প্রবন্ধ

হাদীস সংরক্ষণে হযরত ইমাম বুখারী’র অবদান

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস সংরক্ষণে হযরত ইমাম বুখারী’র অবদান”

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য, যিনি তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্ব মানবতার জন্য অনুসরনীয় ও অনুকরনীয় মডেল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। ইসলামী জীবন বিধানে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের পরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র জীবন চরিত্র কর্মনীতি ও আদর্শ তথা নবীজির পবিত্র বাণী কথা কাজ অনুমোদন সমর্থন যা ইসলামী পরিভাষয় হাদীস ও সুন্নাহ অভিধায় ভূষিত। ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীস ও সুন্নাহর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মূলত: হাদীস হচ্ছে কুরআনের নির্ভুল সঠিক ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত বিশ্লেষণ। ইসলামের মহা মনীষীদের অক্লান্ত ত্যাগ ও সাধনার বদৌলতে ইসলামী জ্ঞানের এ অমূল্য সম্পদ সংরক্ষিত রয়েছে।

 

পবিত্র কুরআনের আলোকে হাদীসের অপরিহার্যতা:

 

ইসলামের উপর দ্বীনের সঠিক পথে অটল অবিচল থাকার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পথেই রয়েছে বিশ্ব মানব জাতির সুখ শান্তি উন্নতি কল্যাণ ও হিদায়ত। পক্ষান্তরে কুরআন সুন্নাহর পথ থেকে বিচ্যুতি গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার পরিচায়ক। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে ঈমানদারগন! নির্দেশ মান্য করো আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের, অতপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড় তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যার্পন কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। (সূরা নিসা, আয়াত: ৫৯)

পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে, রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। (সূরা: হাশর, আয়াত: ০৭)

 

বর্ণিত আয়াত দুটিতে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের নির্দেশ মান্য করা দ্বারা কুরআন ও সুন্নাহর ফায়সালা ও নির্দেশনা গ্রহণ করা ও মেনে চলাকে অপরিহার্য করা হয়েছে।

 

 

হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারকারীদের জন্য নবীজীর দুআ:

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ঈমান, কালেমা, নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ, বিবাহ-শাদী, ব্যবসা-বাণিজ্য, আল্লাহর হক, বান্দার হক, মুসলমানদের হক, অমুসলিমদের অধিকার প্রতিবেশির অধিকার মাতা-পিতার অধিকার রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্র নীতি, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানবার একমাত্র কার্যকর পন্থা ও উপায় হচ্ছে হাদীসে রাসূল তথা নবীজির অমূল্য বানী । তা নবীজি থেকে সূচিত হোক বা সাহাবী, তাবেঈ বা তবে তাবেঈন থেকে সূচিত হোক এর সঠিকতা বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতা যাচাই বাচাই পরীক্ষা নিরীক্ষা করত: নবীজির হাদীস ও সুন্নাহর পবিত্র আমানতকে যারা সংরক্ষণ ও সংকলন করে মুসলিম উম্মাহর দ্বার প্রান্তে প্রচার প্রসারে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে তদানুযায়ী আমল করার সুযোগ করে দিয়ে মুসলিম উম্মহকে কৃতার্থ করেছেন তাঁদের অন্যতম কীর্তিমান আলোকদীপ্ত খোদাপ্রদত্ত এক অসাধারণ প্রতিভার নাম ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। নবীজির নূরানী জবানে তাঁদের জন্য সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করে দুআ করেছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তার জীবন সমুজ্জ্বল করুক যারা আমার বানী শ্রবণ করে তা মুখস্থ করল তা সঠিকরূপে স্মরণে রাখল উহাকে পূর্ণরূপে হিফাজত করল এবং অন্যের নিকট তা পৌছিয়ে দিল। অনেক জ্ঞানের বাহক এমন ব্যক্তির নিকট তা পৌছিয়ে দেয় যিনি তার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও বিজ্ঞ। (বায়হাক্বী শরীফ)

 

নবীজি আরো এরশাদ করেছেন, “আমার উম্মতের যে ব্যক্তি দ্বীন সম্পর্কে চল্লিশটি হাদীস সংরক্ষণ করবে আল্লাহ তা’আলা তাকে “ফকীহ” (আইনজ্ঞ) বানাবেন এবং কিয়ামত দিবসে আমি তার জন্য শাফায়াতকারী ও সাক্ষী হব। (মিশকাতুল মাসাবীহ)

 

 

ইমাম বুখারী (র.)’র পরিচিতি

ইমাম বুখারীর নাম:

