বিভিন্ন মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ: একটি পর্যালোচনা
সেনানী ডেস্ক
প্রথমে কিছু পরিভাষা জেনে নেয়া যাক…
ইজতিহাদঃ
ইজতিহাদের শাব্দিক অর্থ হলো- লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাসাধ্য পরিশ্রম করা। ইসলামী ফিক্বহ শাস্ত্রের পরিভাষায় ইজতিহাদ অর্থ- কুরআন ও সুন্নাহতে যে সকল আহকাম ও বিধান প্রচ্ছন্ন (অপ্রকাশিত) রয়েছে সেগুলো চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে আহরণ করা।
মুজতাহিদঃ
যিনি ইজতিহাদ করেন তিনি হলেন মুজতাহিদ। শরীয়তের পরিভাষায় ঐ ব্যক্তিকে মুজতাহিদ বলা হয়, যিনি কুরআনুল ক্বারীমের ইলম বা তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের সকল নীতিমালা এবং ইলমে হাদিসের সনদ, মতন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে পারদর্শী, বিশুদ্ধ কিয়াসে যোগ্যতাসম্পন্ন ও মানব সমাজের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ সম্পর্কে পরিপূর্ন ওয়াকিবহাল ।
মুজতাহিদ এসব যোগ্যতা দিয়ে কুরআন-হাদিস থেকে শরীয়াতের হুকুম আহকাম আহরন করার ব্যাপারে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন।
মাযহাবঃ
মাযহাব মানে মতামত, বিশ্বাস, আদর্শ, পন্থা, মতবাদ, উৎস ইত্যাদি।
মুজতাহিদ কতৃর্ক কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যে সকল আহকাম ও বিধান বের করে আনা হয় সেগুলোই হলো মাযহাব।
নিম্নে নববী যুগ থেকে শুরু করে প্রধান চার মাযহাবের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও স্থায়িত্ব নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলোঃ
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগঃ
নাবী কারীম (সা.) কুরআনে বর্ণিত আয়াত সমূহ থেকে খুঁটিনাটি বিধি-বিধান বের করে এনেছেন। সেগুলো সঠিক হলে আল্লাহ তায়ালা সত্যায়ন করেছেন। অন্যথায় তা সংশোধন করে দিয়েছেন। যেমন, জিহার তালাকের ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর রায়কে আল্লাহ সুবহানুতায়ালা আল-মুজাদালাহ সূরার ১ ও ২ নং আয়াতের মাধ্যমে সংশোধন করে দিয়েছেন।
ন্যায়নিষ্ঠ প্রথম চার খলিফার ইজতিহাদঃ
খিলাফত প্রাপ্তির পর অসংখ্য নতুন সমস্যা মোকাবেলার জন্য প্রথম চার খলিফা ইজমা ও ইজতিহাদের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতেন। পরবর্তীতে এগুলোই ইসলামী আইন তথা ফিকহ শাস্ত্রের ভিত্তিতে পরিণত হয়।
কোন সমস্যা সমাধানে প্রথম চার খলিফার পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপ:
০১. প্রথমে তারা কুরআনে সমস্যাটির সুনির্দিষ্ট সমাধান খুঁজতেন।
০২. কুরআনে না পেলে সুন্নাহতে অনুসন্ধান করতেন।
০৩. সুন্নাহতে সমাধান না পেলে তখন বিশিষ্ট সাহাবীদের ডেকে বৈঠকের মাধ্যমে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করতেন। সাহাবীদের এই ধরণের ঐক্যমতকে ইজমা নামে অভিহিত করা হয়।
০৪. যদি সাহাবীদের মাঝে মতপার্থক্য আসতো, সে ক্ষেত্রে খলিফা নিজেই ইজতিহাদ করতেন এবং তখন তা আইনে পরিণত হতো।
ইজতিহাদ ও ইজমা সংক্রান্ত প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে স্ব স্ব খলিফার মতামত ছিল চূড়ান্ত।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাহাবীদের ইজতিহাদঃ
সাহাবীদের অনেকেই কুরআন-সুন্নাহ ও আলোচিত হয়নি এমন সব বিষয়ে ব্যক্তিগত মত ব্যবহার করতেন।
