে, তাঁকে নানাভাবে কোণঠাসা, এমনকি হত্যা (শহীদ) করার যড়যন্ত্রের মতাে জঘন্য পন্থাকেই। হাটহাজারী থানার খন্দকিয়া গ্রামে কিছু কট্টরপন্থী ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ওহাবী বসবাস করে আসছিলাে। একদা ওই এলাকায়ও তাঁকে ওয়াযের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলাে। এলাকা তাঁর অনুকূলে ছিলাে না। তবুও দ্বীন ও মাযহাবের প্রচারণার তাগিদে তিনি নিজের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে সুন্নিয়াতের প্রচারনাকেই প্রাধান্য দিলেন। তিনি সেখানে ওয়ায করতে গিয়েছিলেন এবং সুন্নী মতাদর্শের বিষয়গুলার পক্ষে যুক্তি প্রমাণ দিয়ে ওয়ায আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু ওহাবীরা তাঁকে শহীদ করার তখনই মুখ্য সুযোগ মনে করে ওয়াযের মধ্যভাগে তাঁর উপর অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়েছিলোে। তাদের নির্মম আঘাতে তিনি বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। হামলাকারী ওহাবীরা তাঁকে মৃত মনে করে পার্শ্ববর্তী কাঁটা ঝাড়ের মধ্যে ফেলে চলে গিয়েছিল। তারপর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল তাঁকে ‘মৃত’ ঘােষণা করেছিলাে; কিন্তু আল্লাহ্ ও রসূলের দরবারে এ মাক্ববূল মুজাহিদের বহু কাজ তখনও বাকী ছিলোে বিধায় তাঁকে আল্লাহ্ ও রসূলের পক্ষ থেকে পুনরায় জীবন প্রদান করা হয়েছিলাে। আল্লামা গাযী শেরে বাংলা বলেছেন, হযরত আযরাঈল আলায়হিস্ সালাম তাঁর রূহ কব্জ করে আসমানের দিকে চলে যাবার সময় হযরত ফাতিমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা রূহানী ক্ষমতা বলে হস্তক্ষেপ করলেন এবং হুযূর-ই আকরামের মহান দরবারে তাঁর হায়াত বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করলেন। সুতরাং ওই সুপারিশ হুযূর গ্রহণ করলেন। হুযূর-ই পাকের কৃপাদৃষ্টির কারণে আল্লাহ্ পাক তাঁকে হায়াত দান করলেন। অতঃপর হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই সদয় তাশরীফ এনেছিলেন এবং আল্লামা শেরে বাংলাকে নিজের সন্তুষ্টির সুসংবাদ দিলেন আর এরশাদ করলেন, “আজিজুল হক! আমি তােমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছি। তােমার অকৃত্রিম মুহাব্বতের কারণে তােমার আয়ু বৃদ্ধি করা হলাে।” আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নবীপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। বর্তমানেও আমাদের নবীপ্রেম ও ইশকে রসূলের বাস্তবতা প্রমাণের উপযুক্ত সময় এসেছে। বলাবাহুল্য, সুন্নিয়াতের এহেন ক্রান্তিলগ্নে আল্লামা গাযী শেরে বাংলাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার বিকল্প পথ নেই।

 

পঞ্চমতঃ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সামাজিক, সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিভিন্ন অবদান রাখেন। তাঁর অবদানগুলাে সুন্নী জামা’আতকে গৌরবান্বিত করেছে। তাঁর ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য, সততা, একনিষ্ঠতা, মানুষের প্রতি ভালবাসা, ন্যায়পরায়ণতা ও জ্ঞান-গভীরতা ইত্যাদি কারণে তিনি ছিলেন আপন-পর সবার নিকট গ্রহণযােগ্য। আপন ইউনিয়নের তিনি ছিলেন দীর্ঘস্থায়ী অপ্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান। আকীদাগত বৈরীভাবাপন্ন ওহাবীরাও তাঁকে একজন বিশ্বস্ত সমাজপতি হিসেবে মানতাে। তিনি ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম’ নামক একটি ব্যাপক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সাংগঠনিক যাত্রা আরম্ভ করেন। তিনি ‘আঞ্জুমানে ইশা’আতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত, (তদানীন্তন) পূর্ব পাকিস্তান নামক একটি সুন্নী সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক। সুন্নী মতাদর্শে বিশ্বাসী হবার কারণে এবং দেশের স্বাধীনতাকামী দল হিসেবে তিনি তদানীন্তন মুসলিম লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ধর্মীয় দৃষ্টিতে নারী নেতৃত্ব হারাম ও দেশের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত যােগ্য বিবেচনা করে তিনি ১৯৬৩ ইংরেজীর নির্বাচনে ফাতিমা জিন্নাহর মােকাবেলায় আইয়ূব খানের প্রতি সমর্থন দেন ঘােষণা করেছিলেন-যখন জামায়াতে ইসলামী ও দেওবন্দী-ওহাবী নেতারা ইসলামের মূলনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নারী নেতৃত্বকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রেও ইমামে আহলে সুন্নাত সুন্নিয়াতের মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছিলেন- যেভাবে বিগত ১৯৭১ ইংরেজীর স্বাধীনতা যুদ্ধে সুন্নী মুসলমানরা স্বাধীনতার পক্ষে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরােধীতায় সােচ্চার ছিলেন। পক্ষান্তরে, ওই মওদূদীর অনুসারীরা এবং ওহাবী-তাবলীগী-কওমী-আহলে হাদীস পন্থীরা আলবদর, আল্-শামস ইত্যাদি গঠন করে দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাে। আর বর্তমানেও সুন্নী মুসলমানরা ইসলামের মৌলিক নীতিমালার প্রতি সমান দেখিয়ে নারী নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ অনাস্থা প্রকাশসহ স্বাধীনতা ও সুন্নী আকীদা-বিরােধীদের বিরােধীতাই করে আসছেন এবং দেশ, জাতি ও ইসলামের মৌলিক নিষ্কলুষ আদর্শকেই অবলম্বন করে আসছেন। সুতরাং বর্তমানে আল্লামা গাযী শেরে বাংলাকে দেশের সর্বস্তরে সুন্নিয়ত তথা সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রেরণার অন্যতম প্রধান উৎস বলতে হয়।

 

ষষ্ঠতঃ আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চাই যথােপযুক্ত ও যুগোপযোগী লেখনী। এত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর লেখনী চলছিলাে সমান্তরালভাবে। তাঁর লেখনীগুলোর মধ্যে ‘দিওয়ান-ই আযীয’, ‘মাজমূ’আহ-ই ফাতা-ওয়া-ই আযীযিয়া’, ‘ঈযাহুদ দালালাত’ (ফাতওয়া-ই মুনাজাত) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এসব কিতাবে তিনি অকাট্য প্রমাণাদি সহকারে যুগ জিজ্ঞাসার জবাব ও শরীয়ত-তরীক্বতের যথাযথ দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।

 

