মানব সৃষ্টির ইতিহাস
যুবায়ের বিন আখতারুজ্জামান
“কোথা থেকে এলাম আমি”— এ জিজ্ঞাসা মানুষের আজকের নয়; বরং হাজার হাজার বছরের। এ যাবত এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে যে ধারণা গড়ে উঠছিল তা ধর্মীয় শিক্ষা আর দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কেন্দ্র করে। এসব কিছুই ছিল বিশ্বাস ও ধারণা প্রসূত। কিন্তু হাল আমলে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মানুষ এমন এক ভিত্তিতে রয়েছে যা যুক্তিতর্ক ও পরিসংখ্যানের উপর দণ্ডায়মান। মানুষের অনুসন্ধানী মন যে নিজের আদি সম্পর্কে জানতে কতটা তৎপর সেটা ডারউইনের ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পেসিস’ গ্রন্থের জনপ্রিয়তা দেখেই বোঝা যায়।
ডারউইনের পুরো গ্রন্থ জুড়ে আছে মানুষের আদি উৎস সম্পর্কে এক প্রস্তাবনা। যা অনেকে থিউরি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে বস্তুবাদের দর্শনকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে এরূপ প্রস্তাবনার প্রয়োজন ছিল। তাই হাল আমলে অনেক বিজ্ঞানীদের ডারউইনবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মিথ্যা অপপ্রচার করতে দেখা যায়। আবার কিছু বিজ্ঞানীদের দেখা যায় ডারউইনবাদীদের অন্তঃসারশূন্য ‘থিউরি’ ভুল প্রমাণ করতে। যেহেতু আমরা মুসলিম তাই বৈজ্ঞানিক কথার সাথে ধর্মীয় কিছু কথা জানা প্রয়োজন।
মহান আল্লাহ তাআলা মানবজাতির পূর্বে দুনিয়ায় বসবাসরত নাফরমান জ্বীনদের ফেরেস্তা কর্তৃক বিতাড়িত করলেন। যারা দুনিয়ায় আল্লাহর নাফরমানি করে দাঙ্গা-মারামারি, ফিতনা-ফাসাদে লিপ্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহর তাআলা ফেরেস্তাদের ডেকে বললেন, “আমি পৃথিবীতে খলিফা বানাতে যাচ্ছি।” এটা শুনে ফেরেস্তারা বললেন, “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং মারামারি করবে? অথচ আমরা নিয়মিত আপনার গুণকীর্তন করছি এবং আপনার পবিত্র সত্ত্বাকে স্মরণ করছি৷” আল্লাহ বললেন, “নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জানো না।”[১]
অতঃপর আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করলেন। তিনি বলেন, “আমি মানবকে পচা কর্দম হতে তৈরি বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্টির করেছি।”[২] অন্যত্র বলেন, “তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে।”[৩] অর্থাৎ মানব সৃষ্টির মূল উপাদান হল— মাটি। হাদিস শরিফে আবু মুসা আশআরী হতে বর্ণিত হয়ে এসেছে— রাসুল স. বলেছেন, ‘পৃথিবীর সর্বত্র থেকে মাটি নিয়ে আল্লাহ তাআলা আদম আ.-কে সৃষ্টি করেছেন। তাই আদম সন্তানরা মাটির বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয়েছে। যেমন তাদের মধ্যে কেউ লাল, সাদা ও কালো বর্ণের। আবার কেউ এসবের মাঝামাঝি। কেউ নরম ও কোমল প্রকৃতির, আবার কেউ কঠোর প্রকৃতির। কেউ মন্দ স্বভাবের, আবার কেউ ভালো স্বভাবের।’[৪]
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, আদম আ. হাঁচি দেওয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ… বলেছেন।এটাই আদম আ. তথা মানুষের প্রথম কথা। এখন কথা হচ্ছে, যারা দাবী করে থাকেন মানুষ শুরুতে কথা বলতে জানত না তাদের দাবি কতটা যৌক্তিক। তারা যদি সরাসরি স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তবুও প্রশ্ন থেকে। হুটহাট করে একটা ইতর প্রাণীর কথা বলা কি আশ্চর্যজনক নয়?! আসলে এ ধরনের দাবি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাকি অজ্ঞতা তা বলা শক্ত। অধুনা সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক ব্যক্তি এমন বিশ্বাস লালন করেন, যা কুরআন পরিপন্থী। পবিত্র কুরআনে এসেছে, “আর আল্লাহ তাআলা আদকে সমস্ত বস্তুসমূহের নাম শেখালেন।