ব্যক্তিগত মত প্রদানে মদিনায় আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এবং ইরাকের কুফায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ছিল। তাদের এই মতপার্থক্যকে পরবর্তী যুগের আলিমদের বিভিন্ন মাযহাবে বিভক্ত হওয়ার সূচনা বিন্দু কিংবা প্রচ্ছন্ন পূর্বভাস হিসেবে দেখা যেতে পারে।
তাবেঈ গনের যুগে ফিতনাঃ
তাবে’ঈ গনের যুগে দুটি বিষয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটলো:
প্রথমত, উমাইয়া রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ খলিফার সভাসদে শামিল হতে অসম্মতি জানান। তারা খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র হতে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েন।
এসময় মুসলমানগন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মতবিরোধের প্রচন্ড ঝড় বইতে শুরু করে এবং কঠোর ঝগড়া-বিবাদ দেখা দেয়। এই সুযোগে কাফির ও ফাসিকরা ইসলামের ক্ষতি করতে অধিকহারে ভুল ফাতওয়া প্রচার করতে থাকে।
মুসলিম উম্মাহ এই ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে দলাদলির শিকার হয়ে খারিজি, শিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন দলে বিভক্ত হতে থাকে। অন্যদিকে খারিজি এবং শিয়া আবার বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়। এরা এমন অভিনব চিন্তা করতো যে, তারা নিজেদেরকে ইসলাম থেকে পৃথক করে নিলো।
এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও বিভেদের ফলে মিথ্যা ও জাল হাদিসের চর্চা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। এতে মুসলমানগন অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় এ কঠিন ফিতনার অবদমনে বিশুদ্ধ ও অবিশুদ্ধ হাদিস পৃথকীকরণ এবং সঠিক মাসালা মাসায়েল প্রচারের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, এ সময়ে সমস্যা সমাধানে আলেমদের মাঝে দুটি প্রধান ধারা লক্ষ্য করা যায়।
একটি হলো “আহালুল হাদিস” যারা ব্যক্তিগত মতের চেয়ে শুধুমাত্র কুরআন এবং হাদিস থেকেই মত দেয়ার পক্ষে ছিলেন। যে বিষয়গুলোর সমাধান কুরআন-হাদিসে পেতেন না, সেগুলো বিষয়ে মত দিতেন না। চুপ থাকতেন। এই বিশেষজ্ঞদের কেন্দ্র ছিল মদিনা মুনওয়ারা।
আরেকটি হলো “আহলুল রা’য়” যারা কুরআন এবং হাদীসের সাথে সাথে সাহাবীদের কর্মপদ্ধতি ও যুক্তি-বুদ্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মতামত দিতেন। এই বিশেষজ্ঞদের কেন্দ্র ছিল ইরাকের কুফা। বিশেষজ্ঞগন ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর ছাত্র। আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) ছিলেন এমন মহান ব্যক্তি, যিনি ভুল হওয়ার ভয়ে অনির্ভরযোগ্য হাদিস রিওয়ায়াত থেকে প্রায়শই বিরত থাকতেন।
প্রথমদিকে অসংখ্য মাযহাবের উৎপত্তি হলেও এ যুগে এসে মাত্র চারটি মাযহাব স্থায়িত্ব পায়। সেগুলো হলো হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বলি মাযহাব।
ইসলামী আইনের উৎসঃ
ইসলামী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে উৎসগুলো থেকে বিধি-বিধান তৈরি করা হয় সেগুলো হলোঃ
০১.কুরআন: ইসলামী আইনের প্রধান উৎস।
০২.সুন্নাহ: ইসলামী আইনের ২য় প্রধান উৎস।
০৩.ইজমা: কোন বিষয়ে সাহাবি, তাবে’ঈ এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সকল আলেমদের ঐক্যমতকে ইজমা বলে।