সপ্তমতঃ এ দেশে ইসলাম প্রচার করেছেন আউলিয়া-ই কেরাম। অগণিত পীর মাশাইখ ও আউলিয়া-ই কেরাম ইসলাম প্রচার ও ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শের প্রচারণার ধারাবাহিকতাকে বহাল রেখেছেন। অন্য কথায়, এদেশের সুন্নী মুসলমান কোন না কোন ওলী ও পীর-বুযুর্গের আস্তানা, খানকাহ ও মাযার ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। পক্ষান্তরে, সময়ের গতিপথে এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু সুবিধাবাদী ও অযােগ্য লােকের বিচরণ এবং তাদের দ্বারা ধর্মীয় অঙ্গনে বিভিন্ন ক্ষতি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সুন্নী মুসলমান যাতে সত্যিকার আউলিয়া কেরাম ও পীর- মাশাইখের সান্নিধ্য পান ও তাঁদের যিয়ারত ও শিক্ষা ইত্যাদি দ্বারা উপকৃত হতে থাকেন, অন্যদিকে ভণ্ড প্রকৃতির লােকেরা যাতে ওলী-বুযুর্গদের নামে নিজেদের স্বার্থপরতাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে সুন্নী জমাআতকে কলূষিত করতে না পারে তজ্জন্যও যথোপযুক্ত ভূমিকা পালন করে যান। নিজে গিয়ে সত্যিকারের বরকতময় জায়গা ও ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেন, তৎসঙ্গে ভণ্ডদের ভণ্ডামীর মুখােশও উম্মােচন করেছেন। তাঁর ‘দিওয়ানে আযীয’-এ তিনি আল্লাহর হামদ এবং আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাত দিয়ে আরম্ভ করেছেন। অতঃপর দেশ-বিদেশের বহু ওলীর প্রশংসা ফার্সী ভাষায় উঁচুমানের কাব্যাকারে লিখে এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বহু অজানা ওলীর সন্ধান দিয়েছেন। বহু ওলীর উঁচু মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেছেন। বহু ওলীর মাযারে প্রচলিত বহু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সেগুলাে সম্পর্কে শরীয়তের বিধানও নির্ণয় করে দিয়েছেন এতদসঙ্গে তিনি কিছু ভ্রান্তআক্বীদা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীর মুখােশও উন্মোচন করেছেন তাঁর এ প্রামাণ্য কিতাবে। তিনি কিছু সংখ্যক মহান আউলিয়া-ই কেরামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের সন্ধান দেন। তাছাড়া, তিনি মুসলমানদেরকে সত্যিকার ওলী-বুযুর্গদের সান্নিধ্যে থাকার উপদেশ দিতেন। তিনি প্রখ্যাত ইমাম ও মুনাযির হিসেবে অহরহ কর্মতৎপর ছিলেন। সাথে সাথে তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতেরও এক মহান ওলী। যুগখ্যাত ওলী-ই কামিল হযরত আবদুল হামিদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির একনিষ্ঠ মুরীদ ও খলীফা ছিলেন তিনি। তাই, তরীকতের বায়’আত করিয়ে মুসলমানদেকে রূহানীভাবে ফয়য দ্বারা ধন্য করারও অনন্য যােগ্যতা তাঁর মধ্যে ছিলাে। কিন্তু তিনি তাঁর বেলায়তকে অনেকটা গােপন রেখে, বেশী লােককে বায়’আত করান নি বরং মুসলিম সমাজকে হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটী পেশােয়ারী (শাহানশাহে সিরিকোট)’র হাতে বায়’আত গ্রহণ করার জন্য পরামর্শ দিতেন। আর বলতেন, “শাহানশাহে সিরিকোট হলেন পীর-ই কামিল, আশেকে রসূল ও যমানার গাউস। তাঁর সিলসিলার মধ্যে সন্দেহযুক্ত কোন ব্যক্তি নেই । তাঁর দামান নাজাতের ওসীলা” ইত্যাদি। (আল্লামা গাযী শেরে বাংলা, জীবনী গ্রন্থ পৃষ্ঠা- ৯৬-৯৭)

 

