জীবনী

ইসলামে মুজাদ্দিদ’র গুরুত্ব ও ভূমিকা | জুমার খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

২৩ সফর|১৪৪৩ হিজরি|১ অক্টোবর|শুক্রবার’২১

“ইসলামে মুজাদ্দিদ’র গুরুত্ব ও ভূমিকা”

 

 

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা,                                  আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! পুণ্যাত্ম বান্দাদের অনুসরণ করুন। তাঁদের অনুসৃত পথে জীবনাদর্শ গঠন করুন। আল্লাহর বান্দা হিসেবে তাঁদের আক্বিদা বিশ্বাসকে ইসলামের মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করুন। তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষন ও বিরোধীতাকে বঞ্চনা ও অকল্যাণের কারণ মনে করুন।

 

মুজাদ্দিদ অর্থ:

সংস্কারক, তাজদীদ শব্দটি ক্রিয়া মূল, এর অর্থ নতুন সৃষ্টি করা। পূনরুজ্জীবন, পুনর্গঠন ও সংস্কার সাধন করা। সংস্কার কর্ম দ্বীনের স্বার্থে ও দ্বীনি কল্যাণে সম্পাদিত হওয়া। দ্বীনি সংস্কার কর্ম যিনি সম্পাদন করেন হাদীস শাস্ত্র ও শরয়ী পরিভাষায় তিনি মুজাদ্দিদ উপাধিতে ভূষিত হন। (আনোয়ারুল বয়ান, খণ্ড:১ম)

 

মুজাদ্দিদের গুণাবলী:

 

১. মুজাদ্দিদ সৎকাজের আদেশকারী ও অন্যায় কাজের নিষেধকারী হবেন।
২. দ্বীনি কল্যাণে সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা সম্পন্ন হওয়া।                                                                           ৩.  ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।
৪. কৃপণতামুক্ত মন মানসিকতার অধিকারী হওয়া।
৫. উম্মতে মোহাম্মদীর সামগ্রিক কল্যাণকামী হওয়া।
৬. অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে কঠোর ও মুমীনদের সাথে উদার ভাবাপন্ন হওয়া।
৭. ইসলামী বিধানকে প্রয়োগমুখী করতে নিবেদিত প্রাণ হওয়া।

মুজাদ্দিদের শর্তাবলী:

১. মুজাদ্দিদ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিশুদ্ধ আক্বিদার অনুসারী হবেন।
২. কুরআন, সুন্নাহ তথা শরয়ী গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া।
৩. বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হওয়া।
৪. দ্বীনের স্বার্থে ও কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হওয়া।
৫. সকল প্রকার বাতিলের বিরুদ্ধে আপোসহীন হওয়া।
৬. শরীয়ত বিবর্জিত বিদয়াতের মূলোৎপাঠনকারী হওয়া।
৭. সত্য প্রচারে নির্ভীক সাহসী ও সোচ্চার হওয়া।
৮. ক্ষুদ্র স্বার্থ, ব্যক্তি স্বার্থ পরিহার করে ধর্মীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া।
৯. সমালোচক ও নিন্দুকের সমালোচনা ও নিন্দার তোয়াক্কা না করা।
১০. শরীয়ত, তরীক্বতের পূর্ণ পাবন্দ হওয়া।
১১. কুরআন সুন্নাহ ও শরীয়ত বিরোধী সকল প্রকার অনৈসলামিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদী হওয়া।
১২. জাহেরী ও বাতেনী ইলমের অধিকারী হওয়া।
১৩. যুগের শীর্ষ ওলামা মাশায়েখ তাঁর দ্বীনি সংস্কারমূলক কার্যক্রম দেখে তাঁকে মুজাদ্দিদ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করবেন।
১৪. মুজাদ্দিদ বিশেষ কোন পরিবারভূক্ত হওয়া বা মুজতাহিদ হওয়া শর্ত নয়।
১৫. দ্বীনি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন যুগের খ্যাতিমান প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব হওয়া। (জাহানে ইমামে আহমদ রেযা, ১৮ তম খন্ড, পৃ: ৬)

 

আল কুরআনের বাণী:

 

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “এরা হলো ঔসব লোক যাদের হৃদয়গুলোতে আল্লাহ তা’আলা ঈমানকে অঙ্কন করে দিয়েছেন এবং নিজ পক্ষ থেকে ‘রূহ’ দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করেছেন।” (তরজমা, কানযুল ঈমান, ৫৮ সূরা: মুজাদালাহ, পারা: ২৮, আয়াত: ২২)