০৪.কিয়াস: যেসব আইনের উদ্দেশ্যবলি আল্লাহ তায়ালা অথবা রাসূল (সা.) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই একই উদ্দেশ্য সাধনে উল্লিখিত আইনগুলোকে মূলনীতি হিসেবে ব্যবহার করে বর্তমান কোন বিষয়ে অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে কিয়াস বলে।
০৫.উরফ (প্রথা): ইসলামের কোন মূলনীতি বা বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে স্থানীয় প্রথাগুলো ওই অঞ্চলের আইনের একটি উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়।
০৬.ইসতিহসান: ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) ইসতিহসান নীতির প্রবর্তক। এ নীতির মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ। একারনে ইমাম আবু হানিফা র. ইজতিহাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় কিয়াসের উপর ইসতিহসানকে স্থান দিতেন।
০৭.ইসতিসলাহ: ইমাম মালিক (র.) এ মূলনীতির প্রবর্তক। মানুষের জন্য কল্যাণকর অথচ শরিয়ায় সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই এমন বিষয়কে ইসতিসলাহ বলে।
০৮.ইসতিসহাব: ইমাম শাফি’ঈ (র.) এই মূল নীতির প্রবর্তক। আইনের পরিভাষায় শব্দটি দ্বারা পূর্বের কোন পরিস্থিতির সাথে নতুন পরিস্থিতির সংযোগ ঘটানোর মাধ্যমে ফিক্বহে আইন বের করার পদ্ধতিকে বোঝায়।
প্রধান চার মাযহাবের সংক্ষিপ্ত আলোচনাঃ
০১. হানাফী মাযহাবঃ
হানাফী মাযহাবের প্রাণপুরুষ ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) (৭০৩-৭৬৭ খ্রি) ইরাকের কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। তাকে তাবি’ঈ হিসাবে গণ্য করা হয়। কারণ তিনি বেশ কয়েকজন সাহাবীর সাথে সাক্ষাত লাভ করেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে হাদিস শিখেছিলেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম হানাফী মাযহাবের অনুসারি।
ইজতিহাদের ক্ষেত্রে আবু হানিফা (র.) যে মূলনীতি গুলো অনুসরণ করতেনঃ
ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) প্রথমেই কুরআনে প্রদত্ত সমস্যার সমাধান খুঁজতেন। সেখানে না পেলে রাসুল (সা.) এর হাদিস ও সুন্নাহতে খুঁজতেন। কুরআন ও সুন্নাহতে না পেলে সাহাবীদের ইজমাতে খুঁজতেন। যখন কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কিরামের ইজমাতে সমাধান না পেতেন, তখন ইজতিহাদ করতেন এবং সংঘটিত সমস্যার উপর সামগ্রিকভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে কখনো কিয়াস, কখনো ইসতিহসানের উপর আমল করতেন। মানুষের কল্যাণ ও অসুবিধা দূরীকরনই ছিল তার নীতির দিকদর্শন। এ নীতি থেকে তিনি কখনো বাইরে যেতেন না।
হানাফী মাযহাবের আইনের উৎস:
কুরআন, আস-সুন্নাহ, সাহাবীগণের ইজমা, সাহাবীগণের ব্যক্তিগত মত, কিয়াস, ইসতিহসান (আইনগত প্রাধান্য), উরফ (প্রথা)।
হানাফী মাযহাবের প্রধান ছাত্রবৃন্দ:
১.আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম (র.)
২.মুহাম্মদ ইবন হাসান আশ শাইবানি (র.)
৩.যুফার ইবন হুযায়ল আম্বারী (র.)
৪.হাম্মাদ ইবন আবু হানিফা (র.)
৫.হাসান ইবন যিয়াদ (র.) সহ আরো অনেকে।
যেসব দেশে হানাফী মাযহাব অনুসরন করা হয়ঃ
বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, মিশর, গায়ানা, ত্রিনিদাদ সহ অসংখ্য দেশে এ বৃহৎ মাযহাবের প্রচলন রয়েছে।
০২. মালিকি মাযহাবঃ