মুহাম্মদ, পিতার নাম: ঈসমাইল, তাঁর উপনাম: আবু আবদুল্লাহ, উপাধি: আমীরুল মু’মিনীন ফীল হাদীস। তাঁর বংশীয় শাজরা হলো “মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল ইবন ইবরাহীম ইবন আল মুগীরা ইবন আল বারদিযবাহ আল আয়ামানী আলজুফী আল বুখারী” ইমাম বুখারীর পিতামহ মুগীরা ইবন বারদিযবাহ আলজুফী মূর্তিপূজক ছিলেন, তিনি বুখারার গভর্ণর ইয়ামান আলজুফীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। (জামিউল আহাদীস মুকাদ্দিমা, পৃ: ৩২১, কৃত: ইমাম আহমদ রেযা (র.), সংকলন: মাওলানা মুহাম্মদ হানীফ খান রিজভি বৈরলভি)

 

জন্ম ও শিক্ষা জীবন:

 

ইমাম বুখারী (র.) ১৯৪ হিজরির ১৩ শাওয়াল জুম’আর নামাযের পর মাওয়ারাউন নাহারের একটি বিখ্যাত শহর বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন। বুখারা সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের একটি প্রসিদ্ধ শহর, বর্তমানে স্বাধীন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র উজবেকিস্তানের অন্তর্গত। (ইয়াকুত আল-হামাভী, মু’জামুল বুলদান, বৈরুত, খ: ১, পৃ: ৪২০ )

ইমাম বুখারীর শিশু অবস্থায় তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। মাতৃকোলে লালিত পালিত হন। বাল্য বয়সেই তিনি দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন, অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের শত প্রচেষ্টা সত্বেও দৃষ্টি শক্তি ফিরে আসেনি। তাঁর মহিয়সী মা ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার, ইবাদতগুজার, ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য প্রায়শ: রাতভর কান্না করে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতেন, তাঁর মা এক রাতে হযরত ইবরাহীম আলাইহি সালামকে স্বপ্নে দেখেন, স্বপ্নে তাঁকে সুসংবাদ দিলেন, আল্লাহ তা’আলার তোমার দুআর বদৌলতে স্বীয় অনুগ্রহে তোমার ছেলের দৃষ্টি শক্তি দিয়ে দিয়েছেন, সকালে দেখতে পান ছেলে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে পেয়েছেন। (শামসুদ্দীন, আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ. ১২ পৃ. ৩৯৭, জামিউল আহাদীস, মুকাদ্দিমা, পৃ: ৩২১ কৃত: ইমাম আহমদ রেযা)

 

শিক্ষার্জন ও জ্ঞান সাধনা:

 

মায়ের তত্বাবধানে ইমাম বুখারী প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা করেন, প্রথম থেকেই তাঁর অন্তরে ইলমে হাদীস অর্জনের বাসনা জাগ্রত হয়। পাঁচ বছর বয়সে তিনি বুখারার একটি মাদরাসায় ভর্তি হন, তখনি হাদীস মুখস্থ করা সম্পর্কে তাঁর অন্তরে ইলহাম হয়। ছয় বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআনের হাফেজ হন। তিনি তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি ও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। আল্লামা সিদ্দিক হাসান কুনুযীর বর্ণনামতে ইমাম বুখারী বাল্য বয়সেই সনদসহ সত্তর হাজার হাদীস শরীফ মুখস্থ করেছিলেন। (ইবনুল জাওযী, আল মুনতাযম, খন্ড: ৭, পৃ: ৯৬)

হাদীস সংগ্রহে বিভিন্ন দেশ সফর:

আল্লামা হাফেজ ইবন হাজর আসকালানীর বর্ণনামতে ইমাম বুখারী (র.) ২১০ হিজরিতে হাদীস সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। (হাদীয়ুস সারী, পৃ: ৪৮৪)

 

শিক্ষক মন্ডলী:

 

নবীজির হাদীসের বিশাল ভান্ডার সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী পৃথিবীর দূর দুরান্তে বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা কিরমানীর বর্ণনামতে ইমাম বুখারী বিভিন্ন দেশের এক হাজার আশিজন হাদীস বিশারদ থেকে হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। আল্লামা ইবনুল জাওযীর বর্ণনা মতে, ইমাম বুখারী ইলমে হাদীস সংগ্রহ ও অনুসন্ধানের জন্য বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান মুহাদ্দিস গনের সান্নিধ্যে গমন করেন, তিনি খোরাসানের জিবাল, ইরাকের সবগুলো শহরে, হিজাজ, মিসর ও সিরিয়া সফর করে অসংখ্য হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন, ইমাম বুখারী নিজেই বর্ণনা করেছেন, আমি সিরিয়া, মিসর ও জজিরায় দুবার, বসরায় চারবার, হিজাযে ছয়বার প্রবেশ করেছি ও অবস্থান করেছি। কুফা ও বাগদাদের হাদীস বিশারদদের সাথে অসংখ্যবার সাক্ষাৎ করেছি। (খতীর আল বাগদাদী, তারিখু বাগদাদ, খন্ড: ২, পৃ:৭)

