সুন্নি ইসলামের মূলধারা: বিশ্বাস, ইতিহাস ও ঐতিহ্য
সুন্নি ইসলাম বিশ্বে সর্বাধিক অনুসরণকৃত ইসলামী ধারা। এটি মূলত ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ নামে পরিচিত, যার অর্থ হল সুন্নাহ অনুসরণকারী এবং ঐক্যের সমর্থক। সুন্নি ইসলামের মূলধারা তার গভীর বিশ্বাস, ঐতিহাসিক ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই নিবন্ধে আমরা সুন্নি ইসলামের বিশ্বাস, তার গৌরবময় ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবাহী দিকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সুন্নি ইসলামের বিশ্বাস
তাওহিদ: আল্লাহর একত্ব
সুন্নি ইসলামের কেন্দ্রীয় বিশ্বাস হল তাওহিদ, যা আল্লাহর একত্বের প্রতি অবিচল বিশ্বাসকে বোঝায়। সুন্নি মুসলিমরা মনে করেন, আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই সকল সৃষ্টির অধিপতি। তাওহিদ তিনটি ভাগে বিভক্ত:
- তাওহিদ আল-রুবুবিয়াহ: আল্লাহই সকল সৃষ্টি এবং তার পরিচালনার একমাত্র অধিকারী।
- তাওহিদ আল-উলুহিয়াহ: শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, যার মধ্যে নামাজ, রোজা, হজ এবং যাকাত অন্তর্ভুক্ত।
- তাওহিদ আল-আসমা ওয়া সিফাত: আল্লাহর সুন্দর নাম এবং গুণাবলীর প্রতি বিশ্বাস রাখা। এটি নিশ্চিত করে যে আল্লাহর গুণাবলীর সাথে কোনো সৃষ্টির তুলনা করা যায় না।
নবুওয়াত ও রাসূল
সুন্নি ইসলাম অনুযায়ী, মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। তার উপর অবতীর্ণ কোরআন হল সুন্নি মুসলমানদের জীবনের মূল গাইডলাইন। রাসূলের সুন্নাহ বা তার জীবনপদ্ধতি সুন্নি ইসলামের একটি অপরিহার্য দিক।
- নবী ও রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস: সুন্নি মুসলিমরা মনে করেন, আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য নবী ও রাসূলগণ প্রেরিত হয়েছেন।
- সিরাতুন নবী (সা.): মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ও শিক্ষা সুন্নি ইসলামের বিশ্বাসের কেন্দ্রে অবস্থান করে।
কোরআন ও সুন্নাহ
কোরআন হল সুন্নি ইসলামের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ। এটি আল্লাহর অবতীর্ণ বাণী এবং সমস্ত মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক। সুন্নাহ, বা নবীর জীবন ও কার্যাবলী, কোরআনের ব্যাখ্যা এবং বাস্তবায়নের একটি অপরিহার্য অংশ।
- ফিকহ: কোরআন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে ইসলামী আইন তৈরি করা হয়।
- ইজমা ও কিয়াস: কোরআন ও সুন্নাহর সাথে সংগতি রেখে দলগত মতামত এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিধান নির্ধারণ।
আখিরাত ও তাকদির
সুন্নি ইসলাম পরকালীন জীবনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। আখিরাতে প্রতিটি ব্যক্তির আমল অনুযায়ী বিচার হবে। এছাড়াও, তাকদির বা পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য বিশ্বাস সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত।
- পুণ্য ও পাপ: আখিরাতে প্রতিদান ও শাস্তির বিষয়টি আল্লাহর ন্যায়বিচারের উপর নির্ভরশীল।
- তাকদিরের প্রতি আস্থা: সকল ঘটনা আল্লাহর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটে। তবে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে ভালো বা মন্দ কাজ করার সুযোগ থাকে।
সুন্নি ইসলামের ইতিহাস
প্রাথমিক যুগ: চার খলিফার শাসন
সুন্নি ইসলামের ইতিহাস রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয়। প্রথম চার খলিফা – আবু বকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.) এবং আলী (রা.) – এর শাসনকালকে “খিলাফতে রাশিদা” বলা হয়। এই সময় ইসলামের ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন হয়।
- আবু বকর (রা.): ইসলামের প্রথম খলিফা। মিথ্যাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং কোরআনের সংকলন তার শাসনকালের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- উমর (রা.): ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তারে নেতৃত্ব দেন এবং প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপন করেন।
- উসমান (রা.): কোরআনের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি একত্রিত করে একটি একক সংস্করণ তৈরি করেন।