তারপর সে সমস্ত বস্তুসমূহ ফেরেস্তাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর না বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাকো। তারা বললেন, আপনিই পবিত্র। আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন তা ব্যতীত আমরা কোনো কিছুই জানি না। নিশ্চয়ই আপনি জ্ঞানসম্পন্ন ও হেকমতওয়ালা। তিনি বললেন, সে আদম! ফেরেস্তাদের বলে দাও এসবের নাম। তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সেসবের নাম, তখন তিনি(আল্লাহ) বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে— আসমান যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত রয়েছি। এবং সে সেসব বিষয়ও জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর।” [৭]
হাল আমলে কিছু মুসলিম স্কলার কুরআনকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ সামনে রেখে ডারউইনবাদী চিন্তা-চেতনার হালে পানি দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা প্রস্তাব পেশ করছেন— যেহেতু পৃথিবী পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি; তাই এইপ থেকে বিবর্তন হয়ে কোনো উন্নত প্রাণীর ভেতর আল্লাহ রূহ ইন্সটল করে দিয়েছেন। যার ফলে সে এখন শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। তবে এরূপ উদাহরণের উপর কিছু আলোচনা করার জায়গা রয়েছে। এটা হয়তো আরবি ভাষার বিস্তৃতির জন্যই সম্ভব হয়েছে।
উদাহরণ ১:
الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَآءَ بِنَآءً ۪
উদাহরণ ২:
وَلَا تُؤۡتُوا السُّفَہَآءَ اَمۡوَالَکُمُ الَّتِیۡ جَعَلَ اللّٰہُ لَکُمۡ قِیٰمًا
অপরদিকে خلق ব্যবহার হয় যেসকল জিনিস অস্তিত্বে ছিল না, শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এমন কিছু। এটা শুধু মাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। বোঝার স্বার্থে এখানেও দুইটা উদাহরণ আনছি।
ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ
“তিনি নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করেছেন ছয়দিনে…”[১০] এবার উপরের ১ম উদাহরণ টি দেখুন। ওখানে جعل ব্যবহার করা হয়েছে অস্তিত্বে আসার পর। আর নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের অস্তিত্ব সৃষ্টি করার ব্যাপারে خلق ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ শূন্য থেকে অস্তিত্বে আনার ব্যাপারে خلق ব্যবহার হয়।
ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ طِیۡنٍ
“তিনিই তোমাদেরকে মাটির দ্বারা সৃষ্টি করেছেন…”[১১] আশাকরি এখন বিষয়টা পাঠকের সামনে পরিষ্কার। মহান আল্লাহ তাআলা মাটি দ্বারা মানুষকে সরাসরি অস্তিত্বে এনেছেন। তাই خلق ব্যবহার করেছেন। যদি অন্যকোনো প্রাণী বিবর্তিত হয়ে মানুষ হত তবে কুরআনের ভাষ্যমতে جعل ব্যবহার হওয়ার যুক্তিযুক্ত ছিল। তাই যারা ব্যাখ্যার সুযোগকে সামনে রেখে জগাখিচুড়ি পাকাতে চায় তাদের এখনই সাবধান হওয়া উচিৎ। উপরন্তু সুস্পষ্ট বিষয়ের উপর কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে।”[১২] আল্লাহ যেখানে মানুষকে সরাসরি সৃষ্টির কথা বলেছেন সেখানে কোনোরূপ ছলচাতুরী গ্রহণযোগ্য নয়।
তথ্যসূত্র:
১. সুরা বাকারা:৩০
২. সুরা হিজর: ২৬
৩. সুরা আর-রহমান:১৪
৪. তিরমিজি: ২৯৫৫
৫. সুরা হিজর: ২৯
৬. ইবনে হিব্বান: ৬১৬৫
৭. সুরা বাকারা: ৩১-৩৩
৮. সুরা বাকারা: ২২
৯. সুরা নিসা: ৫
১০: সুরা হাদীদ: ৪
১১. সুরা আনআম:২
১২: সুরা তীন: ৪