একান্ত ভাবনায় সাম্প্রতিক
আবুল কাশেম মুহাম্মদ ফজলুল হক
মোদির আসার দিন আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিল, ‘হেফাজত আওয়ামী লীগকে পরবর্তী ৫ বছর ক্ষমতায় আসার টিকেট দিয়ে দিল’। তার কথাটা হাসি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলাম প্রথমে। পরের আলোচনায় অনেক সমীকরণ। মিলিয়ে দিলেন। আমিও মিলিয়ে নিলাম৷ ভাবলাম। ভাবতে লাগলাম। এরপর অনেক পানি গড়িয়ে গেল। মিডিয়ায় পবিত্র মাহে রমজানের অনুষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিক রেকর্ডিং চলছে। এদিক সেদিক তাকাবার সময় পাচ্ছিনা। ব্যস্ততায় কিছুই লিখতে পারি নি। এমনিতেই খুব কম লিখি। বলিও কম। কথা কম বলায় আমার বিরুদ্ধে বিরাট অভিযোগ খোদ আমার ঘরেই। দায়িত্ব গ্রহণের পর লেখার হার আরও অনেক কমে গেছে। আসলে, লেখক-পাঠক কিংবা বক্তা— নিজেকে কোথাও খুঁজে পাই না।
বন্ধুর সাথে আলাপচারিতার পর ভাবনার ঘরে এসেছে অনেক কিছুই। অনেকগুলো প্রশ্ন বিবেককে নাড়া দিল। অনেক কথাই বলার ছিল। এতো কথা লিখি কখন? প্রশ্নগুলো এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনার অতি সংক্ষিপ্ত সারাংশ নিম্নরূপ:
১. বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, ঠিক এমন একটা সময়ে হেফাজতের এমন সহিংস আন্দোলন কেন?
২. ঠিক ২৬ শে মার্চ— বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে হেফাজতের এমন সহিংস কর্মসূচি কেন?
৩. মোদিকে টার্গেট করে এমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠা কেন? মোদি তো আরও এসেছিল বাংলাদেশে। কিন্তু ইতিপূর্বে তো এমনটি করা হয় নি। এখন কেন? আগের মোদি কি ফেরেস্তা ছিল? আর এখনকার মোদি ইবলিশ হয়ে এসেছে? আগের সময়কার আগমনের পূর্বেই গুজরাট দাঙ্গায় এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিষয়ে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ মোদির বিরুদ্ধে ছিল। তা সত্ত্বেও মোদি বাংলাদেশ এসেছিল। তখন হেফাজত কিন্তু ছিল, আন্দোলন ছিল না! জ্বালাও-পোড়াও ছিলনা! কিন্তু কেন?
৪. অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানরাও একই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসেছিল। কিন্তু কারো আগমনে ইসলামের ক্ষতি অনুভূত হলো না। যা হলো মোদির আগমনে। অন্যান্য দেশে কি ইসলাম বিদ্বেষ উৎসাহিত করা হয় না?
৫. ফ্রান্স ইস্যুতে কিছুদিন আগেও হেফাজত বিরাট শোডাউন করেছিল। কিন্তু তাতে পুলিশও এত এগ্রেসিভ ছিল না। গুলি ছুড়ে নি। কোনো মানুষ মারা যায় নি। এই আন্দোলনে পুলিশকে ভিন্ন রকমের দেখা গেল। গুলি ছুড়তে দেখা গেল। কেন?
৬. বিশ্বরাজনীতিতে পরিক্ষিত ও পরিণত জো-বাইডেন আমেরিকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে মাত্র কিছুদিন হলো। ‘পুলিশ-হেফাজত গেম’ তৈরি করে বাইডেন এবং সন্ত্রাসাতংকে আক্রান্ত ইউরোপকে কিছু একটা বুঝিয়ে আনুকূল্য কিংবা সমর্থন আদায় করার ‘মকসদ’ আছে কি-না?
৭. হেফাজতের অরাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে শুধু জাতীয় রাজনৈতিক নয়— বরং উচ্চমাত্রার আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক এহেন কর্মসূচি কেন? তাও আবার আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কাছাকাছি সময়ে। এখানে আগামী নির্বাচনের কোন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নেই তো? আবার এ আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাত্মতা পোষণ আগামী নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের ইঙ্গিত বহন করেনা তো? এই আশংকাটি আরো বেশি জোরালো হয়ে ওঠে যখন আমরা সাবেক আমিরের ছেলে আনাস মাদানী কে বলতে শুনি, হেফাজতের বর্তমান আন্দোলন উদ্দেশ্যহীন দিকভ্রান্ত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
৮. বহুবছর ধরে বিরোধীদল-শূন্য বাংলার অলস রাজনীতির অচেনা রূপকে বিশ্ব মোড়লদের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গ্রহণযোগ্য রূপদান করতে গায়েবি রশিতে বেঁধে হেফাজতকে মাঠে নামানো হলো কি-না?
৯. সম্প্রতি শ্রীলংকায় রাষ্ট্রীয় মদদে হিজাব পরিধান ও মাদ্রাসা বন্ধসহ ইসলাম ধর্মপালনে নানান বাঁধা-বিঘ্নতা তৈরি করা হচ্ছে। এমনই এক সময়ে সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে স্বাচ্ছন্দ্যে এসে নির্বিঘ্নে ফিরেও গেলেন। সেক্ষেত্রে হেফাজতের নীরবতার হেতু কী ছিলো?
এরকম আরও অনেক প্রশ্ন। প্রশ্ন আর প্রশ্ন। আসলে কওমিদের ব্যাপারে সরকার ভালোভাবে জানে না তা ভাবা বোকামি। তারা যে ‘লীগবিরোধী মাথাগরম শক্তি’ তা মুজিবকোট পরিহিত ‘থিংক ট্যাংক’ ভাল করেই জানে। জানে বলেই ঘুমের ঔষধ হিসেবে রেলওয়ের জমি আর টাকা-কড়ি দিয়ে তাদের মাথা ঠান্ডা করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। ঘুমের ঐ বড়ি খেয়ে অবশেষে চিরনিদ্রায় চলে যান প্রতিষ্ঠাতা আমীর। শুরু হয় বাবুর আমল। ঐ যুগ আর এই আমল যে এক নয়— তা খুব পরিস্কার। ঘুমের বড়ির কার্যকারিতা ইতোমধ্যে খতম হয়ে গেছে। মাথা গরমদের চৈতন্য ফিরেছে। অতীত ভুলে আর কতদিন থাকা যায়! স্মরণে ৭১! চেতনায় স্বাধীনতাবিরোধী তাদের ঐতিহ্যগত সেই পুরাতন ভূমিকা। টার্গেট বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। সে অনুপাতে উপলক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের সমর্থন ও সহায়তাদানকারী ভারত সরকারের বর্তমান সরকারপ্রধান।বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ম্যুরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আক্রমণ ও ভাংচুর। শ্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, একাত্তরের মতই ইসলাম রক্ষা। ভয়ংকর ফতোয়া জারী করা হলো, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামীলীগ কাফের! তাদের রক্ত হালাল! তাদের জানাজা পড়া যাবে না! ঘোষণা করা হল কথিত জেহাদের। যেমনটি করা হয়েছিল ১৯৭১ এ। তখন করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা। আর এখন জেহাদ ঘোষনা করেছে সেই সময়কার পাকিস্তানীদের দোসরদের উত্তরসূরীরা। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। কোথাও যেন সমীকরণটা মিলে যাচ্ছে। সমীকরণটা আরো মিলে যাবে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বের সাথে জামাত-সংশ্লিষ্টতার পুরাতন অভিযোগটা একটু মিলিয়ে নিলে।
