হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সাক্ষাত করাও সাদক্বাহ
লেখক- মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম
নবী-রসূলগণ (আলায়হিমুস সালাম)’র সত্ত্বাগত একটি স্বতন্ত্র দিক হচ্ছে, তাঁরা নুবূয়্যতের কর্তব্য পালনের সাথে সাথে সমাজের খিদমতও করেছেন এবং এ মহান সেবার বদলায় কোন বিনিময় গ্রহণ করেন নি। নবী-রসূলগণ (আলায়হিমুস সালাম)’র এ বৈশিষ্ট্য ক্বোরআন মাজীদে এভাবে বর্ণিত হয়েছে , لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا
“আমরা তোমাদের নিকট কোন বিনিময় কিংবা কৃতজ্ঞতা চাই না।” আম্বিয়া-ই কেরাম (আলায়হিমুস সালাম) সৃষ্টির খিদমত ও সেবার প্রতিদান শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করেন এবং কেবল এটাই বলেন যে,إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ
“আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহরই নিকট।”
হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ চরিত্র মাধুর্য ও মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ওহী-ই ইলাহীর প্রথম আগমনের সময় হযরত খাদিজাতুল কোবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা শান্তনা দিতে গিয়ে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের যে বৈশিষ্ট্যাবলি গণনা করেছেন, সেগুলোতে খিদমত-ই খালক্ব তথা সৃষ্টির সেবার দিকটি খুবই সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা) বলেন,
وَاللَّهِ مَا يُخْزِيكَ اللَّهُ أَبَدًا، إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ، وَتَحْمِلُ الكَلَّ، وَتَكْسِبُ المَعْدُومَ، وَتَقْرِي الضَّيْفَ، وَتُعِينُ عَلَى نَوَائِبِ الحَقِّ،
“আল্লাহর কসম! আল্লাহ তা‘আলা কখনো আপনাকে অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্ব বেকারকে উপার্জনের সক্ষম করে তুলেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং সত্যের পথে দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।” (বোখারী)
হাবশার বাদশাহ নাজাশীর দরবারে যখন হুজুর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং দ্বীন ইসলামের পরিচিতি তুলে ধরার সময়-সুযোগ আসে, তখন হযরত জা’ফর ত্বয়্যার (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)’র বর্ণনা লক্ষনীয়: তিনি নাজাশীর দরবারে দাঁড়িয়ে বলেন,
“হে বাদশাহ! আমরা মুর্খ সম্প্রদায় ছিলাম। মুর্তি পুজা করতাম, মৃত আহার করতাম, অশ্লীলতায় লিপ্ত থাকতাম, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতাম, আমাদের মধ্যকার ক্ষমতাবানরা জবরদস্তি দুর্বলদের সম্পদ আত্মসাৎ করত, এ সময়কালে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মধ্য থেকে একজন পরম সম্মানিত রসূল প্রেরণ করলেন, যাঁর বংশমর্যাদা, সততা, আমানতদারি ও নিষ্কলুষতা সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। তিনি আমাদেরকে আহ্বান করলেন আল্লাহর একত্ববাদ ও ইবাদতের প্রতি এবং পরিহার করতে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষগণ যাদের উপাসনা করত সেসব পাথর ও মুর্তিকে, তিনি আমাদের নির্দেশ দেন সত্য কথা বলা, আমানত আদায় করা, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা, প্রতিবেশীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা, হারাম ও রক্তপাত থেকে বিরত থাকার, আর তিনি আমাদেরকে নিষেধ করেছেন অশ্লীলতা থেকে, অনর্থক কথাবার্তা, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, নিষ্কলুষ পবিত্র রমণীদের প্রতি অপবাদ দেয়া থেকে।’’ এমনিভাবে ইসলাম কবূল করার পূর্বে হযরত আবূ সুফিয়ান-এর বয়ানও লক্ষ্য করুন- যেটা তিনি রোমের বাদশাহর দরবারে দিয়েছিলেন, এ বয়ানে তিনি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শিক্ষাসমূহের যে নক্বশা তুলে ধরেছেন, তা দ্বারা হুযূরের সুমহান ব্যক্তিত্বের অনুমান করা যেতে পারে। বাদশাহর প্রশ্নাবলির উত্তরে আবূ সুফিয়ান অনিচ্ছা সত্ত্বেও হুযূরের প্রতিটি সৌন্দর্য ও পূর্ণতা স্বীকার করে নেন। যখন বাদশাহ হিরাকল আবূ সুফিয়ানের কাছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাসমূহের ব্যাপারে জিজ্ঞস করলো, তখন তিনি বললেন,
يَقُولُ: اعْبُدُوا اللَّهَ وَحْدَهُ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا، وَاتْرُكُوا مَا يَقُولُ آبَاؤُكُمْ، وَيَأْمُرُنَا بِالصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ وَالصِّدْقِ وَالعَفَافِ وَالصِّلَةِ.
