ধর্ম

পবিত্র মক্কা শরীফের বরকতময় স্থানসমূহের বিবরণ

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

পবিত্র আল কুরআনের আলোকে বরকতময় স্থানে দুআ কবুল হয়: 

বরকতময় স্থান সমূহে দুআ কবুল হওয়া কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমানিত, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যে আল্লাহর নিদর্শন সমূহকে সম্মান করে এটা তো তার হৃদয়ের তাকাওয়ারই বহি:প্রকাশ। (সূরা: হাজ্ব, পারা: ১৭, আয়াত: ৩২)

বর্ণিত আয়াতে মসজিদে হারাম মক্কা মুয়াজ্জমাহ, হজ্ব উমরা ও ক্বাবা সংশ্লিষ্ট স্থান ও বস্তুর প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে খোদাভীতির পরিচায়ক হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। (তাফসীরে কুরতুবী)

 

কুরবানীর পশুকে আল্লাহর নিদর্শন বলা হয়েছে, কুরবানীর পশুর প্রতি সম্মান বলতে তার প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া, পশুর কোন প্রকার ক্ষতি না করা, তাকে শরয়ী নিয়ম অনুসরন করে জবেহ করা ইত্যাদি তার প্রতি সম্মান। এভাবে নবী রাসূলগণের স্মৃতি বিজড়িত বরকতময় স্থান সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এ সবস্থানে দুআ করা এটা বান্দার জন্য সৌভাগ্য ও দুআ কবুলের ওসীলা। শরয়ীভাবে যে সব কর্ম, আমল মুসলমান হওয়ার পরিচয় বহন করে তা শা’আয়েরে ইসলাম হিসেবে গন্য। (তাফসীর ইবনে কাসীর)

 

বরকতময় স্থানে দু’আর গুরুত্ব:

বরকতময় স্থান সমূহে দুআ বিশেষ উপকারী ও ফলপ্রসূ। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “আল্লাহর কাছে দুআর চেয়ে উত্তম আর কোনো বস্তু নাই।” (তিরমিযী, হাদীস নং: ৩৩৮১)

 

আরো এরশাদ হয়েছে, দুয়া হচ্ছে মুসলমানদের হাতিয়ার এবং দ্বীনের খুটি। (আল মুসতাদরাক, হাদীস: ১৮৫৫)

 

ইসলামী ঐতিহ্য ও স্থাপনা সমূহ পরিদর্শন করলে ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন হয়, নবী রাসূলগনের স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শনাদি যিয়ারতের মাধ্যমে অন্তরে ঈমানী চেতনা বৃদ্ধি পায়। বরকতমন্ডিত স্থান সমূহে দুআ করলে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন হয়।

 

মক্কা শরীফে দর্শনীয় স্থান সমূহ:

 

মক্কা নগরীতে রয়েছে অসংখ্য আল্লাহর কুদরতী নিদর্শন তথা দর্শনীয় স্থান। খানায়ে ক্বাবা তথা বায়তুল্লাহ শরীফ পবিত্র মক্কায়ে মু’আযযমার প্রধান আকর্ষণ। তাছাড়া আরো রয়েছে প্রিয় রসুলের শুভাগমনের স্মৃতি বিজড়িত শুভ জন্মগৃহ মাওলূদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, উম্মে হানীর ঘর (বর্তমানে হেরম শরীফের অভ্যন্তরে) মসজিদে হেরমের যে স্থান থেকে প্রিয় রসূলের মি’রাজ গমন হয়েছিল। জবলে আবী কুবাইস, মসজিদে বেলাল, মকামে শক্কুল কমর (চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার স্থান), দ্বারে আরকাম যা সাফা পর্বতের সাথে সংযুক্ত ‘মহল্লা বনী হাশিম’ রসূলুল্লাহর শুভ জন্মগৃহ নিকটবর্তী এলাকা, হযরত সৈয়্যিদুনা আবূ বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লাহু আনহু’র বাসস্থান (বর্তমানে এ স্থানে মক্কা টাওয়ার নামে অত্যাধুনিক শপিং সেন্টার নির্মিত হয়েছে, হযরত খদীজাতুল কুবরা রদিয়াল্লাহু আনহা’র বাসস্থান, ‘জান্নাতুল মু‘আল্লা’, মক্কাতুল মুকাররমার প্রধান কবরস্থান, মসজিদে জ্বীন, জবলে সওর, গারে সওর, গারে হেরা, মসজিদে আয়েশা, মসজিদে ফাতেহ, মসজিদে শাজরা, মসজিদে জিরানা, হযরত মা আমেনা রদিয়াল্লাহু আনহা’র মাযার শরীফ-যা মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ আসার পথে বদরের পূর্বে মস্তুরা নামক একটি জায়গায় সামান্য ডানদিকে আবওয়া শরীফ নামক স্থানে তিনি শায়িত আছেন। হযরত মায়মূনা রদিয়াল্লাহু আনহা’র মাযার শরীফ মদীনা রোড হয়ে মসজিদে আয়েশা যাত্রা পথে নূরিয়া স্টাফ কোয়ার্টার নিকটস্থ। মিনা, মসজিদে খায়ফ, তিন জমারাত, মুযদালিফা, ময়দানে আরাফাত, মসজিদে নিমরা, জবলে রহমত ইত্যাদি পবিত্র স্থানসমূহ কোরআন-সুন্নাহর আলোকে বরকতময় স্থান হিসেবে অন্তর্ভূক্ত।

মক্কা শরীফে দু’আ কবূলের স্থানসমূহ:

১. মা’তাফ তথা তাওয়াফের জায়গা,

 

২. মুলতাযাম তথা কাবা ঘরের দরজা ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থান ,

 

৩. মীযাবে রহমতের নীচে (হাতীমের মধ্যে),

 

৪. বায়তুল্লাহ্‌ শরীফের ভিতরে,

 

৫. যমযম কূপের কাছে,

 

৬. মকামে ইবরাহীমের পেছনে,

 

৭. সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের উপরে,

 

৮. উপরোক্ত পাহাড়দ্বয়ের মাঝামাঝি দৌড়ানোর জায়গা,

 

৯. কা’বা শরীফের উপর যখন দৃষ্টি পড়ে,

 

১০. হাতীমের মধ্যে,

 

১১. রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে, ১২. মুলতাযাম, রুকনে ইয়ামানী সংলগ্ন পশ্চিম দেয়াল অর্থাৎ দরজা সোজা এলাকা পর্যন্ত স্থান,

 

১৩. মিনার মসজিদসমূহে ও ময়দানে,

 

১৪. আরাফাতের ময়দানে,

 

১৫. জাবালে রহমতে,

 

১৬. মুযদালিফার ময়দানে,

 

১৭. কঙ্কর মারার স্থানে,

 

১৮. জাবালে নূর বা হেরা পর্বতের গুহায় যেখানে সর্বপ্রথম কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল,

 

১৯. জাবলে সাওর বা সাওর পর্বতের গুহায়, যেখানে হিজরতের সময় আবূ বকর সিদ্দিক রদিয়াল্লাহু আনহুসহ রসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন দিন অবস্থান করেছিলেন,

 

২০. মাওলূদিন নবী তথা মহানবীর জন্মস্থান,

 

২১, দারে আরকাম যেখানে হযরত উমর রদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

 

মওলুদুন্নবী তথা নবীজির শুভ জন্মস্থান:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধরাধামে শুভাগমনের স্মৃতি বিজড়িত শুভজন্মস্থানটি ইতিহাসে মওলুদুন্নবী হিসেবে পরিচিত। হেরম শরীফের সন্নিকটে সাফা পর্বত ও জবলে আবি কুবাইসের কাছেই এটি অবস্থিত। নবীজির নুরানী শুভগৃহের তাদের এহেন অবহেলা উদসীনতা প্রতিটি মুমিন নর-নারীকে ব্যাথিত করে। তারা এটাকে মওলুদুন্নবী বা রাসূলুল্লাহর শুভ জন্মগৃহ হিসেবে স্বীকারই করতে চায়না। অপপ্রচারের মাধ্যমে তারা এ নুরানী ঘরের বরকত থেকে মুসলিম মিল্লাতকে বিরত রাখতে চায়। অথচ এ স্থানটি সম্পর্কে উপমহাদেশের হাদীস প্রচারক হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (র.) বর্ণনা করেন, আমি প্রাথমিক অবস্থায় মক্কামুয়াজ্জমায় অবস্থান কালে “মিলাদুন্নবী” দিবসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের নুরানী স্থানে উপস্থিত ছিলাম। লেকেরা নবীজির উপর দরুদ-শরীফ পড়তেছিল, এবং নবীজির শুভাগমনের শুভ মূহুর্তে সংগঠিত অলৌকিক ঘটনাবলী আলোচনা করছিলেন, বিশেষত: জন্মদিবসে সংগঠিত মু’যিজা সমূহ। আমি সেদিন অসাধারণ নুরের ঝলক দেখতে পেলাম। আল্লাহ ভাল জানেন, আমি বলতে পারবনা, তা-কি চর্ম চোখে দেখা নূর না রুহানী চোখে দেখা নূর দর্শন করেছি, ঐ নূরের দিকে দৃষ্টি করতেই অনুভব করলাম সেটা ফেরেস্তার নূর, আরো দেখতে পেলাম সেখানে ফেরেস্তার নূর রহমতের নূরের সাথে একাকার হয়েছে। (মা-সাবাতা বিসসুন্নাহ, পৃ: ১০২, ফুয়ুজুল হারামাঈন, পৃ: ৮০)

 

মক্কা শরীফের কয়েকটি বরকতময় স্থান:

 

জবলে আবূ কুবাইস: বায়তুল্লাহ শরীফের একেবারে সামনে সাফা পর্বতের নিকটেই এ পর্বত অবস্থিত, বর্তমানে এ ঐতিহাসিক পর্বত নিশ্চিহ্ন করে এরই উপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিলাসী শায়খদের আরাম-আয়েশের জন্য অত্যাধুনিক মনোরম বিলাসবহুল প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে। এই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চন্দ্র দ্বি-খন্ডিত করেছিলেন। হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসঊদ রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,-‘আমি এই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে ফাটা চন্দ্র দেখেছি।’ (শিফা শরীফ, ১ম খণ্ড, ২৭৬ পৃ.)

এক বর্ণনা মতে হযরত আদম আলাইহিস সালাম এই পর্বতেই সমাধিস্থ হন। আজ ইসলামের ইতিহাসের এই ঐতিহাসিক স্মৃতিকে দু:খজনকভাবে শহীদ করা হয়েছে।

 

সওর পর্বতের গুহা:

 

হিজরতের রাতে এ পবিত্র গুহায় প্রিয় নবী রহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রাণপ্রিয় সাহাবী ইসলামী জগতের প্রথম খলীফা আমীরুল মুমিনীন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লাহু আনহুকে সাথে নিয়ে তিনদিন তিন রাত অবস্থান করেছিলেন। এ গুহায় নবীজি তাঁর সাহাবীকে নিয়ে অবস্থান সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় পুত্রকে বলেছিলেন, যদি কখনো বিপদের সম্মুখীন হয়ে থাক তখন ