মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধীর সম্মান বনাম বিজেপি নেতার কটূক্তি
এম সাইফুল ইসলাম নেজামী আলকাদেরী
“আমি সর্বপ্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় যাই, একজন মুসলমানের মালিকানাধীন আইনি প্রতিষ্ঠান বা ল’ ফার্মে চাকরির সুবাদে। সেখানে আমার কয়েকজন মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে মেশার সৌভাগ্য হয়, যা বছরের পর বছর বজায় ছিল। এই সম্পর্কের সূত্র ধরে আমি উপলব্ধি করি যে, নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন সম্পর্কে আমার জানা উচিত। আমি দক্ষিণ আফ্রিকাতেই তাঁর সম্পর্কে জানা শুরু করি। কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না কিন্তু ভারতে ফিরে আমি কারারুদ্ধ হই। এই কারাগার আমার জীবনে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী পাঠ করার সৌভাগ্য নিয়ে আসে। আমার পাঠলব্ধ জ্ঞান থেকে আমি অনুধাবন করি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন সত্যের সন্ধানী। তিনি ছিলেন খোদাভীরু। আমি জানি, তোমাদের নতুন কিছু বলছি না। আমি শুধু বুঝাতে চাই কীভাবে তাঁর জীবনী আমাকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করেছে।” উপরোক্ত কথামালা আমার নয়। এই সত্যবচন ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর। প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসন, শোষণ এবং সীমাহীন অত্যাচার থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া এক ক্ষণজন্ম চরিত্র মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী ওরফে মহাত্মা গান্ধী। ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকা ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘দি প্রফেট ওয়াজ এ সিকার অব ট্রুথ: মহাত্মা গান্ধী’ অর্থাৎ মহানবী (সা.) ছিলেন একজন সত্যের সন্ধানী এ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। প্রবন্ধ মতে, ১৯৩৪ সালের ২৩ জুন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে মহাত্মা গান্ধী আহমেদাবাদে আঞ্জুমান-এ ফিদাই ইসলাম নামক একটি সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে মহানবী (সা.)-এর অসাধারণ জীবনীর ওপর উপরোক্ত মন্তব্য করেন। মহাত্মা গান্ধী মহানবী (সা.) সম্পর্কে আরও বলেন, “হজরত মুহাম্মদ (সা.) দারিদ্র্যের মাঝে দিন অতিবাহিত করেছেন, অথচ তাঁর সামনে ছিল অগাধ ধনসম্পদ লাভের সুযোগ। আমি যখন তাঁর নিজের, পরিবার এবং অনুসারীদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা ও দারিদ্র্যের কথা অবগত হয়েছি, তখন আমার চোখ ভিজে যায়। তিনি স্রষ্টার প্রতি একনিষ্ঠ ও অনুগত ছিলেন, সর্বদা স্রষ্টাকে ভয় করতেন এবং তাঁর মনে ছিল মানবজাতির জন্য প্রবল মায়া-মমতা।” বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অমীয় বাণী হাদিসগ্রন্থ পড়ে গান্ধী এতই মুগ্ধ হন যে, এই হাদিস তথা মহানবী (সা.)-এর বাণীকে তিনি কেবল মুসলমান নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য অমূল্য সম্পদ বলে উল্লেখ করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দি ডেইলি স্টার পত্রিকার মাসিক প্রকাশনা ‘দি ফোরাম’-এর আগস্ট ২০১০ সংখ্যায় ‘গান্ধী অ্যান্ড ইসলাম’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধ মতে, মহাত্মা গান্ধী মহানবী (সা.) সম্পর্কে জানতে এতই আগ্রহী ছিলেন যে, যখন তিনি মহানবী (সা.) সম্পর্কিত পড়ার মতো কিছুই পেতেন না, তখন খুবই দুঃখ অনুভব করতেন। মহাত্মা গান্ধী বলেন “আমি শ্রেষ্ঠতম সেই মানুষের জীবন সম্পর্কে আরও জানতে চাই, যিনি আজ কোটি মানুষের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে আছেন। আমি নিশ্চিত যে, এর নেপথ্যে তরবারি বা গায়ের জোরে নয়; বরং মহানবী (সা.)-এর সারল্য, আত্মত্যাগ, দৃঢ়সংকল্প, ভক্ত ও অনুসারীদের প্রতি মমত্ববোধ, সৎসাহস সর্বোপরি নিজের উদ্দেশ্য ও সৃষ্টিকর্তার ওপর অগাধ আস্থা তাঁকে এই সাফল্য এনে দিয়েছিল।”
ভারতীয় লেখক ও গবেষক অধ্যাপক কে এস রামকৃষ্ণ রায় বলেন “হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন অনুকরণীয় মানুষ বা নিখুঁত মডেল। বহু মাত্রিক কর্মক্ষেত্রে এবং মানবতার সব শাখায় তিনি ছিলেন সর্বেসর্বা বা বীর। সব মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার রীতি ও সব মানুষের মাঝে সাম্য সৃষ্টির তত্ত্ব ঘোষণা এবং প্রচারের মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ (সা.) সমাজে মানবতাকে উচ্চস্তরে স্থান করে দিয়েছেন।” এছাড়াও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, স্যার পিসি রাম, স্বামী আহিয়ার, স্বামী বিবেকানন্দ, সবোজনী নাইডু, এনি এ বেচান্ত, বেদ প্রকাশ উপাধ্যায়, সুশান্ত ভট্টচার্য, এম এন রায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বি এন পান্ডে, স্বামী লক্ষী শংকরাচার্যদের চোখ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজন (সা.)-কে চিনতে ভুল করেনি। তারাও স্বীকার করেছেন মরুর দুলাল নবী মোস্তফা (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব।
বিশ্বখ্যাত অমুসলিম মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ, থমাস কারলাইল, লিও টলস্টয়, মাইকেল এইচ হার্ট, আর বোসওর্থ স্মিথ, ওয়াশিংটন ইরভিং, উইলিয়াম ড্রাপার, আলফোন্স ডি লামার্টিন, উইলিয়াম মন্টগোমেরি ওয়াট, অ্যাডওয়ার্ড গিবন, স্ট্যানলে লেন-পুল ও জুলস মাসেরম্যান প্রিয় নবী (সা.)-এর শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তাঁর অনুকরণীয় আদর্শ, শিষ্টাচার, সুমধুর ব্যবহার, নিষ্ঠাবান সংগ্রামী জীবন, পর্যবেক্ষণ পারদর্শিতা, বিচক্ষণতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, নারী অধিকার, মানবাধিকার, সামাজিক দায়িত্ব পালন, অতিথি আপ্যায়ন ও আর্ত-পীড়িতের সেবা, প্রতিবেশী-আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সদাচারণ ইত্যাদির প্রতি বিমোহিত হয়ে মহানবী (সা.)-এর প্রতি সানন্দে সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
প্রিয় নবীকে কটূক্তিকারী নির্লজ্জদের কাতারে শামিল হয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মুখপাত্র নুপুর শর্মা ও নবীন কুমার জিন্দাল। যেখানে ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধী ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুসহ ভারতীয় পন্ডিতরা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন, সেখানে মহানবী (সা.) প্রতি বিজেপি নেতার কটূক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত নিজেদের সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে। সেক্ষেত্রে ভারতের ত্রিশ কোটিসহ পৃথিবীর দু’শ কোটি মুসলমানের হৃদয়ের সূর্য হুজুর (সা.)-কে কটূক্তি: নিঃসন্দেহে সংবিধান অবমাননা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ।
কলামিস্ট ও ইসলামী বক্তা
এম সাইফুল ইসলাম নেজামী আলকাদেরী