“তিনি বলেন, তোমরা এক আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোন কিছুর শরীক করো না; তোমাদের বাপ-দাদারা যা বলে, সেটাকে পরিহার করো। আর তিনি আমাদেরকে সলাত আদায় করা, সত্য কথা বলা, নিষ্কলুষ থাকা এবং আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করার আদেশ দেন।”
সৃষ্টির সেবা’র বিস্তৃত পরিধি
হুযূর নবী-ই রহমত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সদাসর্বদা দু:স্থ, হতদরিদ্র, গোলাম, ইয়াতীম এবং বিধবাদের খিদমত করেছেন আর তাদের হক্ব বা অধিকারগুলো আদায় করার নির্দেশও দিয়েছেন। তিনি সৃষ্টির সেবা’র যে বিস্তৃত পরিধি বর্ণনা করেছেন, নিচে তন্মধ্যে কিছু প্রকাশস্থল বর্ণনা করার প্রয়াস পাচ্ছি-
খিদমত বা সেবার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَبَسُّمُكَ فِي وَجْهِ أَخِيكَ لَكَ صَدَقَةٌ،
“তোমার ভাইয়ের সাক্ষাতে তোমার মুচকি হাসি সাদ্ক্বাহ স্বরূপ।” আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, এ মুচকি হাসি দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে তার কোন উপকার হচ্ছে না, কিন্তু বাস্তবে এটি শুভকামনার অনুভূতি প্রকাশ করে। তেমনিভাবে অপর স্থানে এরশাদ করেন:
وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ-
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে কিংবা নীরবতা পালন করে।’’ অর্থাৎ মানুষকে মানসিক কষ্ট না দেয়াকেও উত্তম কাজ হিসেবে গণ্য করে খিদমত ও সেবার আওতাধীন করেছেন।
হযরত আবূ মুসা আশ‘আরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ صَدَقَةٌ، قَالُوا: فَإِنْ لَمْ يَجِدْ؟ قَالَ: فَيَعْمَلُ بِيَدَيْهِ فَيَنْفَعُ نَفْسَهُ وَيَتَصَدَّقُ، قَالُوا: فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ أَوْ لَمْ يَفْعَلْ؟ قَالَ: فَيُعِينُ ذَا الحَاجَةِ المَلْهُوفَ، قَالُوا: فَإِنْ لَمْ يَفْعَلْ؟ قَالَ: فَيَأْمُرُ بِالخَيْرِ أَوْ قَالَ: بِالْمَعْرُوفِ قَالَ: فَإِنْ لَمْ يَفْعَلْ؟ قَالَ: فَيُمْسِكُ عَنِ الشَّرِّ فَإِنَّهُ لَهُ صَدَقَةٌ،
“প্রত্যেক মুসলমানেরই সাদ্ক্বাহ করা আবশ্যক। লোকেরা বললো, যদি সে সাদ্ক্বাহ করার মত কিছু না পায়? হুযূর বললেন, তাহলে সে নিজ হাতে কাজ করবে; তা দ্বারা নিজেও উপকৃত হবে এবং সাদ্ক্বাহ করবে; তারা বললো, সে যদি এটিও করতে না পারে? কিংবা তা না করে? হুযূর বললেন, তাহলে সে বিপদগ্রস্ত ভারাক্রান্ত অভাবীকে সাহায্য করবে। লোকেরা বললো, যদি সে তা না করে? হুযূর বললেন, তাহলে সৎকাজ বা সাওয়াবের কাজের আদেশ দেবে। তারা বললো, তাও যদি সে না করে? হুযূর এরশাদ করলেন, তাহলে সে মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকবে, কারণ এটিই তার জন্য সাদ্ক্বাহ।”
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খিদমতের পরিধিকে আরো ব্যাপকতা দিয়ে এরশাদ করেন: كُلُّ مَعْرُوفٍ صَدَقَةٌ “প্রতিটি সৎকর্মই সাদ্ক্বাহ।” (এ কর্ম চাই মুখ দ্বারা হোক কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা) এটাকে এক বর্ণনায় ঈমানের অংশ হিসেবে পরিগণিত করে এরশাদ করেন:
الْإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الْأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ
“ঈমানের সত্তরের অধিক বা ষাটের বেশি শাখা রয়েছে। এর সর্বোত্তম শাখা হচ্ছে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ- ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’-এ কথা বলা আর সাধারণ শাখা হচ্ছে, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া।” অর্থাৎ চলার পথে পাথর, বৃক্ষ কিংবা দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু পড়ে থাকলে, যা দ্বারা পথিকদের পথ চলতে কষ্ট হয়, সেটা সরিয়ে দেয়াও নেকীর কাজ। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
لَقَدْ رَأَيْتُ رَجُلًا يَتَقَلَّبُ فِي الْجَنَّةِ، فِي شَجَرَةٍ قَطَعَهَا مِنْ ظَهْرِ الطَّرِيقِ، كَانَتْ تُؤْذِي النَّاسَ
“আমি জান্নাতে এক ব্যক্তিকে চলাচল করতে দেখেছি, (আর তার জান্নাতে যাওয়ার নেকী ছিল এ যে,) সে চলাচলের পথে থাকা একটি বৃক্ষ কেটে দিয়েছিল, যেটার কারণে পথচারীদের কষ্ট হত।” এ খিদমতের পরিধিকে ধনী-গরিব উভয়ের প্রতি প্রশস্ত করে দিয়ে এরশাদ করেন:
كل مَعْرُوف يصنعه أحدكُم إِلَى غَنِي أَو فَقير فَهُوَ صَدَقَة
“প্রত্যেক ওই কাজ, যা কোন ধনীকে উপকৃত করে কিংবা গরীবকে উপকৃত করে, সেটা সাদ্ক্বাহ।”
মানুষ যদি নিজের, নিজ পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তানাদির ব্যয়ভার বহন করে এবং তাদের প্রয়োজনগুলোকে সমাধান করে, তাহলে যদিও সে এ কাজ নিজের জন্যই করছে কিন্তু ইসলাম এ খিদমতকে সাওয়াব অর্জনের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নবভী বয়ান:
كُلُّ مَعْرُوفٍ صَدَقَةٌ وَمَا أَنْفَقَ المُسْلِمُ مِنْ نَفَقَةٍ عَلَى نَفْسِهِ وَأَهْلِهِ كُتِبَ لَهُ بِهَا صَدَقَةٌ وَمَا وَقَى بِهِ المَرْءُ المُسْلِمُ عِرْضَهُ كُتِبَ لَهُ بِهِ صَدَقَةٌ
“প্রতিটি সৎকর্মই সাদ্ক্বাহ। মুসলমান যে হালাল উপার্জনের অর্থ নিজের, নিজ পরিবার-পরিজন-এর জন্য ব্যয় করে, আল্লাহ তা‘আলা সেটাকেও তার পক্ষ থেকে সাদ্ক্বাহ হিসেবে লিখে দেন; আর যে অর্থ মুসলমান নিজের জন্য সঞ্চয় করে, সেটাও সাদ্ক্বাহ হিসেবে গণ্য করা হয়।”
বাহ্যত সে তো এ ব্যয় স্বীয় সন্তান-সন্তুতির মহব্বতে করেছে কিন্তু সেটাকেও ইবাদত বুঝানো হয়েছে।
অপর স্থানে এরশাদ করেছেন: الْخَلْقُ عِيَالُ اللَّهِ، فَأَحَبُّ الْخَلْقِ إِلَى اللَّهِ مَنْ أَحْسَنَ إِلَى عِيَالِهِ
“সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার, আল্লাহর নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় সে, যে তার পরিবারের সাথে উত্তম আচরণ করে।”
জাহেলী যুগে আরবের লোকেরা নিজ কন্যাসন্তানদের জীবন্ত সমাহিত করত। রহমত-ই দো‘আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ অত্যাচারপূর্ণ ও নিকৃষ্ট ঐতিহ্যকে সমূলে উপড়ে ফেলেন। তারপরও কিছু লোক কন্যাদের প্রতি উত্তম ধারনা রাখত না। একদিন জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন: এয়া রাসূলাল্লাহ! সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, যদি কোন ব্যক্তির তিনটি কন্যা থাকে, পুত্র একটিও না থাকে, তাহলে? হুযূর এরশাদ করলেন, দুই বা তিন নয় শুধু যদি কোন ব্যক্তি নিজ একমাত্র কন্যার সাথেও উত্তম আচরণ করে এবং তাকে উন্নত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দেয়, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দোযখের আগুন থেকে পরিত্রাণ দেবেন। অর্থাৎ দুই বা তিন কিংবা তারচেয়ে অতিরিক্ত কন্যাদের সাথে উত্তম আচরণ আরো অধিক প্রতিদান ও সাওয়াবের অধিকারী করে দেয়।
