সূরা আসরের তাৎপর্য ও শিক্ষা | জুমার খুতবা
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
জুমার খুতবা
০৯ সফর|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|১৭ সেপ্টেম্বর’২১
“সূরা আসরের তাৎপর্য ও শিক্ষা”
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক অমূল্যবাণী নাযিল হয়েছে। সময় এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল কুরআনে বিভিন্ন আয়াতে সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক অমূল্যবাণী নাযিল করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সময়ের শপথ করেছেন।
আসর’র অর্থ ও অবতরণ প্রসঙ্গ:
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১০৩ তম একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরার নাম সূরা আল আসর, সূরাটি সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক তাৎপর্যমন্ডিত। এতে মানব জাতির সফলতার চারটি মৌলিক উপাদান চিহ্নিত করা হয়েছে। যথাক্রমে ঈমান, আমল, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ ও একে অপরকে ধৈর্যের উপদেশ দান, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন-
অনুবাদ: ১. ওই মাহবুবের যুগের শপথ, ২. নিশ্চয় মানুষ অবশ্য ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, ৩. কিন্তু (তারা নয়) যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে এবং একে অপরকে সত্যের জন্য জোর দিয়েছে এবং একে অপরকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দিয়েছে। (তরজমা কানযুল ঈমান, সূরা: আসর, আয়াত: ১-৩)
আসর’র অর্থ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, আছর অর্থ হল সময় , কাল, এ শব্দের আরো একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে।
১. সূর্য হেলে যাওয়া থেকে ডুবে যাওয়া পর্যন্ত সময়।
২. আছরের নামাযের শপথ, যা মধ্যবর্তী নামায, যে সময়ে দিন ও রাতের ফিরিস্তাগন একত্রিত হন।
৩. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধরাধামে শুভাগমনকালীন বরকতময় সময় ও যুগের শপথ, যে সময় ও যুগের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সকল যুগ ও সময়ের চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। যে যুগে সৌভাগ্যবান আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর মাহবুবের দিদার লাভ করে সাহাবী হওয়ার মর্যাদা লাভে ধন্য হয়েছেন। [তাফসীরে নুরুল ইরফান, কৃত: মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)]
মানবজীবনের সফলতার চারটি উপাদান:
১. ঈমান, ২. আমল, ৩. সত্যের উপদেশ, ৪. ধৈর্যধারণের উপদেশ, বর্ণিত সূরায় চারটি মৌলিক গুণাবলী থেকে যার জীবন শূন্য তাকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। যে বান্দার মধ্যে চারটি বিষয় বিদ্যমান রয়েছে সে সফল মানুষ হিসেবে বিঘোষিত হয়েছে।
ঈমান প্রসঙ্গ:
ঈমান এর অর্থ অন্তরে বিশ্বাস করা, পরিভাষায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নিয়ে এসেছেন সব কিছুর উপর বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান, তাওহীদ ও রিসালতের স্বীকৃতিতে ঈমানের পূর্ণতা, প্রথমটি দাবী, দ্বিতীয়টি দলীল, দলীল বিহীন দাবী অর্থহীন, রিসালাতের প্রতি অবজ্ঞা অসম্মান কুটুক্তি ও ধৃষ্ঠতাপূর্ণ উক্তি করে তৌহিদবাদী দাবী করা কুফরীর নামান্তর।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত উবাদা ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি এরূপ সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যাতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। তাঁর জন্য আল্লাহ জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন। (মুসলিম শরীফ, খন্ড:১ম, পৃ: ১১১)
আমল:
ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্য অর্জনে মুমীনের জন্য অন্যতম শর্ত হলো ঈমানের দাবী অনুসারে “আমল” তথা সৎ কর্ম সম্পাদন করা। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে যারা আমলে সালেহ করবে তারাই জান্নাতী। এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদের মেহমানদারীর জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস রয়েছে, যেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে, কখনো তারা সেখান থেকে বের হতে চাইবেনা। (সূরা: কাহাফ, আয়াত: ১০৭-১০৮)
পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত মু’মীন হিসেবে দাবীর সফলতা ও সার্থকতা তখনই প্রমানিত হবে যখন বান্দা ইসলমের মৌলিক বিধি-বিধান, আদেশ নিষেধ, যথারীতি পালন করবে, এর কোনোটি বর্জন করা উপেক্ষা করা, অস্বীকার করা, কুফরীর শামিল। আমলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনম্বীকার্য। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছন, ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর স্থাপিত,