আয়াতে বর্ণিত রূহ’র তাফসীর প্রসঙ্গে সদরূল আফাযিল সৈয়দ মুহাম্মদ নঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী প্রণীত “খাযাইনুল ইরফানে” বর্ণনা করেন, আয়াতে ‘রূহ’ দ্বারা হয়তো আল্লাহর সাহায্য অথবা কুরআন অথবা হযরত জিব্রাইল (আ.) অথবা আল্লাহর রহমত বা আল্লাহর নূর বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ এ পর্যায়ের বান্দাকে আল্লাহ উপরোক্ত গুণাবলী দ্বারা ধন্য করেন। এবং আল্লাহ পক্ষ থেকে সাহায্য দ্বারা তাদেরকে শক্তিশালী করেন।

 

হাদীস শরীফের আলোকে মুজাদ্দিদ:

 

প্রতি শতাব্দীতে মুজাদ্দিদ আগমনের ভবিষ্যদ্বানী সম্পর্কে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিনি এ দ্বীনকে নতুন ভাবে সংস্কার সাধন করবেন।(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪২৯১)

ইমাম হাকেম ও ইমাম বায়হাকী মুস্তাদরাকে এবং আল্লামা শায়খ আলী ইবনে আহমদ আযিযী স্বীয় “সিরাজে মুনীর শরহে জামে সগীর” কিতাবে উক্ত হাদীস কে সহীহরূপে গণ্য করা হয়েছে। আল্লামা হক্কী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর বর্ণণামতে মুজাদ্দিদ যিনি হবেন তিনি এক শতাব্দীর সমাপ্তিলগ্নে পরবর্তী শতাব্দীর শুরুতে হওয়া আবশ্যক। আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়তী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি তাঁর “মিরকাতুস সাউদ শরহে সুনানে আবু দাউদ” গ্রন্থে এ কথা উল্লেখ করেছেন। (জাহানে ইমাম আহমদ রেযা, খন্ড:১৮)

 

যুগে যুগে মুজাদ্দিদ:

 

হিজরি প্রথম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:
হযরত ওমর বিন আবদুল আজীজ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, জন্ম ৬১ হিজরি, ওফাত ১১২ হিজরি।

দ্বিতীয় শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:
ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদরিস শাফেয়ী (র.), জন্ম ১৫০ হিজরি, ওফাত ২০৪ হিজরি।

 

তৃতীয় শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:

 

ইমাম আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী (র.), জন্ম ২১৫ হিজরি, ওফাত ৩০৩ হিজরি।

চতুর্থ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:
ইমাম কাযী আবু বকর বিন তৈয়ব বাকিল্লানী (র.), জন্ম ৩৩৮ হিজরি, ওফাত ৪০৩ হিজরি।

 

পঞ্চম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:

 

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ গাজ্জালী (র.), জন্ম ৪৭০ হিজরি, ওফাত ৫৬০ হিজরি।

ষষ্ঠ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:
হযরত শায়েখ মুহিউদ্দিন সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী বিন মুসা জিলানী (র.), জন্ম ৪৭১ হিজরি, ওফাত ৫৬১ হিজরি।
ইমাম ফখর উদ্দিন মুহাম্মদ বিন ওমর রাযী (র.), জন্ম ৬২৫ হিজরি, ওফাত ৭০২ হিজরি।

 

সপ্তম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:

 

ইমাম তকী উদ্দিন ইবনে দকীকুল ঈদ কুশায়রী (র.), জন্ম ৬২৫ হিজরি, ওফাত ৭০২ হিজরি।

অষ্টম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:
আল্লামা হাফেজ ইবনে হাজর আসকালানী (র.), তিনি ৩৬ বৎসর বয়সে ৮১৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

 

নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:

 

ইমাম জালাল উদ্দিন আবদুর রহমান বিন আবু বকর সূয়ুতী (র.), জন্ম ৮৪৯ হিজরি, ওফাত ৯১১ হিজরি।

দশম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:
ইমাম আলী বিন সুলতান মুহাম্মদ কারী হারভি (র.), ওফাত ১১১৪ হিজরি।
সৈয়দ ইমাম আবদুল ওয়াহেদ বিলগিরামি (র.), জন্ম ৯১৫ হিজরি, ওফাত ১০১৭ হিজরি।

 

একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:

 

ইমাম রব্বানী শেখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি (র.), জন্ম ৯৮১ হিজরি, ওফাত ১০৩৪ হিজরি ছিলেন আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সপ্তবিংশতম অধস্তন পুরুষ। তিনি বাদশাহ আকবরের তথাকথিত দ্বীনে এলাহীর মূলোৎপাঠন করেন এবং তারপুত্র জাহাঙ্গীরের শাষন পদ্ধতির বিরোধীতা করেন।