বিশ্বজগতের রহমত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শিশুদের প্রতি খুবই স্নেহ ও দয়াময় ছিলেন এবং এক্ষেত্রে শত্রু ও মিত্রের সন্তান এমন কোন পার্থক্য করতেন না। শিশুরা নবীজিকে দেখামাত্র তাঁর নিকট দ্রুত ছুটে যেত, দয়ালু নবীও শিশুদের কোলে তুলে নিতেন, আদর-সোহাগ দিতেন, কোন খাওয়ার বস্তু হাতে দিতেন, কখনো খেজুর, কখনো তাজা ফল, কখনো অন্য কোন জিনিস। কাফিরের সাথে যুদ্ধ হলে, তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমকে নির্দেশ দিতেন, দেখো কোন শিশুকে হত্যা করবে না, তারা নিষ্পাপ, এদের কোন কষ্ট যেন না হয়। একসময় এরশাদ করেন, যে শিশুদের কষ্ট দেয়, আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
হুযূর-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দুনিয়াতে শুভাগমনের পূর্বে বিধবা নারীরা সমাজে ভীষণ অসহায় জীবনযাপন করত। বিধবা রমণীরা উত্তরাধিকার সম্পত্তি হিসেবে বিবেচ্য হত, আর মালিক তার সাথে সর্বপ্রকারের অমানবিক আচরণ করত। হুযূর-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিধবা রমণীদের এ লাঞ্ছনা থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন এবং তাদেরকে সমাজে মর্যাদার স্থান দিয়েছেন। স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আট জন বিধবা রমণীকে নিজ পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন এবং বিধবা রমণীর সাথে নিকাহ করাকে সুন্নাত করেছেন। বিধবা’র খিদমতকে জিহাদ সমপরিমাণ মর্যাদা দিয়েছেন। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিধবা রমণীদের খিদমতকে মহাপূণ্যময় স্বীকৃতি দিয়ে এরশাদ করেন:
السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ، كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ – وَأَحْسِبُهُ قَالَ – وَكَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ لَا يُفْطِرُ
“বিধবা ও ইয়াতীমের প্রতি অনুগ্রহকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদকারীর সমতুল্য । বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয় তিনি এও বলেছেন যে, ওই ব্যক্তি অক্লান্ত (অবিরাম) সলাত আদায়কারী ও লাগাতার সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির সমতুল্য।”
অপর হাদিস শরীফে এসেছে- السَّاعِي عَلَى الأَرْمَلَةِ وَالمِسْكِينِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَوْ: كَالَّذِي يَصُومُ النَّهَارَ وَيَقُومُ اللَّيْلَ ”
“যে ব্যক্তি বিধবা ও ইয়াতীমের ভরণপোষণের চেষ্টা করে, সে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর ন্যায়। অথবা সে ওই ব্যক্তির ন্যায় যে দিনে সিয়াম পালন করে এবং রাতে (নফল ইবাদতে) দাঁড়িয়ে থাকে।”
হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইয়াতীমের প্রতিপালন ও দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন একটি বাস্তব সত্য বিষয়। যা শত্রু-মিত্র সকলেই স্বীকার করে নিত। বিধবার খিদমতের বহু দিক রয়েছে, যেমন: আর্থিক সাহায্য করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বাজার থেকে ক্রয় করে পৌঁছিয়ে দেয়া, তাদের শাদী করিয়ে দেয়া, তাদের সন্তান-সন্তুতিকে শাদী করিয়ে দেয়া, তাদের সমস্যা সমাধান করা ইত্যাদি।
মানুষ পদে পদে ভাল পরামর্শের প্রয়োজন অনুভব করে। জীবনের প্যাঁচালো পথগুলোতে তার সহায্য-সহায়তার বেশ জরুরী হয়। নিজের অধিকার অর্জনের জন্য সুপারিশ দরকার হয়। বিশেষভাবে বর্তমানে প্রচলিত আইন-কানুনের ব্যাপারে মানুষের বিজ্ঞজনের পরামর্শ প্রয়োজন হয়। আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, কৃষিবিদ-এর পরামর্শ একান্ত দরকার হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: إِنَّ الْمُسْتَشَارَ مُؤْتَمَنٌ. ‘যার কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা হয়, তাকে বিশ্বস্ত হওয়া উচিত।’ তাই পরামর্শ আমানত হয়ে থাকে। এ কারণে যে ব্যক্তি পরামর্শ চায়, তাকে সেটা পরিপূর্ণ দ্বীনদারী ও আমানতের সাথে বিশুদ্ধ ও সঠিক পরামর্শ দেয়া চাই। এতে এটার পার্থিব ও পরকালীন প্রতিদান নিহিত রয়েছে। যদি কেউ কোন সমস্যায় পড়ে যায় বা পুলিশ অবৈধভাবে গ্রেফতার করে নেয় কিংবা মিথ্যা অপবাদ ও অভিযোগের শিকার হলে, তাহলে তার মুক্তির জন্য সুপারিশ করা, শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য সুপারিশ করা বা কোন বেকার ব্যক্তিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে তার জন্য সুপারিশ করাও সাওয়াবের কাজ। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো যে, ওই সুপারিশ দ্বারা যাতে কোন উপযুক্ত ব্যক্তির অধিকার খর্ব না হয়। নবী রহমত-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ
“যে ব্যক্তি কোন কল্যাণের প্রতি পথপ্রদর্শন করে, তাহলে সে সেটার উপর আমলকারীর সমপরিমাণ প্রতিদান অর্জন করবে। হযরত আবূ মুসা আশ‘আরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন,عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَنَّهُ كَانَ إِذَا أَتَاهُ السَّائِلُ أَوْ صَاحِبُ الحَاجَةِ قَالَ: اشْفَعُوا فَلْتُؤْجَرُوا، وَلْيَقْضِ اللَّهُ عَلَى لِسَانِ رَسُولِهِ مَا شَاءَ. “নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে কোন সাহায্যপ্রার্থী কিংবা অভাবী লোক এলে, তিনি সাহাবীগণকে বলতেন, তোমরা তার জন্য সুপারিশ করো, এর দ্বারা প্রতিদান পাবে। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রসূলের মুখ মুবারক দ্বারা যা চান হুকুম করেন।”
[বোখারী, আস সহীহ, খন্ড- ৮, পৃ. ১২, হাদিস নং-৬০২৭]