ঐ দিকে ‘বড়ি’ সরবরাহকারী সরকারও ইতিমধ্যে টের পেয়ে গেছে। ‘বড়ি’র কার্যকারিতা শেষ হয়ে পুরাতন আমীরের হেফাজতের বদলে একাত্তরী আচরণের এক নতুন হেফাজতের জন্ম হয়েছে তা-ও টের পেয়ে গেছে সরকার। বড়ি-টড়ি দিয়ে তাদের ভোট পাওয়া তো যাবেই না— বরং মুজিবকোট দেখলেই তাদের নাকে কুফরির গন্ধ লাগে। এদের শায়েস্তা করার নতুন একটা রাস্তা তৈরি করা দরকার। ঐ রাস্তায় গিয়ে তারা শুধু আওয়ামী লীগেরই শত্রু থাকবে না— বরং ভারত ও আমেরিকাও তাদের শত্রু মনে করবে। ইউরোপও তাদেরকে শত্রু হিসেবে গন্য করবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞ পুলিশ তাদেরকে ঐ রাস্তায় ঢুকিয়েছে। বিশ্ব উগ্রতা দেখেছে। ভাঙচুর দেখেছে। লাঠি মিছিল দেখেছে। ধরে ধরে জবাই করার স্লোগান দেখেছে। ছুরি তলোয়ার নিয়ে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার, আক্রমণ করার অ্যাকশন দেখেছে। মানুষ মরতে দেখেছে। তার বিপরীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশন প্ল্যান দেখেছে।
এবার উগ্রবাদকে সাক্ষাত-যম হিসেবে বিবেচনাকারী ইউরোপ-আমেরিকা এই উগ্রতার ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই উপমহাদেশের বিশ্বস্ত যে বন্ধুর কাছে তথ্য চাইবে, তার নাম পাকিস্তান নয়; ভারত। কারণ প্রথমত: উগ্রতার ‘লাইভ শো’ দেখে গেছে মোদি। দ্বিতীয়ত: ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিপক্ষ চীনের বিপরীতে ভারতকে রাজি খুশি করা তাদের প্রধানতম সিলেবাস। আবার উগ্রতার এই আগুন নেভানোর মন্ত্র কী হতে পারে, সে পরামর্শও অন্যকোনো রাষ্ট্রের কাছে নয়— চাইবে ভারতের কাছেই। প্রশ্ন হলো, হেফাজতের আগুন নেভাতে কোন ‘জলে’র কথা বলবে ভারত? বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের রাজনীতি নিয়ে যাদের যৎসামান্য জানাশোনা আছে, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, হেফাজতের উগ্রতার আগুন নেভাতে ভারত ইউরোপ-আমেরিকাকে ‘আওয়ামী জলে’র ব্যবহারের পরামর্শ দেয়ার সম্ভাবনাই নব্বই ভাগ।
তাহলে তো হেফাজতকে ‘হেফাজত’ করবে সেই আওয়ামী লীগই। তখন নিকট অথবা দূর ভবিষ্যতে হেফাজতের কাছে রাজনৈতিক নোটিশ হবে এমন— হয় জাতীয় পার্টির মত আমার কাছেকাছে থাকবি, নতুবা জামাত হয়ে আপন গন্তব্যে চলে যাবি! এবং শীর্ষ নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা আমার কাছে সেই নোটিশেরই অংশ বলে মনে হয়েছে!
এ তো ঘুমের বড়ি নয়— আমার কাছে রাজনীতির অন্যরকম এক ‘বড়ি’ মনে হয়েছে। বোধহয়, হক-বাবুরা সেই বড়ির অ্যাকশনের খবর পেয়েই এতজন কর্মী হতাহতের পরেও আন্দোলনে হঠাৎ পানি ঢেলে দিয়ে অবকাশ যাপনে চলে গেছে। পাশাপাশি সহিংস এই আন্দোলনে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানবঢাল হিসেবে সামনে এগিয়ে দেয়ায় অভিভাবকদের পক্ষ থেকেও একধরনের চাপ আছে।
আহলে সুন্নাতের কর্মসূচি নেই কেন:
এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে, মামুনুল হকের একটা বক্তব্যে। ভাষ্কর্যবিরোধী ইস্যু নিয়ে যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার এক সভায় মুহতামিম মাহমুদুল হাসান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে মামুনুল হক বলেছিল, “২০১৩ সালে নাস্তিক-ব্লগারবিরোধী আন্দোলনের কারণে সরকারের উপর হেফাজতের এমন প্রভাব তৈরি হয়েছিল যে, ২০২০ সাল পর্যন্ত আর মাঠে নামতে হয় নি। ২০২০ সালে ভাষ্কর্য নিয়ে আপনার নেতৃত্বে আরেকটা আন্দোলন চাই— যেন ২০৩০ সাল পর্যন্ত আর মাঠে নামতে না হয়”। মানে নাস্তিক-ব্লগার কিংবা ভাষ্কর্য মূখ্য বিষয় নয়— মূখ্য বিষয় হলো সরকারের উপর প্রভাব তৈরি করে অরাজনৈতিক পরিচয়ে রাজনীতির রাজত্ব