অন্যান্য

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

০৬ রমজান|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|৮ এপ্রিল’২২

“ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য”

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য, যিনি সমাজের বঞ্চিত ও অভাবগ্রস্থ মানুষের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্য ইসলামের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ যাকাত ফরজ করেছেন। মানবতার ধর্ম ইসলামে বিত্তহীন মুসলমানদের ভারসাম্যপূর্ন জীবন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি একক, অদ্বিতীয় তাঁর কোন অংশীদার নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি আমাদের মহান অভিভাবক মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও তাঁর প্রিয় রাসূল। তাঁর উপর অসংখ্য দরুদ সালাম বর্ষিত হোক। তাঁর পবিত্র বংশধরগন, সম্মানিত সাহাবাগন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসারী সত্যান্বেষী মুসলিম নরনারীদের প্রতি অসংখ্য করুণাধারা বর্ষিত হোক।

 

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

 

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, নামায কায়েম করুন, ইসলামের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ যাকাতকে সঠিক ভাবে আদায় করুন। জেনে রাখুন! ইসলামের পঞ্চম বুনিয়াদের একটি যাকাত। নামাযের পরেই যাকাতের স্থান। আলকুরআনে যখনই নামাযের কথা এসেছে সাথে সাথে যাকাত আদায়ের নির্দেশ এসেছে। আল কুরআনে বত্রিশটি আয়াতে যাকাত শব্দের উল্লেখ হয়েছে। আটাশবার নামায ও যাকাত একত্রে উল্লেখ হয়েছে, এ ছাড়াও পবিত্র কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরেক্ষ ভাবে ৮২ বার যাকাতের কথা বলা হয়েছে। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ২১ খন্ড)

 

পবিত্র কুরআনের আলোকে যাকাত:

 

মহান আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর আলোকে অনুসৃত অর্থ ব্যবস্থাই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা। মানব জাতির অর্থ নৈতিক মুক্তি ও মানব কল্যাণ মূলক সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির সুখ শান্তি ও সার্বিক কল্যাণ সাধনে যাকাত ব্যবস্থা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বিধান। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দান কর, (সূরা: বাকারা, আয়াত: ৪৩)

যাকাত গরীবদের অধিকার:

যাকাত ঐচ্ছিক কোনো ইবাদত নয়, এটা গরীবের প্রতি কোন বিশেষ করুণা প্রদর্শন নয়, বরং যকাত গরীবদের অধিকার। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, আর তাদের ধন সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। (সূরা: যারিয়াত, ১৯)

 

যাকাতের তাৎপর্য হলো এর মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র নিঃস্ব অসহায় বঞ্চিত দু:স্থ মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করা, তাদের অপরিহার্য প্রয়োজন পূরন করা, তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। দরিদ্র শ্রেণির অধিকার ও তাদের প্রাপ্য যথাযথভাবে আদায় করা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, তুমি আত্মীয় স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও । (সূরা: বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৬)

 

সম্পদের সুষম বণ্টন:

আজকের সমাজ ব্যবস্থায় ধনী দারিদ্র্যের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে, কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে আর কেউ অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ইসলাম এমন অসম সমাজ ব্যবস্থা অনুমোদন করে না। কেউ বিলাসবহুল অট্টালিকা আকাশচুম্বী প্রাসাদে আর কেউ ন্যূনতম মৌলিক অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত এহেন বৈষম্য মূলক সমাজ ব্যবস্থার মূলৎপাটনে ইসলাম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, যেন ধন সম্পদ কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়। (সূরা: হাশর: ৭)

 

যাকাত বিতরণের খাত সমূহ:

 

আল কুরআনে যাকাত বিতরণের জন্য আট শ্রেণির লোককে নির্দ্দিষ্ট করে দিয়েছেন, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, সাদকা তো কেবল ফকির ও মিসকীনদের জন্য এবং সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত লোকদের জন্য এবং যাদের মনজয় করা প্রয়োজন তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে, মুসাফিরদের জন্য, এটা আল্লাহর বিধান, আল্লাহ সবকিছু জানেন তিনি বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ। (সূরা: তাওবা, ৯:৬০)

সূরা তাওবার উপরোক্ত ৬০ নম্বর আয়াত দ্বারা যাকাত ফরজ হয়, নবম হিজরিতে এ বিধান পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যকর হয়, ২য় হিজরিতে রোযা ফরয হবার পর শাওয়াল মাসে যাকাত ফরজ করা হয়। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ২১শ, খন্ড)

 

যাকাত অনাদায়ীর জন্য কঠোর শান্তি:

 

নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন প্রকার তালবাহানা করার সুযোগ নেই, নিসাব পরিমান সম্পদের অধিকারী হবার পরও যারা যাকাত দানে বিরত থাকে তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তির কঠিন পরিণতি। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে তা ব্যয় করেনা আপনি তাদেরকে কঠোর আযাবের সুসংবাদ দিন। (সূরা: তাওবা: এক)

হাদীস শরীফের আলোকে যাকাত:

