ইমাম ইবনে মাজাহ (রাঃ)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী
শায়খ হাফেয ওসমান গনি
জন্ম ও বংশ পরিচিতি
নাম- মুহাম্মদ, উপনাম- আবু আব্দুল্লাহ, পিতার নাম- ইয়াযিদ। পুরাে বংশ তালিকা হলাে- আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ আল রবঈ ইবনু মাজাহ আল কাযবীনী। উপাধি- হাফিয। তিনি ইবনে মাজাহ নামেই প্রসিদ্ধ। তিনি ইরাকে আজম বা উত্তর পশ্চিম ইরানে কাযবীন নামক প্রসিদ্ধ শহরে ২০৯ হিজরি সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সুনান, তাফসীর ও ইতিহাস প্রণেতা এবং খােরাসানের মুহাদ্দিস ছিলেন।
মাজা তাঁর পিতার নাম? না, মাতার নাম? না, দাদার নাম? এ নিয়ে মতবিরােধ রয়েছে। শাহ আব্দুল আযিয দেহলভী র, বলেন, মাজা তাঁর মাতারনাম। উজালায়ে নাফিয়া গ্রন্থে লেখেন এটি তাঁর পিতার উপাধি। কেউ বলেন, এটি তাঁর দাদার নাম। তবে বিশুদ্ধ মত হলাে- মাজা তাঁর পিতার উপাধি। এটিই অধিকাংশ ওলামা এবং কাযবীন’র ঐতিহাসিকগণের অভিমত। ইমাম নববী- তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত’ গ্রন্থে আল্লামা মজিদ উদ্দিন ফিরােজাবাদী কামুস অভিধানে, আল্লামা আবুল হাসান সিন্ধী ইবনে মাজার ব্যাখ্যাগ্রন্থে এবং শাহ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিস দেহলভী র. উজালায়ে নাফিয়া গ্রন্থে বলেন, মাজা তাঁর পিতার উপাধি। ঐতিহাসিক হাফিয খলীল, মুহাদ্দিস রাফেঈ তারীখে কাযবীন গ্রন্থে বিশেষত: ইবনে মাজার বিশেষ শাগরিদ হাফিয আবুল হাসান আল কাত্তান বলেন, মাজা তাঁর পিতার উপাধি। প্রবাদ আছে صاحب البیت داری بمافیہ অর্থাৎ ঘরের মালিকই অধিক জানে ঘরে কি আছে। সুতরাং কাযবীন অধিবাসী ঐতিহাসিকগণ বিশেষ করে তাঁর ছাত্রের কথা অধিক গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হবে। এ কারণে ইমলা’র কায়েদা মতে ابن শব্দটিকে الف সহকারে লিখতে হবে। محمد بن یزید ابن ماجہ লিখতে হবে যাতে একথা বুঝা যায় যে, ابن ماجہ মুহাম্মদ এর সিফাত ইয়াযিদের সিফাত নয়। এ ব্যাপারে মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) মিরকাত গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ৬৮ পৃষ্ঠায় এবং ইমাম নববী (রহঃ) (৬৭৮হি.) শরহে মুসলিম শরীফের হাশীয়ার প্রথম খন্ডে ৬৮ পৃ. বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
জ্ঞানার্জনের জন্য ভ্ৰমণঃ
তিনি দেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে অধিক জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে। খােরাসান, ইরাক, হিজায, মিশর, সিরিয়া, মক্কা মুয়াযযমা, মদীনা তায়্যেবা, বসরা, বাগদাদ, তেহরান সহ বহু দেশে সফর করে প্রখ্যাত উস্তাদগণ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন।
উস্তাদঃ
বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর উস্তাদের সংখ্যা অনেক। নিন্মে মাত্র কয়েকজন উস্তাদের নাম উল্লেখ করা হলাে- মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ নুমাইর, ইব্রাহীম ইবনে মুনযির, হিশাম ইবনে আম্মার, মুহাম্মদ ইবনে রুমুহ, দাউদ ইবনে রশীদ ও জাবারাহ ইবনে মুফলিস প্রমুখ থেকে ইলমে হাদিস অর্জন করেন।
ছাত্রঃ