অপর এক হাদিস শরীফে হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি অপর কোন মুসলমান ভাইকে কোন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকের সাথে মিলানোর জন্য, তাকে উপকৃত করতে কিংবা তার কোন সমস্যা সমাধান করানোর জন্য নিয়ে গেছে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা সেটার বিণিময়ে ওই মুসলমানের কিয়ামত দিবসে পুলসিরাতের উপর অতিক্রমকালে সাহায্য করবেন। যার উপর দিয়ে অতিক্রমের সময় লোকের পদযুগল কাঁপতে থাকবে। [সহীহ ইবনে হিব্বান, কিতাবুল র্বিরি ওয়াস সোয়ালাহ, পৃ.২৬০]
সরকার জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য যে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অর্পন করেছেন, তাদের একটু লক্ষ্য করা উচিত যে, আল্লাহর সৃষ্টির এ অবস্থায় খিদমত করা কত বড় পূণ্যের কাজ। এমনকি শুধুমাত্র সুপারিশ করে কোন অধিকার বঞ্চিত ব্যক্তিকে তার হক্ব পাইয়ে দেয়াও সৃষ্টির সেবার অনুপম পন্থা ও উত্তম প্রতিদান হাসিলের উপায়।
সৃষ্টির সেবার অপর একটি পন্থা হলো, সমাজে যেসকল ব্যক্তি বা শ্রেণির উপর অত্যাচার, যুল্ম হচ্ছে কিংবা তাদের সাথে সীমালঙ্গন করা হচ্ছে, তাদেরকে সাহায্য করা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র এরশাদ মোতাবেক ঈমানের প্রথম স্তর হচ্ছে, মানুষ তার শক্তি, সামর্থ্য দ্বারা ওই মন্দ বা সীমালঙ্ঘনকে প্রতিহত করবে; দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে, মুখের ভাষা দ্বারা প্রতিহত করবে, সেটার বিরুদ্ধে মুখের কথা ও লিখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ করবে; আর শেষ স্তর হলো, সেটাকে অন্তরে মন্দ জানবে।
অত্যাচারী ও নির্যাতিত উভয়কেই সাহায্য করার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا
“তোমার ভাইয়ের সাহায্য করো অত্যাচারী হোক বা নির্যাতিত।” [সহীহ বোখারী, হা/ ২৪৪৩] হযরত বারা- ইবনে ‘আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রসূল-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাতটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন, তন্মধ্যে একটি হলো নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্য করা। [সহীহ বোখারী, হা/৬২২২] ইমাম নবভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি নির্যাতিতদের সাহায্য করাকে ‘ফরয-ই কিফায়া’ হিসেবে গণ্য করেছেন। যদি কারো ঘর ধ্বংস করা হচ্ছে, কাউকে হত্যা করা হচ্ছে, কারো আত্মসম্ভ্রমহানি করা হচ্ছে, তাহলে অপরাপর সকলের তার সহযোগিতা করা আবশ্যক। যদি কেউ সাহায্য না করে, তাহলে সকলেই গুনাহগার হবে, এক্ষেত্রে কোন বিশেষত্ব নেই যে, মযলূম বা নিপীড়নের শিকার ব্যক্তি মুসলিম নাকি অমুসলিম । এভাবে অন্য স্থানে রসূল-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, اتَّقُوا دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ، وَإِنْ كَانَ كَافِرًا، “তোমরা ‘মযলূম’ (নির্যাতিত)’র দো‘আ থেকে বেঁচে থাকো, যদিও সে কাফের হয়।”
[মুসনাদ-ই আহমদ, খন্ড-২০, পৃ. ২২, হাদিস নং- ১২৫৪৯] যদি সমাজের লোকেরা এ হাদিস শরীফের উপর আমল করা শুরু করে, তাহলে আজই দেশ থেকে যুল্ম, হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ-এর ক্রমধারা বিদায় নিতে পারে। যদি প্রত্যেকেই একে অপরের তামাশা দেখতে থাকে, তাহলে যুল্ম ও নির্যাতনের বাজার সগরম থাকবে। আর হয়ত ভবিষ্যতে আমরাও এটার শিকার হতে পারি।