ইতিহাস

ইবনে বতুতা ও হযরত শাহ জালাল (রহ:)’র ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ | ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

বাংলাদেশের ইতিহাসে হযরত শাহ জালাল (রহ.) একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। অনেক স্মৃতি ও ঘটনার কারণে তিনি মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করেছেন। মানব কল্যাণের কারণে তিনি বহু যুগ পরও স্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবেন। তিনি একটি ইতিহাস। ইতিহাসের পাতা ছেঁড়া যায় মুছা যায় না।

তিনি আদর্শ, সততা, সমাজকর্ম এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেগেছেন। ধনের দিকে গরিব এবং মনের দিকে ছিলেন তিনি ধনী। কত রাজা বাদশাহ ইতিহাসের পাতা ও মানব মন হতে হারিয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃত আল্লাহর অলিগণ মানুষের মনে ভালোবাসায় শ্রদ্ধায় বেঁচে থাকে অনন্তকাল।

 

 

সৌন্দর্য ও প্রেমের টানে হাজার হাজার মানুষ তাজমহল দেখতে যায় কিন্তু শাহজাহানের কবরে কেউ ফুলও দেয় না এবং জিয়ারতও করে না। অন্যদিকে খাজা গরীবে নেওয়াজ (রহ.)’র প্রধান খলিফা কুতুব উদ্দিন বক্তেয়ার কাকী (রহ.)‘র তাঁর প্রধান খলিফা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.), তাঁর প্রধান খলিফা আমির খসরু (রহ.) তাঁদের কবরে রাজা বাদশাহ আমীর ওমরা প্রজা সবাই শ্রদ্ধার সাথে মাথায় করে ফুল নিয়ে অর্পণ করে জেয়ারত করে। তেমনি একজন রাজাহীন অনন্তকালের রাজা নাম হযরত শাহজালাল (রহ.)। মহান কামিল অলিগণণ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনে নিজের জীবনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছেন বলে আল্লাহ পাক মানুষের অন্তরকে তাঁদের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছেন। মানব হৃদয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের সিংহাসন।
ইবনে বতুতা ছিলেন পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ পর্যটক। পদব্রজে পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করার কারণে তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। মক্কা শরীফে পবিত্র হজ্ব পালন কালে তাঁর দেশ ভ্রমণের সাধ জাগে। তিনি ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সৌদি আবর, মিসর, সিরিয়া, ইয়ামেন, মরক্কো, লেবানন, তুরস্ক, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জাভা, সুমাত্রা, ভারতবর্ষের বহুদেশ তিনি ভ্রমণ করেন। তিনি যুবক অবস্থায় দেশ ভ্রমণ শুরু করেন এবং শেষ করেন জীবনের ডুবন্ত বেলায়।

বাংলার শ্রীহট্ট যখন বিজয় হলো তখন হযরত শাহজালাল (রহ.) ধ্যান-সাধনায় এবং ইসলাম প্রচারে ব্যস্থ হয়ে পড়েন। এমনি সময় পদব্রজে ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে আগমন করেন। এখানের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে তিনি যখন সাতগাঁওয়ে (চট্টগ্রাম) এসে হাজির হন তখন জনসাধারণের মুখে হযরত শাহ জালাল (রহ.)’র আধ্যাত্মিক শক্তির কথা শুনতে পান। অতঃপর ইবনে বতুতা হযরত শাহ জালাল (রহ.) সাথে সাক্ষাৎ করতে সুদীর্ঘ একমাস পায়ে হেঁটে কামরুপের পাহাড়ী অঞ্চলে পৌঁছেন। একথা আধ্যাত্মিক শক্তি দ্বারা হযরত শাহ জালাল (রহ.) জানতে পারলেন এবং তাঁর চারজন অনুসারী বললেন, একজন পর্যটক দরবেশ আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে কামরুপ পর্যন্ত এসে পৌঁছে। তিনি এখন অমুক জায়গায় অবস্থান করছেন। তাঁর শরীরের গঠন, আঁকার আকৃতি বর্ণনা দিলেন। অতঃপর তাদেরকে বললেন, তোমরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সম্মানের সাথে আমার কাছে নিয়ে এসো। যথাস্থানে তাঁরা গিয়ে ইবনে বতুতার সন্ধান পেলেন। তিনি আগন্তুকদের পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, শ্রীহট্টের আমাদের গুরু হযরত শাহজালাল আপনাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যেতে আমাদেরকে এখানে প্রেরণ করেছেন। যার সাথে কোনদিন সাক্ষাৎ হয়নি এবং যার আগমন সম্পর্কে যিনি জ্ঞাত হওয়ার কথা নয় তিনি অভ্যর্থনা জানাতে লোক পাঠিয়েছে জেনে বিস্মিত হলেন। তাঁর বুঝতে বাকী থাকলো না যে শাহ জালাল (রহ.) প্রকৃত একজন আল্লাহর অলি। এই ঘটনার পর হযরত শাহজালাল (রহ.)’র সাথে সাক্ষাতের আগ্রহণ আরো বৃদ্ধি পেল। তাঁর অনুসারীদের সাথে ইবনে বতুতা শ্রীহট্টে পৌঁছে শাহ জালাল (রহ.)’কে জড়িয়ে ধরেন। তাঁরা দু’জন অনেক আলাপ করলেন। হযরত শাহ জালাল (রহ.) ইবনে বতুতার কাছে তাঁর ভ্রমণ কাহিনী জানতে চাইলেন। তিনি সবিস্তারে বললেন।