১. এ বলে সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল,
২. সালাত কায়েম করা,
৩. যাকাত প্রদান করা,
৪. হজ্বব্রত পালন করা,
৫. রমজান মাসে রোজা রাখা, (বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ৪৫১৪)
পরস্পরকে সত্য গ্রহণের উপদেশ:
ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া ও বাঁচার জন্য আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পরস্পরকে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত ও প্রদর্শিত সত্য, ন্যায়, সুন্দর ও কল্যাণের পথে আহ্বান করুন।
সত্য প্রতিষ্ঠার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ, অসত্য, মিথ্যা ও বাতিলের পক্ষে অবস্থানে রয়েছে নিশ্চিত ধ্বংস, অশান্তি ও অকল্যাণ। সত্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও সময়কে কাজে লাগান, সময়কে মূল্যায়ন করুন। আমাদের সময় ও জীবন কাল সীমাবদ্ধ। মৃত্যু অবধারিত, প্রত্যেক ব্যক্তিই মরণশীল। (সূরা: আন কাবূত: ৫৭)
আমাদের জীবনের অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত আছে, শুরু আছে সমাপ্তি আছে, বাল্যকাল, যৌবনকাল, বৃদ্ধকাল, জীবন যতই দীর্ঘ হোক এটাই সত্য ও বাস্তবতা, মানুষের বিদায়ী যাত্রা হবে ইহকাল থেকে পরকাল। এটা চিরন্তন সত্য যে, পৃথিবীতে মানব জাতির আগমনে ধারাবাহিকতা আছে, পিতার পরে সন্তানের আগমন। মৃত্যু তথা বিদায়ের ধারাবাহিকতা নেই, কে কখন, কোথায়, কিভাবে, কার আগে কে মৃত্যু বরণ করবে মহান আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। দেখা যায় পিতার আগে পুত্রের মৃত্যু, দাদার আগে নাতির মৃত্যু, শিক্ষকের পূর্বে ছাত্রের মৃত্যু সুতরাং আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনে নিজের পরকালকে আলোকিত করার লক্ষ্যে জীবনের অমূল্য সম্পদ সময়কে সুনিদ্দিষ্ট লক্ষ্য পথে পরিচালিত করুন, কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করুন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, দু’ জন ফেরেস্তার নিম্নরূপ আহবান ব্যাতীত একটি প্রভাতও আসেনা, হে আদম সন্তান! আমি একটি নতুন দিন এবং আমি তোমার কর্মের সাক্ষী, আমার সর্বোত্তম ব্যবহার কর, কিয়ামত পর্যন্ত আমি আর ফিরে আসবো না। (হিলয়াতুল আউলিয়া, খন্ড:২য়, পৃ: ৩০৩, কৃত: ইমাম আবু নাঈম)
সফলতা অর্জনে গতকালের চেয়ে আজকের আমল উন্নত করুন:
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার দুটি দিন সমান যায় নি:সন্দেহে সে ক্ষতিগ্রস্থ। (মুসনাদুল ফেরদৌস, ইমাম দায়লামী)
দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য অর্জনে প্রতিটি মুহূর্ত সময় ও দিনের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হে আদম সন্তান! তুমি তো কতেক দিনের সমষ্টি মাত্র, সুতরাং যখন তোমার জীবনের একটি দিন অতিবাহিত হল তোমার জীবনের একাংশ হারিয়ে গেল। [“কীমাতুযজ্জমন ইন্দাল উলামা” কৃত: শায়খ আবুদল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (র.)]
পরস্পরকে ধৈর্যধারণের উপদেশ:
সত্য প্রচারে সকল প্রকার বাধা বিপত্তি প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে অত্যাচার অবিচার জুলম নির্যাতন সহ্য করে সত্যের উপর অটল অবিচল থেকে আল্লাহর পথে দ্বীনের পথে মানুষকে আহবান করা, এ পথে ধৈর্য ধারণ করার নামই সবর। জীবন চলার পথে অভাবে, অনটনে, সুখে, দু:খে, রোগে, শোকে, বিপদে, আপদে, সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর উপর দৃঢ়তা, নির্ভরতা, ধৈর্যশীল মু’মীনের পরিচায়ক। আল্লাহ তা’আলাহ এরশাদ করেছেন, হে মু’মীনগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য কামনা করো, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। (সূরা: আল বাক্বারা: ১৫৩)
ধৈর্যশীলকে আল্লাহ ক্ষমা করেন:
ধৈর্য মু’মীনের অন্যতম বৈশিষ্ট। নিজে ধৈর্য অবলম্বন, অন্যজনকে ধৈর্যের উপদেশ দান ঈমানের পরিচায়ক। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কোনো মুসলিম ব্যক্তি মানসিক বা শরীরিক কষ্ট পেলে দু:খ কষ্ট বা চিন্তাগ্রস্ত হলে সে যদি ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহ তা’আলা তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (বুখারী, মুসলিম)
সূরা আসরে বর্ণিত, চারটি বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী বান্দার জন্য রয়েছে সাফল্যের সুসংবাদ। পক্ষান্তরে ইহকালীন জীবনে উপরোক্ত গুণাবলী অর্জনে যারা ব্যর্থ হয়েছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। আল্লাহ তা’আলা আমাদের কে সফলকাম মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। জীবনের অমূল্য সম্পদ সময়ের সঠিক ব্যবহারের তাওফিক দান করুন। নিশ্চয় আল্লাহ মহান দানশীল, রাজাধিরাজ, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।
অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।