নারীদের ইতিকাফ
সিরাজুম মুনিরা
জগতের যাবতীয় আকর্ষণ-বিকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে, সকল মোহ–মায়া ত্যাগ করে, বাধা-বন্ধন উপেক্ষা করে একান্তভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সন্নিধানে যাওয়ার নামই ইতিকাফ। ইতিকাফ পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ আমল। এটি রমজান মাসের সামগ্রিক কল্যাণ ও বরকত লাভের জন্য অপূর্ব বলিষ্ঠ সহায়ক শক্তি।
‘ইতিকাফ’ অর্থ অবস্থান করা, আবদ্ধ করা, আবদ্ধ হওয়া বা আবদ্ধ রাখা।
পরিভাষায় ইতিকাফ হলো ইবাদতের উদ্দেশ্যে ইতিকাফের নিয়তে নিজেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবদ্ধ রাখা। যিনি ইতিকাফ করেন, তাকে ‘মু’তাকিফ’ বলে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।” (সুরা বাকারা, ১২৫)
রমজানের শেষ দশক তথা ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়া বা ৩০ রমাদান পূর্ণ হয়ে ওই দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ কিফায়াহ। কোনো মসজিদে মহল্লার কয়েকজন বা কোনো একজন আদায় করলে সবাই দায়মুক্ত হবে। আর কেউই আদায় না করলে সবাই সুন্নাত তরকের দায়ে দায়ী থাকবে। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে যিনি বা যাঁরা আদায় করবেন, শুধু তিনি বা তাঁরাই সওয়াবের অধিকারী হবেন।
ইতিকাফ শুধু পুরুষের জন্য নয়। নারীরাও কিন্তু ইতিকাফ করতে পারেন। প্রিয় নবী ﷺ এর সহধর্মিণীরা ইতিকাফ করতেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা رضي الله عنها থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম ﷺ ওফাত পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ করতেন। এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁর বিবিগণ ইতিকাফ করেছেন।
(সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
১। মাসআলা:
রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ পুরুষের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া, তবে নারীদের জন্য তা মুস্তাহাব।
মহিলাদের নামাজের স্থান তাদের ঘরের অন্দরমহল, মসজিদ নয়। কিন্তু মহিলারা সওয়াবের ক্ষেত্রে ঘরে নামাজ পড়ে ও ঘরে ইতিকাফ করে পুরুষদের মসজিদে নামাজ পড়ার সমপরিমাণ সওয়াবের অধিকারী বলে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এই অর্থে মহিলাদের ঘরকে মসজিদের সাদৃশ্য আখ্যা দেয়া হয়েছে। যেন মহিলারা বেশি সওয়াব হাসিল করার আশায় মসজিদে আসার জন্য উদগ্রিব না হয়। মসজিদে গিয়ে শেষ ১০ দিন ইতিকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদার হুকুম পুরুষদের জন্য, মহিলাদের জন্য নয়। সুতরাং মহিলারা চায় ঘরে ইতিকাফ করুক, চায় মসজিদে, পুরুষদের দায়িত্ব আদায় হবে না। তবে পুরুষদের মধ্যে একজনও যদি মসজিদে ইতিকাফ করে তাহলে গ্রামবাসীর পক্ষ হতে তা আদায় হয়ে সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবে।
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০৩৩, উমদাতুল ক্বারী: ১১/১৪৮, বাদায়েউস সানায়ে: ২/১১৩, ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: ১৩/১৪৫)
৩। মাসআলা:
মহিলারা ঘরে নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করবেন। যদি আগে থেকেই ঘরে নামাজের জন্য কোনো স্থান নির্ধারিত না থাকে তাহলে ইতিকাফের জন্য একটি স্থান নির্ধারিত করে নেবেন। সেখানেই ইতিকাফ করবেন।
(হেদায়া: ১/২৩০, আলমগীরি: ১/২১১)
বিবাহিত নারীকে রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ বা অন্য সময়ের নফল ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতিকাফ করা অনুচিত। স্বামীর উচিত, যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া স্ত্রীদের ইতিকাফে বাধা না দেওয়া। তাদের ইতিকাফের সুযোগ দেওয়া। এতে কিন্তু উভয়ই সওয়াব পাবেন।
(ফতোয়ায়ে শামী: ৩/৪২৯, আলমগীরি: ১/২১১)
৫। মাসআলা:
স্বামী-স্ত্রীকে ইতিকাফের অনুমতি দেওয়ার পর আর বাধা দিতে পারবেন না। বাধা দিলেও সে বাধা মানা স্ত্রীর জন্য জরুরি নয়।
(ফতোয়ায়ে শামী: ৩/৪২৮, আলমগীরি: ১/২১১)
ইতিকাফ অবস্থায় (রাতেও) স্বামী-স্ত্রী মেলামেশা করা যাবে না। করলে ইতিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে।
(সূরা বাকারা: ১৮৭, বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৮৫, শামী: ৩/৪৪২)
৭। মাসআলা:
মহিলাদের ইতিকাফের জন্য হায়েজ-নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া শর্ত। হায়েজ, নেফাস অবস্থায় ইতিকাফ সহিহ হয় না।
(বাদায়ে: ২/২৭৪, আলমগীরি: ১/২১১)
মহিলাদের ইতিকাফে বসার আগেই হায়েজ-নেফাসের দিন-তারিখ হিসাব করে বসা উচিত। যাতে ইতিকাফ শুরু করার পর পিরিয়ড শুরু হয়ে না যায়। তবে কারোর রমজানের শেষ দশকে পিরিয়ড হওয়ার নিয়ম থাকলে তিনি পিরিয়ড শুরু হওয়া পর্যন্ত নফল ইতিকাফ করতেই পারেন।
৯। মাসআলা:
ইতিকাফ শুরু করার পর পিরিয়ড শুরু হয়ে গেলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। পরে শুধু একদিনের ইতিকাফ রোজাসহ কাজা করতে হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৫০২)
মহিলারা ঘরের যে স্থানটিকে ইতিকাফের জন্য নির্ধারিত করবেন তা মসজিদের মতো গণ্য হবে। মানবিক প্রয়োজন ছাড়া তারা সেখান থেকে বের হতে পারবেন না। মানবিক প্রয়োজন ছাড়া সে স্থানের বাইরে গেলে ইতিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে। (আলমগীরি: ১/২১১, বাদায়ে: ২/২৮২)
অর্থাৎ, ইতিকাফ অবস্থায় মহিলারা মানবিক প্রয়োজনের জন্য ইতিকাফের স্থান থেকে বের হতে পারবেন।
যেমনঃ অজুর জন্য বাইরে যেতে পারবেন।
রমজানের শেষ দশকে শবে কদরের খোঁজে প্রিয় নবী ﷺ ইতিকাফ করতেন।
সুতরাং এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেও উচিত নয়। নারীদের মধ্যে ইতিকাফের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা উচিত। পুরুষদের উচিত নারীদের ইতিকাফের জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং সুযোগ তৈরি করে দেয়া। তাহলে পুরুষরাও সওয়াব পাবেন। নারীদের মধ্যে ইতিকাফের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা উচিত। পুরুষের উচিত নারীকে ইতিকাফের জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। তাহলে পুরুষও সওয়াব পাবেন।