ইমাম ইবনে মাজাহ কাযবীন অঞ্চলের এক অসাধারণ প্রতিভাবান হাদিস বিশারদ ছিলেন। বহু দূর-দূরান্ত থেকে এসে অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হয়েছেন। এদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজন হলেন- আলী ইবনে সাঈদ ইবনে
আব্দিল্লাহ আল গাদানী আল আসকরী, ইব্রাহীম ইবনে দীবার আল হাওশবী, আহমদ ইবনে ইব্রাহীম কাযবীনী, জফর ইবনে ইদ্রিস, আবুল হাসান কাত্তান ও আহমদ ইবনে রাউহ বাগদাদী।
মাযহাবঃ
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ (র.)’র মতে ইবনে মাজাহ হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। কেউ বলেন, তিনি শাফেয়ী ছিলেন। তবে বিশুদ্ধ মত হলাে- তিনি নির্দিষ্ট কোনাে মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না। তিনি ইরাকবাসী ফকীহদের চেয়ে হিজাযবাসী ফকীহদের প্রতি ধাবিত ছিলেন।
মর্যাদাঃ
ইবনে মাজাহ যে একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ঐতিহাসিক, নির্ভরযােগ্য, বিশ্বাসযােগ্য, মেধাবী, স্মরণশক্তি সম্পন্ন এবং মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন তা সর্বজন স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত।
আবুল কাসেম রাফেয়ী তারীখে কাযবীন গ্রন্থে বলেন, ইমাম ইবনু মাজাহ আইম্মায়ে মুসলিমীনের মধ্যে একজন মহান ইমাম, নির্ভরযােগ্য ব্যক্তি এবং জ্ঞানীদের নিকট অত্যন্ত গ্রহণযােগ্য ব্যক্তি ছিলেন।
মুহাদ্দিস খলীলী বলেন, তিনি ‘তাফসীর, হাদিস ও ইতিহাসের বড় আলিম ছিলেন। বিশেষত ইলমে হাদিসে তিনি অত্যন্ত ও বিজ্ঞ ছিলেন। তার কথা সনদের মর্যাদা রাখতাে।
আল্লামা ইয়াকুত হামভী, মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে বলেন, ইবনে মাজা কাযবীনের বিশিষ্ট ইমামদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এভাবে ইমাম যাহাবী, ইবনে হাজর আসকালানী, ইবনে খল্লিখান, ইবনে নাসির উদ্দিন সহ অন্যান্য
ঐতিহাসিকগণ এবং সমালােচকগণ তাঁকে ইলমে হাদিসের ইমাম উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, গভীর জ্ঞানের অধিকারী ও দৃঢ়তার কথা ব্যক্ত করেছেন।
রচনাবলীঃ
তাঁর তিনটি গ্রন্থ উল্লেখযােগ্য।
১. | আত তাফসীর। আল্লামা ইবনে কাসীর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া
গ্রন্থে এবং ইমাম সুয়ুতী আল ইতকান গ্রন্থে এ তাফসীরের কথা উল্লেখ করেছেন।
২| আত তারীখ। এ গ্রন্থে সাহাবীগণ থেকে তাঁর যুগ পর্যন্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ইবনে খল্লীকান ও ইবনে কাসীর এ গ্রন্থের প্রশংসা
৩| সুনানে ইবনে মাজাহ। তাঁর অনবদ্য হাদিস সংকলন গ্রন্থ।
মৃত্যুঃ
ইমাম ইবনু মাজাহ ৬৪ বছর বয়সে ২২ রমযান ২৭৩ হিজরি সনে ১৮ ফেব্রুয়ারী ৮৮৬ খ্রি. মােতাবেক সােমবার মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন মঙ্গলবার তাকে দাফন বরা হয়।তাঁর সহােদর ভাই আবু বকর তাঁর নামাযে জানাযার
ইমামতি করেন। তাঁর সন্তান আব্দুল্লাহ ও তাঁর দুই ভাই আবু বকর ও আবু আব্দুল্লাহ সহ তাঁকে কবরে অর্পন করেন। তাঁকে গােসল দিয়েছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আলী কাহারমান ও ইব্রাহীম ইবনে দীনার ওয়াররাক।
সূত্রঃ শায়খ হাফেয ওসমান গনি কর্তৃক লিখিত বই “রাবী পরিচিতি’