অষ্টমতঃ সমসাময়িক প্রশ্নাবলীর অকাট্য সমাধান প্রদান বেলায়তের একটি অতি উচ্চ পদ হচ্ছে ‘গাউসুল আযম’। তাবেঈ’র পরই এ মহামর্যাদা। আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হিও তাঁর ‘দিওয়ানে আযীয’- মহান উপাধি সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তিনি হুযূর গাউসে পাক শায়খ আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে ‘শাহে বেলায়ত’ বলেছেন। আর হুযূর গাউসে পাকের ওই ঘােষণাটি (কাদামী হা-যিহী ‘আলা রাকবাবাতি কুল্লি ওয়ালিয়্যিল্লাহ্ অর্থাৎ আমার এ কদম আল্লাহর সমস্ত ওলীর গর্দানের উপর) এভাবে বর্ণনা করেছেন- পা-য়ে পা-কশ বর রেক্বা-বে হার ওলী-উল্লাহ বুয়াদ।’ অর্থাৎ “তাঁর কদম প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপরই।” তিনি আরাে বলেছেন, তিনি হলেন ‘গাউসুল আযম ও কুত্ববে আলম’ ইত্যাদি। তিনি বলেছেন, এ কারণে তাঁর পা মুবারক প্রতিটি ওলীর গর্দানের উপর স্থান পেয়েছে। ‘ গাউসুল আযম’ উপাধি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সুতরাং সুন্নী মুসলমানগণ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির এ ফয়সালা ও সুবিন্যস্থ বিবরণকে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়াকে এ ক্ষেত্রে নিরাপদ ও সঠিক বলে মনে করেন। তাছাড়া, যামানার গাউসগণ (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম)-এর উল্লেখও রয়েছে তাঁর ‘দিওয়ান-ই আযীয’-এ।

 

শরীয়তের মাসআলা-মাসাইলের সমাধান

 

ওহাবীরা আল্লাহ তা’আলা ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মানহানি করে থাকে। তারা আল্লাহর জন্য মিথ্যা বলা সম্ভব (ইমকানে কিযব) ইত্যাদি এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বড় ভাইয়ের মতাে বলে, আরাে বলে- নবী পাক গায়ব জানেন না। নবীর খেয়াল নামাযে আসলে…ইত্যাদি। এগুলােই হচ্ছে ওহাবীদের সাথে সুন্নী মুসলমানদের বিরােধের মৌলিক কারণ। এ আক্বীদা গুলাের সাথে সংশ্লিষ্ট শরীয়তের এমন কিছু মাসআলাও রয়েছে, যেগুলাে শরীয়ত মতে বৈধ ও বরকতময় হওয়া সত্ত্বেও ওহাবীরা মনগড়াভাবে সেগুলােকে হারাম, শির্ক নাজায়েয ফাত্ওয়া দিয়ে বসে। আল্লামা গাযী শেরে বাংলা আকাইদ সংক্রান্ত হােক আর শরীয়ত সংক্রান্ত হােক যে কোন মাস’আলা বা বিষয়ে যখন ও যেখানে ভুল ফাত্ওয়া দেওয়া হয়েছে তখনই সেখানে গিয়ে সেটার প্রতিবাদ ও প্রতিকার করেছেন। মাঠে-ময়দানে প্রকাশ্যে ওয়ায ও মুনাযারার মাধ্যমেতাে তা করেছেনই, লেখনীর মাধ্যমেও তিনি প্রায় সব বিতর্কিত মাসআলার সমাধান
দিয়েছেন। ‘দিওয়ান-ই আযীয’ ও ‘মজমুআহ-ই ফাতাওয়া-ই আযীযিয়াতে তিনি একেকটা মাসতআলার পক্ষে এতােগুলাে কিতাবের সূত্র ও বরাত উন্বেখ করেছেন যে, তা দেখে নবী হতবাক হতে হয়। যেমন: কিয়াম-মীলাদ শরীফ, এয়া রসূলুল্লাহ বলে ডাকা,ওলীগণের নিকট সাহায্য চাওয়া, ওরশ-ফাতিহাখানি, আশুরায় উন্নত মানের খাবার তৈরি করা, হাপ্তদানার ফাতিহা, হুযূর করীমের নাম শুনলে দু’বৃদ্ধাঙ্গুলীতে চুমু খেয়ে দুচোখ ও মসেই করা, কবর যিয়ারত, নফল নামায জমা’আত সহকারে পড়া, শবে ক্বদরের নফল নামায, ফরয নামাযের পর মুনাজাত, মাইকযােগে ওয়াজ-নসীহত করা, সঠিক মুর্শিদের পরিচয়, অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখার কুফল, নযর-নিয়াযের বিধান, মাযারে বাতি ও লােবান জ্বালানাে, বরকত লাভের জন্য বুযুর্গদের আস্তানায় চুমু খাওয়া ইত্যাদি তাছাড়া, তিনি সামা’ ও সাজদায়ে তাহিয়্যাহ (পীরকে ও বুযুর্গের মাযারকে সাজদা করা) ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয়েরও একেবারে গ্রহণযােগ্য সমাধান দিয়েছেন।

ধর্মীয় কাজে মাইক ব্যবহার প্রসঙ্গেঃ বক্তার আওয়াযকে বড় করে একসাথে বেশী শ্রোতার নিকট পৌছানাের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে আসছিলাে। বিদায় হজ্বে হযূর সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী মুবারক উপস্থিত লক্ষাধিক সাহাবীর নিকট পৌঁছানাের জন্য হুযূর হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে এ জন্য নিয়ােগ করে উটের পিঠের ওপর চড়িয়ে দিয়েছিলেন। এতে একথার পক্ষে দলীল কায়েম হয়েছে যে, যদি আওয়াজকে পৌঁছানাের জন্য অন্য কোন বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় তাও বৈধ।

 

বলাবাহুল্য, পরবর্তীতে মাইক আবিস্কৃত হলাে। মাইকযােগে রাজনৈতিক থেকে আরম্ভ করে যে কোন কথা বা বাক্য ইত্যাদি একসাথে বহুসংখ্যক শ্রোতার নিকট পৌঁছানাে হচ্ছে। এমতাবস্থায় ধর্মীয় কথাবার্তা, ওয়ায-নসীহত, ক্বোরআন মজিদের তেলাওয়াত ইত্যাদির বেলায় মাইক ব্যবহারকে না জায়েয বলার কোন কারণ থাকতে পারে না। অবশ্য, নামাযের ক্ষেত্রে মুকাব্বির নিয়ােজিত রেখে প্রয়ােজনে মাইক ব্যবহার করার বিপক্ষে যতই কথা বলা হােক না কেন, তাকে ‘তাক্বওয়ার পরিপন্থী’ বলার চেয়ে বেশি কিছু বলা যায় না। প্রয়োজনের শর্ত সাপেক্ষে “ফাতওয়া’ কিন্তু বৈধতার পক্ষে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কিছু লােক নির্বিচারে মাইক ব্যবহারকে ‘নাজায়েয’ ‘হারাম’, ‘অগ্নিপূজা’, ‘নূরকে আগুন জ্বালিয়ে ফেলছে ইত্যাদি বলে শাের-চিৎকার শুরু করে দিলে আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ‘দিওয়ান-ই আযীয’-এ সেটার সমাধানও দিয়েছেন। তিনি ওয়াজ ইত্যাদির মজলিসে মাইক ব্যবহারের বৈধতার পক্ষে “ইজমা’ হয়েছে বলে প্রমাণ করে এর বিরােধিতা করাকে হঠকারিতা, ফাসেকী, পথভ্রষ্টতা ও মূর্খতা বলে আখ্যায়িত করেছেন।

 

নবমত: তিনি তার সাথে রেখে হাতে কলমে শিক্ষা এবং উৎসাহ দিয়েও বহু যোগ্য আলিম, মুনাযের, সচেতন ও নিষ্ঠাবান উত্তরসূরী তৈরি করে গেছেন, যা বর্তমানে বিশেষ করে আমাদের সুন্নী অঙ্গনে খুব কমই দেখা যায়! অথচ এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও।

 

আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি ছিলেন- আহলে সুন্নাতের মহান ইমাম। ইসলামের প্রকৃত আদর্শের প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য তিনি সাধ্য মতো প্রয়ােজনীয় সব কিছু করেছেন। এগুলাে করতে গিয়ে তিনি অনন্য ত্যাগের মহিমা প্রদর্শন করেছেন। তিনি একথাও প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ভালবাসাই মানুষের নাজাত ও মর্যাদালাভের একমাত্র উপায়। আর এ ভালবাসার বাস্তব প্রমাণ হচ্ছে প্রেমাস্পদের মর্যাদাকে যে কোন কিছুর বিনিময়ে তুলে ধরা। পক্ষান্তরে, প্রেমামস্পদের মান-মর্যাদার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে তাও প্রতিহত করার জন্য সােচ্চার হওয়া এবং যুগােপযােগী ও তৎক্ষণিকভাবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর এ জন্য চাই ত্যাগ ও নিষ্ঠা, প্রয়ােজনে নিজের প্রাণটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়া। বলা বাহুল্য, বর্তমানে সুন্নীয়াতের মােকাবেলায় বিপরীত চিন্তাধারার লােকেরা তাদের অবস্থান গড়ে নিয়ে শুধু সুন্নীয়াতের বিরুদ্ধে হামলা করছে না; বরং তাদের উচ্চাভিলাষকে চরিতার্থ করার জন্য যথেষ্ট কাজ করে জাতীয় জীবনকেও দূর্বিসহ করে তুলছে। সর্বোপরি,বদনাম করছে আমাদের পূতপবিত্র ধর্মেরও। এমতাবস্থায় আমাদের জ্ঞানী, গুণী, অর্থশালী বুদ্ধিজীবী ও সচেতন, অসচেতন সবাই আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহির আদর্শের অনুসরণ করলে সকলের জন্য সুফল বয়ে আনবে। উল্লেখ্য, আল্লামা গাযী শেরে বাংলার আদর্শ জীবনের দিকে তাকালে ইমাম হােসাইন, ইমাম আবু হানীফা, মুজাদ্দিদে আলফেসানী, হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনী, আল্লামা ফযলে হক খায়রাবাদী, আলা হযরত ফাযেলে বেরলভী প্রমুখ বুযুর্গের আদর্শের চিত্র চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়। আরাে অনুমান করা যায়- ইলমে লাদুন্নীর ধারক হুযুর খাজা চৌহরভী এবং শাহানশাহে সিরিকোট হযেরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিমা ও তাঁদের বুযুর্গ উত্তরসূরীদের বেলায়তী শক্তি, সাহস, দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতার বাস্তবদৃশ্য। মােটকথা, একজন আশেক্বে রাসূল ও ইমামের বহুমুখী যােগ্যতার যথাযথ নমুনা তিনি পরবর্তীদের জন্য রেখে গেছেন। আর তিনিও হয়েছেন আল্লাহ এবং তাঁর হাবীবের একান্ত প্রিয়ভাজন ।

 

ওফাত শরীফ

১৩৮৯ হিজরীর ১২ রজব, মােতাবেক ১৯৬৯ ইংরেজীর ২৫ সেপ্টেম্বর এবং ১৩৭৬ বাংলার ৮ আশ্বিন এ দেশের সুন্নিয়াতের ইতিহাসে এক বেদনা বিধূর দিন। এ দিন ছিলাে সুন্নিয়াতের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও বিচ্ছেদকাতর বর্ষণমুখর। কারণ, এ ১২ রজব বুধবার দিবাগত রাতে
সুবহে সাদেকের সময় এ দেশের সুন্নিয়াতের আন্দোলনের সর্বোজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, সুন্নী জনতার প্রাণস্পন্দন হযরত আল্লামা গাযী সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা
রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি লক্ষ-কোটি সুন্নী জনতাকে শােকসাগরে ভাসিয়ে করে এ নিশ্বর পৃথিবী থেকে পর্দা করেন। বেসাল শরীফের সময় এ অকৃত্রিম আশিকে রসূলের বয়স হয়েছিলাে ৬৩ বৎসর। হযরত শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির ওফাত শরীফের খবর বিদ্যুৎগতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে আশিক্বানে রসূল সুন্নী জনতা শোকে মুহ্যমান হয়ে হযুরের হাটহাজারীস্থ বাসভবনে পতঙ্গের ন্যায় ছুটে আসতে থাকে। পিতাকে হারিয়ে সন্তান যেমন ইয়াতীম ও অসহায় হয়ে আহাজারি করতে থাকে, তেমনি আজ লক্ষ কোটি সুন্নী জনতার নয়নমণি গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হিকে এক নজর দেখার জন্য ও শেষ বিদায় জানানাের জন্য তাঁরা অশ্রুসিক্ত নয়নে সমবেত হলাে।