মালিকি মাযহাবের প্রবক্তা ইমাম মালিক ইবনে আনাস (র.) (৭১৭-৮০১ খ্রি) মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা আমির (রা.) ছিলেন মদিনার প্রধান সাহাবীদের অন্যতম।
আল মুয়াত্তা গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করার পর ইমাম মালিক (র.) তা নিজ মাযহাব হিসেবে তাঁর ছাত্রদের পড়ানো শুরু করেন।
মালেকী মাযহাবে আইনের উৎসঃ
কুরআন, আস-সুন্নাহ, সাহাবীগণের ইজমা, সাহাবীগণের ব্যক্তিগত মত, কিয়াস, মদিনাবাসীর প্রথা, ইসতিসলাহ, উরফ (প্রথা)
মালেকী মাযহাবের প্রধান ছাত্রবৃন্দঃ
১.আবু আব্দুর রহমান ইবন আল কাসিম
২.আবু আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহা
মালেকী মাযহাবের অনুসারী দেশঃ
মিশর, সুদান, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, মালি, নাইজেরিয়া, চাঁদ, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন প্রভৃতি।
০৩. শাফেয়ী মাযহাবঃ
ইমাম শাফেয়ী (র.) (৭৬৯-৮২০ খ্রি) সাম এলাকার গাজা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম মালিক (র.) ছিলেন তার শিক্ষক।
ইমাম শাফেয়ী (র.) মালেকী এবং হানাফী ফিক্বহকে সমন্বিত করে একটি নতুন মাযহাব প্রবর্তন করেন এবং ‘আল হুজ্জাহ’ নামক গ্রন্থ সংকলন করে নিজ ছাত্রদের পড়ানো শুরু করেন।
শাফেয়ী মাযহাবের আইনের উৎসঃ
কুরআন, আস-সুন্নাহ, সাহাবীগণের ইজমা, সাহাবীগণের ব্যক্তিগত মত, কিয়াস, ইসতিসহাব।
শাফেয়ী মাযহাবের প্রধান ছাত্রবৃন্দঃ
১.ইমাম আল মুযানি
২.আর রাবী মারাদি
৩.ইউসুফ এবং ইয়াহিয়া বুয়াইতি
যেসব দেশে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী বৃন্দ রয়েছেঃ
মিশর, ইয়েমেন, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়া, সুরিনামে ।
০৪. হাম্বলী মাযহাবঃ
ইমাম আহমদ হাম্বল (র.) (৭৭৮-৮৫৫) বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম আবু হানিফার (র.) বিখ্যাত ছাত্র আবু ইউসুফ (র.) এর অধীনে হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এছাড়া ইমাম শাফি’ঈ (র.) এর নিজ তত্ত্বাবধানে ফিক্বহ ও হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ইমাম আহমদ (র.) এর মূল লক্ষ্য ছিল হাদীস সংগ্রহ বর্ণনা ও তার ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি ৩০ হাজারেরও বেশি হাদিস নিয়ে ‘মুসনাদে আহমদ’ গ্রন্থ সংকলন করেন।
হাম্বলী মাযহাবে আইনের উৎসঃ
কুরআন, আস-সুন্নাহ, সাহাবীগণের ইজমা, সাহাবীগণের ব্যক্তিগত মত, জয়ীফ বা দুর্বল হাদিস (সমস্যা সমাধানে উপরোক্ত চারটি উৎসের কোথাও সমাধান না পাওয়া গেলে ইমাম আহমদ নিজ মতামত ব্যবহারের চেয়ে দুর্বল হাদীসের ব্যবহার কে প্রাধান্য দিতেন), কিয়াস।
হাম্বলী মাযহাবের প্রধান ছাত্রবৃন্দঃ
ইমাম আহমদের প্রধান ছাত্র ছিলেন দুই পুত্র সালিহ ও আব্দুল্লাহ। এছাড়া ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম তার তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করেছিলেন।
যেসব দেশে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী বৃন্দ রয়েছেঃ
এ মাযহাবের বেশিরভাগ অনুসারী ফিলিস্তিন ও সৌদি আরবে।
আব্দুল আজিজ ইবনে সাউদ সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পর হাম্বলী মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিণত করেন। একারনে সৌদি আরবে হাম্বলী মাযহাবের প্রচলন দেখা যায়।
এবার দুটি প্রশ্নঃ
০১.মাযহাব কি মানতেই হবে?
০২.কুরআন ও হাদীস দেখে আমল করলে অসুবিধা কোথায়?