যাকাত অনাদায়ীর জন্য রয়েছে আখিরাতে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা, জাহান্নামে ভয়াবহ শাস্তি ও মর্মান্তিক পরিণতি তাকে ভোগ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (র.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে ধন সম্পদ পেয়েছে কিন্তু সে সম্পদের যাকাত আদায় করেনি কিয়ামতের দিন ঐ ধন সম্পদ এমন বিষধর সর্পে পরিণত হবে, যার মাথার উপর থাকবে দুটি কালো দাগ, এ সর্প সে ব্যক্তির গলায় পেছিয়ে দেয়া হবে, অত:পর সাপ উক্ত ব্যক্তির গলায় ঝুলে তার দুগালে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে আমি তোমার মাল আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ (বুখারী ও নাসায়ী, হাদীস নং: ২৪৮২)

 

হযরত সিদ্দিকে আকবর(রা.)’র সতর্কবাণী:

 

এক শ্রেণির মুসলমান রয়েছে নামায আদায় করে, যাকাত দানে গড়িমসি করে এ শ্রেণির সম্পদ লোভী লোকেরা যাকাত প্রদানে উদাসীনতা প্রদর্শন করে, নামে মাত্র সামান্য অর্থ বণ্টন করে অথবা সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকে তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ হুঁশিয়ারী সংকেত। খালীফাতু রাসূলিল্লাহ আমিরুল মু’মেনীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেছেন, আল্লাহর শপথ! যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো, কেননা যাকাত হচ্ছে সম্পদের হক, আল্লাহর শপথ যদি তারা আমাকে একটি উটের রশি প্রদানেও অস্বীকৃতি জানায় যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রদান করত তবে এ অস্বীকৃতির জন্য আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। (বোখারী শরীফ, পৃ: ১৮৮)

প্রথম তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে:

প্রথম যে তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবশ করবে তাদের একজন যাকাত অনাদায়ী ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জাহান্নামে প্রবেশকারী প্রথম তিন ব্যক্তি হচ্ছে স্বৈরাচারী শাষক, বিত্তবান ধনী ব্যক্তি যে স্বীয় সম্পদে আল্লাহর হক। (যাকাত) প্রদান করে না, পাপাচারে লিপ্ত দরিদ্র ব্যক্তি। (সহীহ ইবনু হিব্বান, ১০/৫১৩)

 

হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি স্বীয় সম্পদের যাকাত প্রদান করে তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূরীভূত হয়ে যায়। (হাইসামী মাজমাউজ জাওয়াঈদ, ৩/৬৩)

 

যাকাত অর্থ:

“যাকাত” আরবি শব্দ এর অর্থ পবিত্রতা, পরিশুদ্ধকরণ, যাকাত দ্বারা সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়, যাকাতদানে যাকাত দাতার আত্মার পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়, যাকাত এর এক অর্থ প্রবৃদ্ধি যাকাত আদায়ের কারণে আল্লাহ তা’আলা যাকাত আদায় কারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দেন। (লিসানুল আরব, ২য় খন্ড, পৃ: ৩৬)

 

যাকাতের সংজ্ঞা:

 

শরীয়তে যাকাত হল, সম্পদের নির্দ্দিষ্ট এক অংশ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কোন মুসলিম দরিদ্র অভাবীকে নি:স্বার্থভাবে প্রদান করা। প্রদত্ত ব্যক্তি থেকে কোন প্রকার উপকৃত হওয়ার আশা থেকে নিজকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখবে। দরিদ্র ব্যক্তি হাশেমী বংশের লোক হতে পারবেনা বা হাশেমী বংশের আযাদকৃত দাসদাসীও হতে পারবেনা। (দুররুল মোখতার)

নিসাবের মালিক হলে যাকাত ফরজ:

যাকাত ইসলামের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। প্রত্যেক বিবেক সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নারী-পূরুষ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়। তাদের উপর যাকাত দেয়া ফরজ।

 

স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ অর্থের নিসাব:

 

স্বর্ণ হল বিশ মিছকাল দেশীয় হিসেবে সাড়ে সাত তোলা প্রায় (৮৮ গ্রাম) রৌপ্য হল দুইশত দিরহাম অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) কিংবা কারো নিকট সমপরিমাণ মালামাল বা অর্থ সঞ্চিত থাকলে উল্লেখিত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে। ফকীহগণের সর্ব সম্মতিক্রমে কারো নিকট গড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ না থাকলেও সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা থাকলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। (ফতোওয়ায়ে শামী)

যাকাতের শর্ত:

১. প্রথম শর্ত মুসলিম হওয়া, অমুসলিমদের জন্য নয়।
২. বিবেকবান, প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
৩. নিসাব পরিমাণ মাল এক বছর পূর্ণ হতে হবে।
৪. স্বর্ণ ও রৌপ্য চল্লিশভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে।
৫. গৃহের আসবাব পত্র সামগ্রীর উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। (ফিকহর কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য)

 

হে আল্লাহ ! আামদেরকে সঠিকভাবে ইসলামের বিধি মোতাবেক যাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু, আমীন।

 

লেখক-

 

অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।

 

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।