- আলী (রা.): ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষায় তার অবদান সুন্নি মুসলমানদের জন্য আদর্শ।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফত
উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে সুন্নি ইসলাম সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। ইসলামী সভ্যতা এই সময়ে বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং স্থাপত্যে ব্যাপক উন্নতি সাধন করে।
- উমাইয়া খিলাফত: ইসলামের ভূখণ্ড স্পেন থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
- আব্বাসীয় খিলাফত: বাগদাদকে জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত করা হয়।
চার মাযহাবের প্রতিষ্ঠা
সুন্নি ইসলামের চারটি ফিকহি মাযহাব – হানাফি, মালিকি, শাফি’ই এবং হানবলি – এর উদ্ভব এই সময়ে ঘটে। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফি’ই এবং ইমাম আহমদ ইবনে হানবলের চিন্তাধারা সুন্নি ইসলামের আইনি কাঠামোতে গভীর প্রভাব ফেলে।
- হানাফি মাযহাব: যুক্তি ও কিয়াসের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়।
- মালিকি মাযহাব: মদিনার আমল এবং রেওয়ায়েতকে গুরুত্ব দেয়।
- শাফি’ই মাযহাব: কোরআন ও সুন্নাহর সরাসরি ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে।
- হানবলি মাযহাব: সুন্নাহর প্রামাণ্যতার উপর অধিক জোর দেয়।
ইতিহাসে চ্যালেঞ্জ
সুন্নি ইসলাম তার ইতিহাসে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। শিয়া-সুন্নি বিভক্তি, মঙ্গোলদের আক্রমণ এবং আধুনিক যুগের উপনিবেশবাদী শাসন ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবুও সুন্নি ইসলাম তার মূলনীতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সুন্নি ইসলামের ঐতিহ্য
ইবাদত ও ধর্মীয় আচার
সুন্নি মুসলমানরা পাঁচটি স্তম্ভকে তাদের ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিবেচনা করে:
- শাহাদাহ: একত্ববাদের সাক্ষ্য।
- সালাত: দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
- সিয়াম: রমজান মাসে রোজা রাখা।
- যাকাত: ধনীদের থেকে গরিবদের জন্য দানের বাধ্যবাধকতা।
- হজ: জীবনে অন্তত একবার মক্কায় যাওয়া।
শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা
সুন্নি ইসলাম শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় অগ্রগামী। ইসলামের স্বর্ণযুগে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, দর্শন এবং সাহিত্যে মুসলিম পণ্ডিতদের ভূমিকা অমূল্য।
- আল-ফারাবি ও ইবনে সিনা: দার্শনিক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাদের অবদান।
- ইমাম গাজ্জালি: ইসলামী দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার উপর তার কাজ সুন্নি মুসলমানদের চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।
সামাজিক ঐতিহ্য
সুন্নি ইসলাম সামাজিক একতা, শান্তি এবং সম্প্রীতির উপর গুরুত্ব দেয়। ইসলামী উৎসব, যেমন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা, এই ঐক্যের প্রতীক। সুন্নি সমাজে দাতব্য কাজ এবং সামাজিক সেবার ঐতিহ্য দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান।
সাংস্কৃতিক অবদান
সুন্নি ইসলামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বৈচিত্র্যময়। স্থাপত্য (তাজমহল, উমাইয়া মসজিদ), সংগীত এবং সাহিত্য এই ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ দিক।
- স্থাপত্যশিল্প: তাজমহল, সুলেমানিয়া মসজিদ, আল-আকসা মসজিদের মতো বিখ্যাত স্থাপত্য সুন্নি ঐতিহ্যের পরিচায়ক।
- সাহিত্য: আরবি, ফারসি এবং উর্দু সাহিত্যে সুন্নি মুসলমানদের অবদান অসাধারণ।
উপসংহার
সুন্নি ইসলাম একটি বিস্তৃত, ঐতিহ্যবাহী এবং বিশ্বাসনির্ভর ধর্মীয় ধারা। এর ভিত্তি কোরআন, সুন্নাহ এবং একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক যাত্রায় প্রোথিত। সুন্নি মুসলমানরা তাদের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বার্তা প্রচার করে চলেছে। সুন্নি ইসলামের গভীরতা বুঝতে এর বিশ্বাস, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের উপর দৃষ্টিপাত করা অপরিহার্য।