করা, কিছু আদায় করে নেয়া। ২০১৩ সালের আন্দোলন বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা ও রেলওয়ের জমি হাতিয়ে নিয়েছে। এবারের আন্দোলন এবং নিহত কর্মীদের রক্ত বিক্রির ৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব ইতিমধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। পেয়েছে কিনা নিশ্চিত নই। তবে অবকাশ যাপনের শুভসূচনায় জাতি কিছু একটা বুঝে নিলেও নিতে পারে! এই প্রভাব বিস্তার করার জন্যই মূলত তাদের আন্দোলনে তারা হিংস্ররূপ ধারণ করে— যা আহলে সুন্নাত করে না, করবে না, করতে পারে না। আহলে সুন্নাত তাদের অতীত হিংস্রতায় শুরুতেই বুঝেছে যে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের এই আন্দোলনও চরম হিংস্রতায় রূপ নেবে। তাই নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই সতর্ক ছিলেন। তাই তাদের জ্বালানো আগুনে আমাদের কর্মীদের বলি দেয় নি।
তাহলে কথা থাকে বিশ্বে নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য আমাদের কি কোন দায়িত্ব নেই? অবশ্যই আছে। বাবরি মসজিদ এবং গুজরাট দাঙ্গা ইস্যুতে সুন্নি সংগঠনগুলো আন্দোলন ও প্রতিবাদ করেছে। তবে আমাদের আন্দোলন আর তাদের আন্দোলনে পার্থক্য আছে। সহিংসতা মিডিয়ার দৃষ্টি কাড়ে। আর ভদ্রতা সবসময় তা পারে না।
আমি একবার পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সাথে ৭ নভেম্বরের প্রোগ্রাম নিয়ে কথা বলছিলাম। আক্ষেপ করে বলেছিলাম, ‘আমরা আপনাদের সাথে খারাপ আচরণ করি না বলেই আমাদেরকে সরকার এবং মিডিয়া দেখে না’। উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘হুজুর, তাদের মত কখনোই উগ্র আন্দোলনে যাবেন না! কারণ দেশি-বিদেশি এজেন্সীর কাছে এগুলোর রেকর্ড জমা থাকে এবং উগ্র আন্দোলনের কারণে একসময় দেশে ও বিদেশে সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়ে থাকে’।
বাংলাদেশের মুসলমান যেমন মুসলমান ভারতের মুসলমানও মুসলমান। উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করার নামই ইসলাম। আমরা আমাদের স্বার্থ রক্ষা করে ভারতের মুসলমানদের জীবন দুর্বিষহ করে দিতে পারি না। এনআরসিসহ ভারতের হাতে অনেক কিছু আছে যা বাংলাদেশের ঘাড়ের উপরে তলোয়ারের মতো। বাংলাদেশের পণ্যমূল্যের স্বাভাবিকতা পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতের উপর নির্ভরশীল। তা আমাদের সবারই জানা। যেকোনো একটা জিনিসের রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেই তার দাম বেড়ে যায় বহুগুণে। তাতে কষ্ট হয় এদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীরই। মানুষের সুবিধা অসুবিধার কথাও মানবিক নেতৃত্বকে ভাবতে হয়। আমার মনে হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে উত্তপ্ত ও বিরক্ত করে বাংলাদেশের বাজারকে অস্থির করা এবং এনআরসি বাস্তবায়নে ভারতকে বাধ্য করে ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশে পুশইনের মাধ্যমে একটা চরম অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করার পরিকল্পনাও হেফাজতের ছিল। আহলে সুন্নাত এ নিয়ে শুরু থেকেই সতর্ক ছিল।
মুসলিমবিদ্বেষী এই মোদির দেশেই তো হেফাজতের শেকড় দেওবন্দ— তারা কি মোদির বিরুদ্ধে এই অভিযোগে আন্দোলন করেছে? মোদির জন্য দেওবন্দীদের আশির্বাদের কথা সবাই জানে। সেদেশের কওমিরা স্বচক্ষে মুসলিম নিধন দেখেছে এবং দেখছে। তবে তাদের নীরবতা, আর স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বাঙালি কওমিদের সহিংসতা আমাদেরকে অন্যকিছু বলে যায়। মূলত: এটা ঐ সমীকরণ যা আগেই আমি বলেছি। তাদের পূর্বসূরিরা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল বলেই আজও পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারছে না। সে কারণে স্বাধীনতা দিবসে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে তাদের আন্দোলন সংগ্রামের মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে। অন্যথায় মুসলিমবিদ্বেষী কোনো রাষ্ট্রপ্রধান অন্যকোনো মুসলিম দেশের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আসা না আসার মধ্যে ইসলামের ধ্বংস-অধ্বংসের খুব একটা সম্পর্ক নাই। এটা কুটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ।
আন্দোলনের রূপ এবং উদ্দেশ্য—
হেফজখানার ছোটছোট বাচ্চাদেরকে কুরআন শরীফ সামনে রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে কুরআন পড়তে দেয়ার উদ্দেশ্য কী? মানে পুলিশ লাঠিপেটা করে তুলে দিতে চাইবে। পাল্টাপাল্টি হবে। কুরআন শরীফ মাটিতে পড়বে। কুরআন পাঠরত হাফেজদের উপর আক্রমণের ছবি উঠবে। পুলিশ এবং সরকারকে মুরতাদ, কুরআনবিরোধী, কুরআন অবমাননাকারী ইত্যাদি ফতোয়া দিয়ে আন্দোলনকে পাকিয়ে তোলা। মানে পবিত্র কুরআনকে আন্দোলনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। পূর্ব যুগের খারেজীরাও তা-ই করেছিল; এটা একটা ইস্যু বানানোর অপকৌশল। যাতে সাধারণ মুসলমানদের একটা সেন্টিমেন্ট পাওয়া যায়। এই কৌশলের অংশ হিসেবেই হেফাজত কখনো কুরআনকে ঢাল বানায়— কখনো মাদ্রাসা, কখনো মসজিদকে। বছরের পর বছর বিদেশি হরেকরকমের রাষ্ট্রপ্রধানগণ, মন্ত্রীগণ বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে। কোনোটাই ইস্যু হলো না। বর্তমানকার মোদি ছাড়া। আসলে এটাও নন-ইস্যু— যাকে হেফাজত ইস্যু বানিয়ে নিয়েছে এবং হেফাজত একাজে পারঙ্গম। যা আহলে সুন্নাত পারে না। আহলে সুন্নাত কুরআনকে আন্দোলনের ঢাল কিংবা হাতিয়ার বানায় না, বানাতে পারে না।
বাবুনগরীর ফতোয়া, ‘ছাত্রলীগ-যুবলীগ মারা গেলে তাদের জানাজা পড়া যাবে না’। তাদের মিছিলের স্লোগান ছিল, ‘আওয়ামী কাফের। একটা দুইটা লীগ ধরো, ধইরা ধইরা জবাই করো’। বি. বাড়ীয়ায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, ‘ছাত্রলীগ-যুবলীগ কাফের। তাদের রক্ত হালাল’। নাউজুবিল্লাহ। ভয়ংকর!!
যারা হেফাজতের তৈরি করা ইস্যুতে সুন্নিদের আন্দোলন না থাকায় আফসোসের সাগরে ডুবে আছেন, তাদের আরও ভাবা দরকার। ঈদে মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বন্ধ করার জন্য যারা লাঠিমিছিল করে, লাথি মেরে মাজার ভেঙে দেয়ার হুমকি দেয়, ঈদে মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাবারুককে পায়খানার সাথে তুলনা করে, মিলাদ-কেয়ামকে কালিপূজার সাথে তুলনা করে, আরো কত কি! তাদের বানানো ইস্যুতে আহলে সুন্নাতের আন্দোলন?
যাহোক, ফতোয়ার অংশ তো দেখলেন। এবার সাবেক আমীরের বক্তব্যটা মনে আছে তো? লালদিঘীর ময়দানে বলেছিল, ‘আওয়ামী লীগ আমাদের শত্রু নয়— আমাদের বন্ধু’৷ জুনায়েদ আল হাবিবের কথা মনে করুন, বলেছিল—”আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ইসলামবিরোধী নয়। তাদের দানে মাদ্রাসা চলে”। এই দিকে ফতোয়া হলো— ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ কাফের। এই হলো হেফাজত! যারা পাওয়া না পাওয়ার জন্যই ফতোয়া জারি করে। একসময় যে ছিল নাস্তিক, কিছু পাওয়ার পর সে হয়ে যায় তাহাজ্জুদগুজার। আহলে সুন্নাত এমন ডিকবাজী থেকে মুক্ত।