 

নামাযে জানাযা ও দাফন

 

শুক্রবার সকাল বেলা হাটহাজারী কলেজ ময়দানে হযরত শেরে বাংলার প্রথম নামায়ে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। বর্ষার মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও এ ঐতিহাসিক জানাযায় লক্ষাধিক লােকের সমাগম হয়েছিলাে। ইতিপূর্বে সেখানে এতবড় জমায়েত আর কোন দিন ঘটেনি। এতে কয়েক সহস্রাধিক আলেম, ফাযেল ও অসংখ্য মাদরাসার ছাত্রও উপস্থিত ছিলেন। এমনকি হাটহাজারী (খারেজী) মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকও জানাযায় শরীক হয়ে হুযূরকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। হযরতুল আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম হাশেমী সাহেব ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির জানাযা নামাযের ইমামত করেন। বলাবাহুল্য, এরপর  ‘ইমামে আহলে সুন্নাত’-এর মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির সুযােগ্য উত্তরসূরি হিসেবে আল্লামা হাশেমী সাহেব কেবলা সুন্নী মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এরপর সিদ্দীক সওদাগরের বর্তমান পেট্রোল পাম্পের সামনে হুযূরের দ্বিতীয় নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর হাটহাজারীর প্রাণকেন্দ্রে হুযুরেরই নির্দেশ মােতাবেক পূর্বে খরিদকৃত জায়গায় তাঁকে দাফন করা হয়। শুক্রবার জুমার পূর্বে এই পবিত্র দাফন কার্য সম্পন্ন হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, হুযূরেরই নসীহত মোতাবেক ক্ববর শরীফকে খুবই উঁচু ও প্রশস্ত করা হয়। কারণ তিনি জীবদ্দশায় ওসিয়ত করে গেছেন, “তােমরা দাফনের সময় আমার কবরকে অন্তত মাথা বরাবর উঁচু করবে। যাতে করে আমি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দাঁড়িয়ে সালাম জানাতে পারি। আমার রওযায় যখন মিলাদ মাহফিল হবে তখনও যেন আমি দাঁড়িয়ে ক্বিয়াম করতে পারি।” ইশকে রসূলের এ এক বিরল দৃষ্টান্ত! এখানে আরাে উল্লেখ্য যে, মুজাদ্দিদে যামান আলা হযরত ইমাম শাহ্ আহমদ রেযা খান ফাযেলে ব্রেলভী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হিও ইন্তিকালের পূর্বে তাঁর কবর শরীফকে প্রশস্থ ও উঁচু করার জন্য নসীহত করেছিলেন।