 

 

হযরত শাহ জালাল (রহ.) ইবনে বতুতাকে অনেক আদর যত্ন করল। তাঁর আচার ব্যবহারে এতই মুগ্ধ হয়েছেন যে, যেখানে যেতেন তিনি সেখানে শাহ জালাল (রহ.)’র প্রশংসা করতেন। তিনদিনের আতিথ্য তিনি সারা জীবন ভুলতে পারেননি।

প্রথম যখন ইবনে বতুতা শাহ জালাল (রহ.)কে দেখতে পেলেন তখন তাঁর শরীরে পরা ছিল একটি ছাগলের চামড়ার জোব্বা। এই জোব্বা দেখে তিনি মনে মনে ভাবলেন যদি হযরত শাহ জালাল (রহ.) তাঁর জোব্বাটি আমাকে দান করতো তাহলে আমি সম্মানের সাথে এই জোব্বাটি পরিধান করতাম। ইবনে বতুতা হযরতের নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করে ঘরে বাইরে আসার সাথে সাথে তাঁর এক শিষ্য জোব্বাটি এনে ইবনে বতুতার হাতে প্রদান করে বললেন, হযরত এই জোব্বাটি আপনাকে পরিধানের জন্য প্রদান করেছেন। আপনি এখানে আগমনের পূর্বে যখন জোব্বাটি তৈরি করেন তখন হযরত বলেছিলেন, জোব্বাটি তাঁর বন্ধু বুরহানুদ্দিন সাগরজীর জন্য তৈরি করা হয়েছে। তিনি চীনে ইসলাম প্রচারে এখন নিয়োজিত আছে। ইতিমধ্যে ইবনে বতুতা নামক একজন পর্যটন এখানে আগমন করবেন। জোব্বাটি তাঁর খুবই পছন্দ হবে। মনে মনে এটি পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও মুখে কিছু বলতে পারবে না। আমি তাঁর হাতে এটি অর্পণ করব। জোব্বাটি এক সময় বুরহানুদ্দিনের হাতে পৌঁছে যাবে। এসব কথা শুনে ইবনে বতুতা বললেন, জোব্বাটি যখন আমাকে দান করা হয়েছে আমি এটি কাকেও দিব না। দেখি কী করে জোব্বাটি বুরহানুদ্দিন পায়। এরপর তিনি ভ্রমণ করতে চীনে পৌঁছেন। চীনের খানসা শহরের রাজার জোব্বাটি দেখে পছন্দ হয়। তিনি জোব্বাটি ইবনে বতুতার নিকট হতে ছিনিয়ে নেয়। জোব্বাটি হারিয়ে ইবনে বতুতা দুঃখিত হলেও বিদেশ ভূমিতে তাঁর কিছুই করার ছিল না।
পরের বছর যখন আবার চীনে ভ্রমণে গেলেন তখন তিনি সাধক বুরহানুদ্দিনের সাক্ষাৎ গ্রহণ করলেন। তিনি দেখতে পেলেন বুরহানুদ্দিন জোব্বাটি পরে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করছেন। ইবনে বতুতা জোব্বাটি যখন বার বার দেখতে লাগলেন তখন হযরত বুরহানুদ্দিন জানতে চাইলেন, জোব্বাটি আপনি চিনেন নাকি ? তিনি বললেন, হ্যা, কিন্তু ভাবছি জোব্বাটি আপনার হাতে এলো কি ভাবে। বুরহানুদ্দিন বললেন, জোব্বাটি আমার বন্ধু শাহ জালাল আমার জন্যই তৈরি করেছেন। কি ভাবে এটি আমার নিকট পৌঁছবে তা এই চিঠিতে বর্ণনা আছে।

 

 

ইবনে বতুতা চিঠিটি খুলে পরতে লাগলেন। যতই পরলেন ততই বিষ্মিত হতে লাগলেন। কখন ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে ভ্রমণ করতে আসবে, কী ভাবে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হবে কীভাবে জোব্বাটি ইবনে বতুতার মাধ্যমে সর্বশেষ বুরহানুদ্দিনের হাতে পৌঁছাবে সব কথা বর্ণনা আছে। এই ঐতিহাসিক চিঠি হতে সবকিছু অভিহিত হয়ে তিনি হযরত শাহ জালাল (রহ.) প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বাধিত হয়।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক।