জুমার-খুৎবা

হাদিস ও সুন্নি ইসলাম

ইসলামের মূল ভিত্তি হলো কুরআন এবং হাদিস। কুরআন মহান আল্লাহর প্রত্যক্ষ বাণী, আর হাদিস হলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বাণী, কর্ম ও অনুমোদনের বিবরণ। সুন্নি ইসলাম এই দুটি মূল উৎসের ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে আছে। কুরআনের সাথে হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ হাদিস কুরআনের অনেক নির্দেশনা ব্যাখ্যা করে এবং সুন্নাহ অনুযায়ী মুসলিমদের জীবনের প্রতিটি দিক নির্ধারণ করে।

হাদিসের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

‘হাদিস’ শব্দটি আরবি ‘হাদিস’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘কথা’ বা ‘বাণী’। হাদিস হলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বলা কথা, কাজ ও অনুমোদিত কাজের বিবরণ। ইসলামে হাদিসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যা তার উৎস, বিবরণকারীর সংখ্যা, গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।

১. সহিহ হাদিস

সহিহ হাদিস হলো সেই হাদিস যা নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং যার বর্ণনাকারী একেবারে বিশ্বাসযোগ্য। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম এই ধরনের হাদিস সংগ্রহের জন্য সুপরিচিত।

২. হাসান হাদিস

হাসান হাদিস হলো সেই হাদিস যা সহিহ হাদিসের মত নির্ভরযোগ্য নয়, কিন্তু তা এখনও গ্রহণযোগ্য। বর্ণনাকারীর চরিত্র বা স্মৃতির কিছু ত্রুটি থাকতে পারে, তবে সেটি এমন নয় যে তা মিথ্যাচার হিসেবে গণ্য হবে।

৩. দাইফ হাদিস

দাইফ হাদিস হলো সেই হাদিস যা কিছু কারণে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এটি বর্ণনাকারীর দুর্বলতা, সূত্রের অস্পষ্টতা বা অন্যান্য কারণে হয়ে থাকে।

৪. মাওদু হাদিস

মাওদু হাদিস হলো সেই হাদিস যা সম্পূর্ণ মিথ্যা বা বানানো হয়েছে। এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং সুন্নি মুসলমানরা এটি গ্রহণ করে না।

হাদিস গ্রন্থের নামগুলো হলো:

  1. সহিহ বুখারি – ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল-বুখারি রচিত।
  2. সহিহ মুসলিম – ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল-নিশাপুরি রচিত।
  3. সুনান ইবনে মাযাহ – ইমাম ইবনে মাযাহ রচিত।
  4. সুনান আবু দাউদ – ইমাম আবু দাউদ সুলায়মান ইবনে আশ’আস রচিত।
  5. সুনান তিরমিযী – ইমাম আত-তিরমিযী রচিত।
  6. সুনান আন-নাসাঈ – ইমাম আন-নাসাঈ রচিত।
  7. মুসনাদ আহমদ – ইমাম আহমদ ইবনে হানবাল রচিত।
  8. মুওয়াত্তা মালিক – ইমাম মালিক ইবনে আনাস রচিত।

 

সুন্নাহ কি?

সুন্নাহ হলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের আদর্শ, যা তিনি তাঁর কথা, কাজ এবং সম্মতিতে প্রকাশ করেছেন। সুন্নাহ ইসলাম ধর্মের একটি মৌলিক উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়, যা কুরআনের পরেই সর্বাধিক গুরুত্ব পায়।

সুন্নাহ মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত:

  1. কৌল বা কথ্য সুন্নাহ: মহানবী (সা.) এর বলা কথা, যেগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে তাঁর সাহাবাদের (সঙ্গীদের) শিক্ষা দিতে বা নির্দেশনা দিতে বলেছেন।
  2. ফিয়াল বা কর্মসূচক সুন্নাহ: মহানবী (সা.) এর কাজ এবং আচরণ, যেমন তিনি নামাজ কীভাবে আদায় করতেন, রোজা কীভাবে রাখতেন, এবং অন্যান্য ইবাদত কীভাবে করতেন।
  3. তাকরির বা সম্মতিকৃত সুন্নাহ: এমন কিছু কাজ বা আচরণ যা সাহাবারা মহানবী (সা.) এর সামনে করেছেন এবং তিনি তা অনুমোদন করেছেন বা চুপ থেকেছেন, অর্থাৎ তিনি তা অনুমোদন করেছেন।

সুন্নাহ মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে এবং ইসলামী আইন (শরিয়া) প্রণয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। সুন্নাহ অনুসরণ করা মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মহানবী (সা.) এর জীবনধারাকে প্রতিফলিত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়।

সুন্নি ইসলাম কাকে বলে?

সুন্নি ইসলাম হলো ইসলামের সবচেয়ে বড় এবং প্রচলিত শাখা, যা বিশ্বের প্রায় ৮৫-৯০% মুসলমানদের মধ্যে অনুসৃত হয়। “সুন্নি” শব্দটি এসেছে “আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ” থেকে, যার অর্থ “সুন্নাহ ও সম্প্রদায়ের অনুসারী।” সুন্নি মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে ইসলামের মূল ভিত্তি হলো কুরআন এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুন্নাহ বা জীবনের আদর্শ।

 

সুন্নি ইসলাম মুসলিমদের জন্য পাঁচটি স্তম্ভে বিশ্বাস রাখে: শাহাদাহ (বিশ্বাসের ঘোষণা), সালাত (নামাজ), সাওম (রোজা), জাকাত (দান), এবং হজ (তীর্থযাত্রা)। সুন্নি মুসলমানদের জন্য কুরআন এবং সুন্নাহই ইসলামী আইন, সামাজিক আচরণ এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রধান নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে।

 

হাদিস ও সুন্নি ইসলামের সম্পর্ক

সুন্নি ইসলাম, ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় শাখা, যা হাদিস এবং কুরআনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সুন্নি মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহানবী (সা.) এর জীবনের প্রতিটি দিক অনুসরণ করাই তাদের জন্য একমাত্র পথ। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে, হাদিস সুন্নি ইসলামের জন্য অপরিহার্য।

কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে হাদিস

কুরআন হলো আল্লাহর বাণী, যা সব মুসলমানের জন্য পথ নির্দেশক। কিন্তু কুরআনের অনেক বিষয় হাদিসের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, কুরআনে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নামাজের পদ্ধতি এবং সময় সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো নির্দেশনা নেই। এই বিষয়গুলো হাদিসের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে।

ইসলামি আইন (শরিয়া) ও হাদিস

সুন্নি ইসলামের ইসলামি আইন বা শরিয়ার প্রধান উৎস হলো কুরআন এবং হাদিস। কুরআনের নির্দেশনার পাশাপাশি, হাদিস শরিয়ার জন্য একটি মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশনা হাদিসের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয় এবং শরিয়া আইন প্রণয়নে হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম।

হাদিসের সংকলন এবং সুন্নি ইসলাম

হাদিসের প্রামাণিকতা নিশ্চিত করার জন্য অনেক মহান ইমাম ও ইসলামী পণ্ডিতগণ হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী এবং অন্যান্যরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের দ্বারা সংকলিত সহিহ হাদিস গ্রন্থগুলো সুন্নি ইসলামের প্রধান ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

সুন্নি ইসলামের চার মাজহাব ও হাদিসের ভূমিকা

সুন্নি ইসলামের চারটি প্রধান মাজহাব বা আইনগত পদ্ধতি রয়েছে: হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি, এবং হানবালি। এই চার মাজহাবই কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে তাদের আইন প্রণয়ন করে। যদিও প্রতিটি মাজহাবের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু তাদের সকলের মূল ভিত্তি হাদিস ও কুরআন।

হানাফি মাজহাব

হানাফি মাজহাব, যা ইমাম আবু হানিফার প্রতিষ্ঠিত, হাদিসের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ইমাম আবু হানিফা এবং তার অনুসারীরা হাদিসের পাশাপাশি রায় (ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত) এবং ইজতিহাদ (বুদ্ধি ও যুক্তির ব্যবহার) এর উপর ভিত্তি করে ইসলামি আইন প্রণয়ন করেছেন।

মালিকি মাজহাব

মালিকি মাজহাব, যা ইমাম মালিকের প্রতিষ্ঠিত, মূলত মদিনায় প্রচলিত ইসলামী রীতিনীতি এবং হাদিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইমাম মালিকের বিখ্যাত হাদিস সংকলন, ‘মুওয়াত্তা’, মালিকি মাজহাবের জন্য একটি প্রধান উৎস।

শাফেয়ি মাজহাব

ইমাম শাফেয়ি প্রতিষ্ঠিত শাফেয়ি মাজহাব, কুরআন ও হাদিসকে আইনের প্রধান উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। ইমাম শাফেয়ি হাদিসের উপর খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তিনি ইসলামী আইন প্রণয়নে হাদিসের ব্যবহারকে খুব ভালোভাবে সংহত করেছেন।

হানবালি মাজহাব

ইমাম আহমদ ইবনে হানবাল প্রতিষ্ঠিত হানবালি মাজহাব, সবচেয়ে বেশি হাদিসের উপর নির্ভরশীল। ইমাম আহমদ হাদিসের বিশুদ্ধতা এবং তার কঠোর অনুসরণের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার বিখ্যাত হাদিস সংকলন, ‘মুসনাদ আহমদ’, হানবালি মাজহাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

সুন্নাহ ও এর প্রভাব

সুন্নাহ হলো মহানবী (সা.) এর জীবনের ধরন এবং তার অনুসরণ করা প্রতিটি কাজ ও অভ্যাস। হাদিসের মাধ্যমে সুন্নাহর বিবরণ পাওয়া যায় এবং এই সুন্নাহ অনুসরণ করা সুন্নি মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুন্নাহকে কুরআনের পাশাপাশি মান্য করা হয় এবং এটি ইসলামি আইন, সামাজিক আচরণ এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে।

উপসংহার

হাদিস ও সুন্নি ইসলামের সম্পর্ক গভীর এবং অপরিসীম। হাদিস কেবল মহানবী (সা.) এর জীবনের বিবরণ নয়, বরং এটি ইসলামী চিন্তা, আইন ও আচরণের একটি মৌলিক ভিত্তি। সুন্নি ইসলাম, যা কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, ইসলামের ইতিহাসে এবং মুসলিমদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। হাদিসের মাধ্যমে মহানবী (সা.) এর সুন্নাহ অনুসরণ করে, মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ খুঁজে পায়। সুন্নি ইসলামের প্রতিটি মাজহাবেই হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম, এবং এটি ইসলামী জীবনযাত্রার একটি প্রধান ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।