মাযহাব পালনের কথা এজন্য বলা হয় যে, যেহেতু কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে বিজ্ঞ আলেম খুবই নগণ্য। যারাও রয়েছেন তাদের বেশিরভাগ কুরআন কারীমের কোন আয়াতের হুকুম রহিত হয়ে গেছে, কোন আয়াতের হুকুম বহাল আছে, কোন আয়াত কোন প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াত কাদের উদ্দেশ্য করে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াতাংশের প্রকৃত অর্থ কি, কোন বাক্য আরবী ব্যাকরণের কোন নীতিতে পড়েছে, কোন আয়াত বা হাদীসে কী কী অলংকারশাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না। সেই সাথে কোনটি সহীহ হাদিস আর কোনটি দুর্বল হাদিস, কোন হাদিস কি কারণে দুর্বল, কোন হাদিস কী কারণে শক্তিশালী, এছাড়া হাদিসের বর্ণনাকারীদের জীবনী একদম নখদর্পনে থাকা আলেম তেমন নেই বললেই চলে।
আর এ সকল বিষয়ে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি পাওয়া দুস্কর। যেহেতু অধিকাংশ মানুষই আলেম না, আর মুষ্টিমেয় যারা আলেম তারাও উল্লেখিত সকল বিষয় সম্পর্কে প্রাজ্ঞ নয়, তাই আমাদের পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সঠিক মাসআলা বের করা অসম্ভব। এক্ষেত্রে এমন কোন মত অনুসরন করা প্রয়োজন, যা ইতোমধ্যে প্রজ্ঞাবান ও যোগ্য আলেম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর এ কারনেই মাযহাব অনুসরন করতে বলা হয়।
ইমামদের মধ্যে ইখতিলাফ (মতপার্থক্য):
ইসলামী শরীয়তে লাখো মাসায়েলের মধ্যে মতভেদের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বরং মতপার্থক্য মাসায়েলের তুলনায় অবিসংবাদিত মাসায়েলের পরিমাণ অনেক বেশি। কোন কোন মনীষীর ভাষ্য অনুযায়ী, তিন-চতুর্থাংশেই ফুকাহায়ে কেরামের ঐক্যমত্য রয়েছে। কেবল এক-চতুর্থাংশের মধ্যেই মতভেদ ঘটেছে এবং তাদের মতভেদের পক্ষে সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণ রয়েছে।
আরেকটি ব্যাপার হলো, ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ইখতিলাফ নেই বললেই চলে। অন্যদিকে শাখাগত বিষয়ের মধ্যেও সুন্নত, মুস্তাহাব অপেক্ষা ফরয-ওয়াজিবের ক্ষেত্রে ইখতিলাফ কম।
আবার ফরজ-ওয়াজিব এর মতভেদও অনেকটা দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সম্পৃক্ত, কার্যক্ষেত্রে বিশেষ পার্থক্য নেই। সুন্নত ও মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে যেসব ইখতিলাফ আছে, লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ইখতিলাফ কেবল পদ্ধতিগত। যেমন: সূরা ফাতিহার শেষে ‘আমিন’ বলা সুন্নত। এটা সকলেই স্বীকার করেন কিন্তু ‘আমিন’ উচ্চস্বরে বলা হবে নাকি নিম্নস্বরে এ নিয়ে ইখতিলাফ দেখা দেয়। এ জাতীয় মতভেদ খুব কম সংখ্যক মাসায়েলেই দেখা দিয়েছে। আর এরূপ মতভেদও যেহেতু দলিল-প্রমাণ নির্ভর, তাই অহেতুক বাকবিতণ্ডারূপে এর নিন্দা করার সুযোগ নেই। অনুসারীদের পক্ষে উভয় মতই সমান মর্যাদার দাবি রাখে।
তবে স্বল্পসংখ্যক হলেও এমন কিছু মতবিরোধও আছে যার এক পক্ষের দৃষ্টিতে বিপরীত মত সম্পুর্ন ভুল। যেমন: ‘শরীর থেকে রক্ত বের হলে ওযু নষ্ট হবে, নাকি হবে না’ এ নিয়ে মাযহাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মত পাওয়া যায়।
প্রশ্ন হলো, ইমামদের মাঝে এ মতপার্থক্য কি বৈধ?
