রমজানের প্রধান আকর্ষণ সিয়াম ও কিয়াম
এম সাইফুল ইসলাম নেজামী
পশ্চিম দিগন্তে আঁধারের বুক ছিঁড়ে হেসে উঠেছে চিকন সুতার মতো বাঁকা চাঁদ। রমজানের চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে বলে আনন্দের ঢেউ তুলেছে শিশু-কিশোররা। আলহামদুলিল্লাহ কণ্ঠে মালিকের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে ভুল করেননি মুমিন আত্মা। কারো মুখে এক জলক হাসি! আবার কারো নয়নে আনন্দাশ্রু। মুমিন হৃদে প্রভুভক্তির ভরা জোয়ার। বছর ঘুরে আবার এলো মাহে রমজান। অফুরন্ত রহমত, বরকত, কল্যাণ ও ইবাদতসমৃদ্ধ এ মাস। জাগতিক লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে দূরে রেখে আত্মসংশোধনের মাধ্যমে ইনসানে কামেল হওয়ার অবারিত সুযোগ এনে দেয় মাহে রমজান। রমজানের প্রধান আকর্ষণ সিয়াম ও কিয়াম।
সুবহে সাদিকের পূর্বমুহূর্তে বরকতময় সাহারি গ্রহণপূর্বক শুরু হয়ে যায় মাহে রমজানের অন্যতম প্রধান আবশ্যকীয় আমল সিয়াম-সাধনা। রোজা সাধারণ কোন আমন নয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি সাধনা। সাধনা আর পরীক্ষা ছাড়া কেউ কস্মিনকালেও কোনকিছু অর্জন করতে পারেনি। রোজায় আছে পরীক্ষা ও সাধনা। পরম আরাধ্য মওলাকে পাওয়ার সাধনা। মহান আল্লাহর নির্বাচিত বান্দার কাতারভুক্ত হওয়ার সাধনা। দুনিয়া-আখেরাতের ভয় ও চিন্তাকে জয় করে আল্লাহর নৈকট্যধন্য প্রিয় বান্দাদের (ওলী-আউলিয়া) আমল রোজা। প্রভু প্রদত্ত অর্ডার কেরি করতে আমরা একমাস রোজা পালন করলেও আল্লাহর মকবুল বান্দারা হরদম মশগুল থাকতেন এই সাধনায় (রোজা)। সিয়াম বা রোজা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, দাম্পত্য মিলন ও রোজা ভঙ্গ হওয়ার সকল বিষয় থেকে দূরে থাকা। রমজান মাসে রোজা কেন্দ্রিক ফরজ শুধুমাত্র একটি। আর তা হলো পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করা। এ সংক্রান্ত স্পষ্ট নির্দেশ মিলে সর্বযুগের সর্বাধুনিক গ্রন্থ আল-কুরআনে। সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে বলা হচ্ছে, “হে মোমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের প্রতিও; যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।” মালিকের এ চিরসত্য ঘোষণা আল্লাহপ্রেমিদের অন্তরে মুক্তির ভরসা জোগায়। খোদাভীতি অর্জনের অনন্য সোপান সিয়াম-সাধনা।
কঠোরতার নাম ইসলাম নয়। ইসলাম মুক্ত ও সৌন্দর্যের নাম। বিশেষত রোজার মধ্যে ইসলামের অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। মহান আল্লাহর মহানুভবতা রোজায় বেশি পরিস্ফুটিত হয়। মুসাফির আর রোগীর জন্য রোজা কাজা করার অবকাশ রব্বে করিমের মহানুভবতার পরিচয়।
যেমন মহান আল্লাহর বাণী, “তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ থাকে অথবা সফরে থাকে তবে তাদের নির্ধারিত সংখ্যা (রোজা) পরে পূর্ণ করে নেবে; আর যারা রোজা পালনে অক্ষম, তারা (প্রতি রোজার বিনিময়ে) একজন মিসকিনকে খাদ্য ফিদইয়া দেবে। আর যারা উত্তম কর্ম অতিরিক্ত বেশি করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর। যদি তোমরা রোজা পালন করো, তবে তা তোমাদের জন্য, যদি তোমরা বুঝতে!” এ আয়াতের শেষাংশে স্পষ্ট বর্ণনা রোজা আমাদের কল্যাণে। আমরা রোজা রাখলেও আল্লাহর কোনো লাভ নেই, না রাখলেও আল্লাহর কোন ক্ষতি নেই; বরং আমাদের কল্যাণে আল্লাহ রোজার বিধান জারি করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
সিয়াম পালনকারীদের সম্মানে আল্লাহ জান্নাতকে বিশেষভাবে সজ্জিত করেন। শাহিন শাহে রিসালাত নবী মুহাম্মদ (সা:) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পূর্ণ ইমানের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের আশায় রমজানে রোজা পালন করবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।”
রোজা পালনের মাঝে রয়েছে মাগফিরাতের গ্যারান্টি। আল্লাহর রহমত পাওয়ার নিশ্চয়তা। আগুন (জাহান্নাম) থেকে বেঁচে মঞ্জিলে মকসুদে (জান্নাত) পৌঁছানোর সওগাত।
হাদিসে কুদসিতে মালিকের ভাষ্য- “রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই রোজার প্রতিদান প্রদান করবো।” মহান আল্লাহর এ ফরমান, রোজাদারকে তোলে দেয় এক অনন্য উচ্চতায়। সত্যিকার অর্থে রোজ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
মাহে রমজানের চাঁদ দেখার পুণ্য হাসিলের মাধ্যমে শুরু হয় ধৈর্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ রোজার তোড়জোড়। সিয়াম সাধনার মাসে যে শুধু সিয়ামই আছে তা কিন্তু নয়। ইবাদতের ভরা বসন্ত মাহে রমজানের দিন শুরু হয় প্রভুভক্তির সিয়ামে; আর রাতে আছে কিয়াম (তারাবিহ)। সাহরি, ইফতার, ইতেকাফ, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলোয়াত, নফল ইবাদত, দান-খয়রাত, জিকির, দরুদ-সালাম আর কুরআনের রজনী লাইলাতুল কদর তো আছেই মহিমান্বিত রমজানে। খোদার রাহে সিয়ামের মাধ্যমে মালিকের সুদৃষ্টি, পবিত্রতম অশ্রুজলে অতীত পাপ মার্জনা আর মওলার সন্তুষ্টি অর্জনে মুক্তির মহা অফার মাহে রমজান।
মুসলিম মাত্রই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুনিব প্রদত্ত আবশ্যকীয় ডিউটি। ঈমানদারের নিদর্শনও বটে। যে নামাজ বান্দার মেরাজ। রমজান মাসে নামাজে আসে ভিন্ন মাত্রা। মসজিদের মিনার থেকে যখন ভেসে আসে এশারের আজান তখন মা-বোনরা ঘরে আর পুরুষদের লক্ষ্য মসজিদ।
মসজিদ ভর্তি মুসল্লী। মসজিদের বুকে ভরা মজলিস পেয়ে মসজিদের ইট বালিরও খুশির অন্ত নেই। এশারের ফরজ ও সুন্নাত শেষে ইমাম সাহেব নিয়ত করেন বিশেষ এক সালাতের। নাম তার সালাতুত তারাবি!
তারাবি শব্দটি আরবি তারভিহাতুন থেকে, যার অর্থ বিশ্রাম করা, প্রশান্তি লাভ করা। তারাবি নামাজে যেহেতু প্রতি চার রাকাত পর পর একটু বিশ্রাম নিয়ে তাসবিহ ও দোয়া পাঠ করা হয়, তাই এই নামাজকে সালাতুত তারাবিহ বা তারাবি নামাজ বলা হয়। রমজান মাসে তারাবির নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। তারাবি বিশ রাকাত সুন্নাত। এটা রাসুল (সা:), সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের আমল দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি এবং বিতির পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা)। আবু দাউদ শরীফের রেওয়াত: হযরত আলী ইবনে হাসান (রা:) থেকে বর্ণিত, হযরত ওমর (রা:) এর নির্দেশে লোকদেরকে নিয়ে উবাই বিন কাব (রা:) বিশ রাকাত তারাবি পড়েছেন। এভাবে খলিফা হযরত ওমর, হযরত ওসমান, হযরত মওলা আলী (রা:)-সহ সকল সাহাবীদের ঐক্যমতে বিশ রাকাত তারাবি পড়া হয়েছে। যেটা গুরুত্বের দিক থেকে ওয়াজিবের কাছাকাছি। তারাবি সম্পর্কে রাসুল (সা:) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকীর আশায় কিয়ামুল লাইল তথা তারাবি আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে। আমরা পাপীতাপীদের জন্য পাপ মার্জনার সুবর্ণ সুযোগ বিশ রাকাত তারাবি। এ অফার রমজান মাসেই সীমাবদ্ধ। তারাবির জামাত শেষে বিতিরও জামাতে। বাহ! আজ ইবাদতের বাধ ভেঙেছে। পুণ্য আর পুণ্য। পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের কবিতায় ফুটে উঠেছে তারাবি’র আনুষ্ঠানিকতা। নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ, মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ। চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া, ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া। তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে, চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লুন্ঠন-বাতি জ্বেলে। ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও। মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।’
লেখক-
ইসলামিক গবেষক ও তরুণ বক্তা।