হজ্ব ও যিয়ারতে হারামঈন শরীফাঈন:

ইমাম বুখারী ১৮ বছর বয়সে মা ও বড় ভাই আহমদ ইবনে ইসমাঈলের সাথে হজ্বব্রত পালন করেন। হজ্ব সম্পাদন শেষে তিনি মক্কা মুকাররমায় থেকে যান। এ সময় হাদীস সংগ্রহে তিনি দিবারাত্রি অতিবাহিত করেন। ১৮ বছর বয়সেই ২১২ হিজরিতে তিনি সাহাবী ও তাবিয়ীগণের ফায়সালা বিষয়ক “কিতাবু কাদইয়াস সাহাবা ওয়াত তাবিয়ীন” নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মুবারকের পাশে বসে চাঁদনী রাতে তিনি “আত্ তারীখুল কবীর” নামক চল্লিশহাজার হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনী বিষয়ক এক বিশাল কিতাব রচনা করেন। (ইবন হাজর আসকালীনী, হাদীয়ুস সারী, জামিউল আহাদীস, মুকাদ্দিসা, পু: ৩২২)

 

 

নবীজির প্রতি ভালোবাসা:

ইমাম বুখারী (র.) একজন অদ্বিতীয় আশেকে রাসূল ছিলেন। তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চুল মুবারক সংরক্ষিত ছিলো। তিনি তা তাঁর পরিধেয় পোশাকের সাথে রাখতেন। (হাদীয়ুস সারী, পৃ: ৪৮১)

ইমাম বুখারী (র.) কে নবীজির সালাম প্রেরণ:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাদীসের সংরক্ষণকারী হযরত ইমাম বুখরীকে সালাম প্রেরণ করেছেন মর্মে খতীব আল বাগদাদী স্বীয় সনদে আল্লামা ফিরিবারী (র.) থেকে বর্ণনা করেন, আমি নবীজিকে স্বপ্নে দেখেছি, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যেতে ইচ্ছে করেছো? আমি জবাব দিলাম মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল এর নিকট যেতে ইচ্ছা করছি। নবীজি আমাকে বললেন, তাঁকে আমার পক্ষ থেকে সালাম পৌছিয়ে দেবে। (ইবন হাজর আসকালানী, হাদীয়ুস সারী, পৃ: ৪৮৯)

 

বুখারী শরীফ প্রণয়ন:

 

ইবনে হাজর আসকালানীর বর্ণনা মতে, আল্লাহর কিতাবের পর সর্বাধিক বিশুদ্ধগ্রন্থ হচ্ছে সহীহ আল বুখারী। ইবনে হাজর আসকালানীর মতে বুখারী শরীফে পুন:ল্লেখসহ হাদীসের সংখ্যা ৭৩৯৭টি এক বর্ণনায়, ৭২৭৫ টি বদরুদ্দীন আইনীর মতে ৯০৮২টি আধ্যায় সংখ্যা ১৬০, অনুচ্ছেদ ৩৪৫০টি পূনরুল্লেখ ছাড়া হাদীসের সংখ্যা ৪০০০।

ওফাত ও দাফন:

ইমাম বুখারী ২৫৬ হিজরিতে ঈদুল ফিতর রাতে এশার নামাযের পর সমরকন্দের সন্নিকটে খরতংক নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন। পরদিন জোহর নামাযের পর তাঁকে কবরস্থ করা হয়। ওফাতের সময় তাঁর বয়স হয়ে ছিল ৬১ বছর ১১ মাস ১৭দিন। মুহাম্মদ ইবন আবী হাতিম বর্ণনা করেন, আমরা যখন তাঁকে দাফন করলাম, তাঁর কবর থেকে মিশকের চেয়ে অধিক সুগন্ধি বের হতে থাকে। লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁর কবরে এসে কবরের মাটি নিয়ে যেতে থাকে এ দৃশ্য দেখে তাঁরা বিস্মিত হয়। (মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাতুল মাসাবীহ, খন্ড: ১, পৃ: ১৭)

 

 

হে আল্লাহ! মুসলিম উম্মাহকে কিয়ামত পর্যন্ত ইমাম বুখারীর রুহানী ফযুজাত দান করুন। ইলমে হাদীসের অতলান্ত বিস্তৃত মহাসমুদ্র বুখারী শরীফের ইলম দ্বারা আমাদের অন্তর আলোকিত করুন।

 

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।