মৌলিক আকীদার ক্ষেত্রে মতভেদ কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয় বরং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ ও নিন্দনীয়।
পক্ষান্তরে শাখাগত বিষয়ে মতভেদ এমনই একটি ব্যাপার যা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। এই বাস্তবতার কারণে এজাতীয় মতভেদের সুযোগ রাখা হয়েছে। এমনকি ইসলামে একে প্রশংসিত সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন,
১. ফুকাহায়ে কেরামের মতভেদ যে বৈধ, কুরআন মাজিদে তার স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে সূরা হাশরের ৫ নং আয়াতঃ
“তোমরা যে খেজুর গাছগুলো কেটে ফেলেছো এবং যেগুলো কাণ্ডের ওপর স্থির রেখেছো তা তো আল্লাহর-ই অনুমতিক্রমে।”
ঘটনা হলো এই যে, বানু নাদির অভিযানকালে সাহাবায়ে কিরামকে যখন খেজুর গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। কেউ মনে করলেন এ বাগান তো মুসলিমদের হাতে আসবে, কাজেই ভালো গাছগুলো রেখে দিলেন। আর অন্যরা মনে করলেন, ভালো গাছগুলোও কাটা উচিত, তাতে শত্রুর অন্তর্দাহ বেশি হবে।
তাদের মধ্যে এই যে মতভেদ হলো, আল্লাহ তায়ালার কাছে তা অপছন্দ হয়নি বরং তিনি উভয় কার্যক্রমকে সমর্থন করেছেন এবং উভয় দলের প্রশংসা করেছেন।
সুতরাং শাখাগত বিষয়ে সঠিক চিন্তা ভাবনা প্রসূত মতভেদ বৈধ হওয়ার পক্ষে এর চেয়ে পরিষ্কার দলিল আর কি হতে পারে?
২. ফিকহী ইখতিলাফ যে বৈধ বিভিন্ন হাদিস দ্বারাও তা প্রমাণিতঃ
রাসূল (সা.) বলেন, “বিচারক যদি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করে এবং সেটাতে পৌঁছতে সক্ষম হয় তবে তার দ্বিগুণ সওয়াব। আর চেষ্টা করেও যদি তার ভুল হয়, তবে তার এক গুন সওয়াব। (বুখারী- ৭৩৫২, মুসলিম- ৪৪৬২)
৩. মতভেদ বৈধ হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে সাহাবায়ে কিরামের ইজমাঃ
ক. আবু বক্কর সিদ্দিক (রা.) মীরাসে দাদাকে সর্বাবস্থায় পিতার স্থানে গণ্য করতেন কিন্তু উমর ও আলী (রা.) ক্ষেত্র বিশেষে পার্থক্য করতেন।
(বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ২/২৫৮)
খ. মুমূর্ষ অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিলে সেই স্ত্রী মীরাস পাবে কিনা?
উসমান (রা.) মনে করতেন পাবে। এমনকি স্বামীর মৃত্যু যদি স্ত্রীর ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পরেও হয়।
কিন্তু উমর (রা.) এর মত হচ্ছে স্ত্রীর ইদ্দতের মধ্যে স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রী মিরাস পাবে না। (আল ফিকরুস সামি, ২/৩২৮)
গ. তালাকপ্রাপ্তার ইদ্দত কখন শেষ হবে?
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর মতে, তৃতীয় হায়েযের পর যখন গোসল করবে তখন ইদ্দত সমাপ্ত হবে।
অপরদিকে যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) এর মতে, তৃতীয় হায়েয শেষ হতেই তার ইদ্দত সমাপ্ত হয়ে যাবে (প্রাগুক্ত)
উপর্যুক্ত উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবাদের নিকট মাস’আলায় মতভেদ অবৈধ হলে কিছুতেই তাদের দ্বারা তা ঘটতো না। বস্তুতঃ তাদের মতভেদ পরবর্তী ফুক্বাহায়ে কিরামের জন্য একটা আশ্বাসবাণী, যাতে নিয়মতান্ত্রিক চিন্তা-গবেষণার জন্য ইজতিহাদের পথে চলতে গিয়ে কখনো মতবিরোধের সম্মুখীন হলেও তারা যেন বিচলিত না হন।
মোটকথা, মাযহাবের ইখতিলাফ হচ্ছে উম্মতের জন্য এক বিরাট নিয়ামত ও অনুগ্রহ।
কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার মাধ্যমে শরীয়তের যেসকল মূলনীতি ও বিধান নির্ধারিত হয়েছে সেগুলো সকল নবীর অভিন্ন ‘দ্বীন’ সমতুল্য। তা লঙ্ঘনের অধিকার কারো নেই। এগুলো যে গ্রহণ করবে সে নির্ভেজাল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হবে। এরাই হলেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত। পক্ষান্তরে শরীয়তের খুঁটিনাটি বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের মতপার্থক্য গুলো হচ্ছে, বিভিন্ন নবীর নিজস্ব ‘বচন ও কর্ম’ সমতুল্য যা শরীয়তভুক্ত রূপে স্বীকৃত। আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেন, ‘যারা আমাকে পাওয়ার সাধনা করবে আমি তাদের অনেক পথের দিশা দিব।’
মতপার্থক্যের মৌলিক কারণসমূহঃ
১. পবিত্র কুরআনের সাথে সম্পর্কিত কারণঃ