দ্বাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:
ইমাম মহিউদ্দিন আওরঙ্গজেব আলমগীর শাহেনশাহ হিন্দ (র.), জন্ম ১০২৮ হিজরি, ওফাত ১১১৮ হিজরি। তিনি আজীবন ধর্মত্যাগী মুরতাদদের মোকাবিলা করেন।

 

ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:

 

হযরত শাহ আবদুল আজীজ মুহাদ্দিস দেহলভি (র.), জন্ম ১১৫৯ হিজরি, ওফাত ১২৩৯ হিজরি।

চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ:
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভি (র.) হলেন চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, জন্ম ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরি, ওফাত ২৫ সফর ১৩৪০ হিজরি, তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর ২৮ বৎসর ২ মাস ২০ দিন পেয়েছেন। চতুর্দশ শতাব্দীর ৩৯ বৎসর ১ মাস ২৫ দিন পেয়েছেন।

 

আরব অনারবের ওলামা মাশায়েখ কর্তৃক আ’লা হযরত কে মুজাদ্দিদ হিসেবে স্বীকৃতি:

 

মক্কা মোকাররমার প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন আল্লামা সৈয়দ ইসমাঈল বিন খলীল মক্কী আ’লা হযরত প্রসঙ্গে নিজ অভিমত ব্যক্ত করেছেন, “বরং আমি বলছি তাঁর ব্যাপারে যদি বলা হয়, তিনি এ যুগের মুজাদ্দিদ তা অবশ্যই বাস্তব ও সত্য।

আল্লামা গোলাম জিলানী ১৩৩১ হিজরিতে বলেন, আ’লা হযরত বেরলভি বর্তমান শতাব্দীর মুজাদ্দিদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভান্ডার, আদর্শ চরিত্রের আধাঁর, সম্মানিত আলেমকুলের সর্দার বিজ্ঞজনদের অগ্রবর্তী। (ফাতওয়ায়ে রিজভীয়্যাহ, খন্ড:৬, পৃ: ৯৬)

 

তাঁর দ্বীনি সংস্কার কর্ম:

 

কতিপয় লোক শরীয়ত ও তরীক্বতের মাঝে বিভাজনে লিপ্ত, শরীয়তকে উপেক্ষা করে তরীকত অবলম্বই যথেষ্ট মনে করে। এ ভ্রান্ত নীতি অপনোদনে আ’লা হযরত কার্যকর ভূমিকা রাখেন। তাঁর মতে শরীয়ত ও তরীক্বত একটি অপরটির পরিপূরক। শরীয়ত ও তরীক্বতের সমন্বয়ে ইসলামের পূর্ণতা। এ বিষয়ে তিনি শরীয়ত ওয়া তরীক্বত নামক কিতাব রচনা করেন।

আল্লাহ ছাড়া কাউকে সিজদা করা হারাম:

বর্তমানে অনেক মুসলমানকে দেখা যায় আউলিয়া কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীনের মাজারে বা পীরকে তাজিমী সিজদা করে থাকে যা অধিকাংশ ফকীহগণের মতে এটা সম্পূর্ণভাবে হারাম। এ বিষয়ে আ’লা হযরত আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা হারাম সম্পর্কিত “আয যুবদাতুয যকীয়্যাহ লিতাহরীমে সুজুদূত তাহীয়্যাহ” নামক স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেন। তাঁর দ্বীনি সংস্কার কর্মের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। ইমাম বেরলভি (র.) ১২৭২ হিজরির ১০ শাওয়াল মুতাবিক ১৪ জুন ১৮৫৬ খ্রি. ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরেলি শহরে জন্ম গ্রহন করেন। পবিত্র কুরআনুল করীমের বিশুদ্ধতম নির্ভরযোগ্য অনুবাদ কানযুল ঈমান তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। হুব্বে রাসূল তথা নবী প্রেমই তাঁর জ্ঞান সাধনার মূলউপজীব্য।

 

ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রে ত্রিশ খন্ডের লিখিত তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ফাতাওয়া গ্রন্থ “ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ” ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারের এক অমূল্য সম্পদ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সহস্রাধিক গ্রন্থ রচনা করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শ প্রচার উপরন্তু ইসলাম বিকৃতিকারীদের স্বরূপ উন্মোচনে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। ১৩৪০ হিজরির ২৫ সফর শুক্রবার ১২টা ২১ মিনিট সময়ে এই মহান মুজাদ্দিদ মাওলায়ে হাকিকীর সান্নিধ্যে গমন করেন।

 

মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। নিশ্চয় আল্লাহ মহান দানশীল, রাজধিরাজ, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।

 

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম,

 

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।