ওরস মুবারক ও যিয়ারত

প্রতি বৎসর ১২ রজব হাটহাজারী দরবার শরীফ প্রাঙ্গণে মুজাদ্দিদে দ্বীন ও মিল্লাত হযরত আল্লামা গাযী সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির পবিত্র বার্ষিক ওরস শরীফ মহাসমারােহে অনুষ্ঠিত হয়। এ আযীমুশ্ শান ওরস মুবারকে অগণিত আশেকে রসূল সুন্নী জনতার সমাগম ঘটে। বলতে গেলে এই জনসমাগম এক বিরাট সুন্নী সমাবেশের রূপ ধারণ করে। মাযার শরীফের পশ্চিম পার্শ্বস্থ ময়দানে মাহফিলের নিমিত্তে সুদৃশ্য প্যান্ডেল ও মঞ্চ নির্মিত হয়। ওরস শরীফে অগণিত পীর-মাশাইখ ও ওলামা-ই কেরাম তাশরীফ আনেন। তাঁরা হযরত শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি’র জীবনাদর্শ ও সুন্নিয়াতের আন্দোলনের উপর সারগর্ভ তাকুরীর পেশ করেন। প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষভাবে সুন্নিয়াতের আন্দোলনের সাথে জড়িত সুন্নী মুসলমানদের বিপুল সমাগম এখানে লক্ষ্য করা যায়। নারায়ে তাকবীর, নারায়ে রিসালাত, নারায়ে গাউসিয়া ও সুন্নিয়াতের স্লোগানে ভক্তরা আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তােলে। এ নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ওই দিন হুযূরের পবিত্র মাযার পাকে একের পর এক মিলাদ ও ক্বিয়াম অনুষ্ঠিত হয়, যা সচরাচর অন্য কোন দরবারে দৃষ্টিগােচর হয় না। যাঁর গােটা জীবন সালাত-সালাম, দুরূদ-কিয়ামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই উৎসর্গ করে গেছেন, তাঁর মাযার শরীফে কেউ দুরূদ ও ক্বিয়াম ব্যাতিরেকে শুধুমাত্র যিয়ারত করে ফিরে যাবার দুঃসাহস দেখায় না। আসলে তিনি মিলাদ ও ক্বিয়ামকে কতটুকু ভালবাসতেন তাঁর পবিত্র মাযার শরীফে আসলে তা উপলব্ধি করা যায়। তাছাড়া ওরস মুবারকের আরেকটি বরকতময় বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে তাবাররুক’। তাঁর পবিত্র ওরসের তাবাররুক লাভ করার জন্য অনেককে বিশেষ তৎপর হতে দেখা যায়।

 

যিয়ারতের ফযীলত

 

আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি-এর পবিত্র মাযার শরীফ যিয়ারতের ফযীলত ও বরকত অকল্পনীয়। তাঁর মহান দরবারে গরীব-দুঃখী সকলের অভাব মােচন হয় বলে প্রখ্যাত সুন্নী ওলামা-ই কেরাম তাঁকে ‘খাজায়ে বাঙ্গাল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বিশেষতঃ সুন্নিয়তের আন্দোলনের বীর সৈনিকদের জন্য তাঁর দরবার একটি বিশেষ আকর্ষণ। কারণ তিনি তাে বাংলার আলা হযরত, সুন্নিয়াতের মহান বীর সিপাহ সালার। এ দরবার তাে নক্বশায়ে বেরেলী শরীফ। তাই তাে তিনি এরশাদ করে গেছেন, “তােমরা যদি বাতিলদের সাথে মুনাযারায় অবতীর্ণ হও কিংবা কোন সংঘর্ষ হয়, আমার রওযা শরীফ যিয়ারত করবে। তার ফায়সালা ও প্রতিকার ইনশা-আল্লাহ্ আমি করে দেব।”

সন্তান-সন্ততি

প্রথম স্ত্রীর সন্তানঃ ১. সৈয়দ মুহাম্মদ আমীনুল হকু আলক্বাদেরী, ২. সৈয়দ মুহাম্মদ যিয়াউল হক আলক্বাদেরী, ৩. সৈয়দ মুহাম্মদ বদরুল হকু আলক্বাদেরী।
চারকন্যাঃ ১. সৈয়দা হাসীনা বেগম, ২. সৈয়দা কসীদা বেগম, ৩. সৈয়দা সাকীনা বেগম, ৪. সৈয়দা চমন আরা বেগম (বুলবুল)। দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তানঃ ১. সৈয়দ মুহাম্মদ আবদুল হক্ব আলক্বাদেরী, ২. সৈয়দ মুহাম্মদ নূরুল হক্ব আলক্বাদেরী, এক কন্যা: ১. সৈয়দা মমতায বেগম
তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান: একপুত্র- ১. সৈয়দ মুহাম্মদ মােজাহেরুল হক্ব আলক্বাদেরী