কিরাতের বিভিন্নতা:
পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ভিন্ন ভিন্ন অর্থে একাধিক কিরাতে (তেলাওয়াত পদ্ধতি) বর্ণিত হয়েছে, যার কোন একটি অর্থকে নির্দিষ্ট করতে গিয়ে অথবা উভয় অর্থের মাঝে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গিয়ে ইমামদের মাঝে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।
২. রাসুল (সা.) এর হাদিস সংক্রান্ত কারণসমূহঃ
ক.কোন হাদিস ইমামের সংগ্রহের না থাকা:
রাসুল (সা.) সকল আহকাম একই সময় এবং সকল সাহাবীর সম্মুখে বর্ণনা করেননি, বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাবেশে বিভিন্ন আহ্কাম শিক্ষা দিয়েছেন। কাজেই সব সাহাবীর পক্ষে সব হাদিস সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী যুগে ইমামদের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটে।
কাজেই কোন মাস’আলা সমাধানে যিনি সহিহ হাদিস সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনি সে অনুযায়ী মাস’আলা পেশ করেছেন। অপরপক্ষে যিনি সহিহ হাদিস সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি তিনি বাধ্য হয়ে ইজমা ও কিয়াসের শরণাপন্ন হয়েছেন। ফলে অনেক সময় মতে ভিন্নতা এসেছে।
খ.কোন হাদিস আমলের যোগ্য বলে প্রমাণিত না হওয়াঃ
এ ব্যাপারে হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে হানাফী ফিক্বহের কয়েকটি নীতি উল্লেখ করছি:
১. আহকামে শরীয়াহ এর উৎস অনুসন্ধানের পর যেসব দলিল ইমামের মতে নির্ভরযোগ্য ছিল, খবরে ওয়াহিদ অবশ্যই তার সাংঘর্ষিক হতে পারবে না।
২. কোন খবরে ওয়াহিদ অনুরূপ খবর ওয়াহিদের বিপরীত হওয়া চলবে না। বিপরীত হলে তিনি নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী একটিকে প্রাধান্য দিতেন, অপরটি পরিত্যাগ করতেন।
৩. হাদীসের রাবীর আমল তার বর্ণিত হাদীসের বিপরীত হওয়া চলবে না।
৪. হাদীসের সনদ কিংবা মতনে কোনরূপ পরিবর্তন থাকা চলবে না।
৫. খবরে ওয়াহিদ এর রাবি শুধুমাত্র স্বীয় লিখনীর উপরে নির্ভর করবেন না বরং তাকে অবশ্যই স্মৃতিতে হাদিস রাখতে হবে। স্মৃতিতে না থাকলে আবু হানিফা র. সেই হাদীস গ্রহণ করতেন না।
গ.দুর্বল হাদীসের উপর আমল সংক্রান্ত মতপার্থক্যঃ
আহকাম বা বিধিবিধান বের করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ফকীহ ও মুহাদ্দিস দুর্বল হাদীস গ্রহণ না করলেও, কোন কোন ফকীহ ও মুহাদ্দিস বিশেষ শর্তসাপেক্ষে ফাযায়েল সংক্রান্ত দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন। ফলে তাদের ইজতিহাদে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
৩. কুরআন ও সুন্নাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব বিষয়ের কারণে মতপার্থক্য হয়েছেঃ
ক. কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন শব্দের সঠিক অর্থ নির্ণয় করতে গিয়ে মতপার্থক্য
খ. কুরআন ও সুন্নাহতে ব্যবহৃত অব্যয়ের অর্থ সম্পর্কে মতভেদ
গ. কুরআন ও হাদিসের মধ্যে পার্থক্য
ঘ. শব্দের অর্থ স্পষ্ট হওয়া সত্বেও বাক্যের বিন্যাসের কারণে অর্থের মধ্যে অস্পষ্টতা
ঙ. শব্দের প্রকৃত ও রূপক অর্থ ভিত্তিক মতভেদ
চ. আম ও খাস (সাধারণ ও বিশেষ) শব্দের ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরামের গৃহীত নীতির কারণে মতপার্থক্য
ছ. একাধিক অর্থবোধক শব্দের ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরামের নীতির কারণে মতপার্থক্য
জ. মুতলাক (নিঃশর্ত) এবং মুকায়্যাদ (শর্তযুক্ত) দলিলের ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরামের গৃহীত নীতির কারণে মতপার্থক্য।
০৪. কেউ বুদ্ধি-বিবেক ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মত দিয়েছেন, আবার কেউ ব্যক্তিগত মতামত দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন। ফলে ইজতিহাদে ভিন্নতা এসেছে।
০৫. কিয়াস: বিশেষজ্ঞগণ কিয়াস প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে সকল পন্থা অবলম্বন করেছেন সম্ভবত সেগুলোই তাদের মতপার্থক্যের সর্ব প্রধান উৎস ছিল। কেউ কিয়াস ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত আরোপ সীমিত কিয়াস প্রয়োগ করেছেন, আবার কেউ ব্যাপকহারে কিয়াস নীতি প্রয়োগ করেছেন।
কেন একটি মাযহাবই মানতে হবে?
একটি মাযহাবকে আবশ্যক বলা হয় এজন্য যে, একাধিক মাযহাব অনুসরণের অনুমোদন থাকলে সবাই নিজের রিপু পূজারী হয়ে যেত। যখন যে বিধান যখন ইচ্ছে পালন করতো, যে বিধান যখন ইচ্ছে ছেড়ে দিতো। এর মাধ্যমে মূলত দ্বীন পালন হতোনা, বরং নিজের প্রবৃত্তির পূজা হত। তাই ৪র্থ শতাব্দীর উলামায়ে কিরাম একটি মাযহাবের অনুসরণকে বাধ্যতামূলক বলে এই প্রবৃত্তি পূজার পথকে বন্ধ করে দিয়েছেন, যা সেই কালের ওলামায়ে কিরামের সর্বসম্মত সীদ্ধান্ত ছিল। আর একবার উম্মতের মাঝে ইজমা হয়ে গেলে তা পরবর্তীদের মানা আবশ্যক হয়ে যায়।
বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিসগন কি মাযহাব অনুসরণ করতেন?
০১। ইমাম বুখারী র. নিজেই মুজতাহিদ ছিলেন। তথাপি তিনি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী বলে সূত্রে পাওয়া যায়।
(সুত্রঃ নবাব ছিদ্দিক হাসান খান লিখিত আবজাদুল উলুম পৃষ্ঠা নং ৮১০, আলহিত্তা পৃষ্ঠা নং ২৮৩
শাহ ওয়ালিউল্লাহ র. লিখিত আল-ইনসাফ পৃষ্ঠা নং ৬৭
আল্লামা তাজ উদ্দীন সুবকী রহঃ লিখিত ত্ববকাতুশ শাফেয়ী পৃষ্ঠা নং ২/২)
০২। ইমাম মুসলিম র. শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী।
(সুত্রঃ ছিদ্দিক হাঃ খান লিখিত আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২২৮)
০৩। ইমাম তিরমিজী র. নিজে মুজ্তাহিদ ছিলেন। তবে হানাফী ও হাম্বলী মাজহাবের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন।
(সুত্রঃ শা ওয়ালিউল্লাহ রহঃ লিখিত আল-ইনসাফ পৃষ্ঠা নং ৭৯)
০৪। ইমাম নাসাঈ র. শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।
(সুত্রঃ নঃ ছিঃ হাঃ লিখিত আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২৯৩)
০৫। ইমাম আবু দাউদ র. শাফেয়ী।
(সুত্রঃ আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২২৮।
০৬। ইমাম ইবনে মাজাহ র. শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী।
(সুত্রঃ ফয়জুল বারী ১/৫৮)
এ গেল ছিহাহ ছিত্তার ইমামগণের মাযহাব।
অন্যান্য ইমামগণের মাযহাবঃ
০৭। মিশকাত শরিফ প্রণেতা শাফেয়ী, পৃঃ১৩৫
০৮। ইমাম খাত্তাবী র. শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৫
০৯। ইমাম নববী র. শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৫
১০। বড় পীর আঃ কাদের জিলানী রহঃ হাম্বলী, পৃঃ ৩০০
১৩। শাহ ওয়ালিউল্লাহ র. হানাফী, পৃঃ ১৬০-১৬৩
১৪। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী, পৃঃ২১৯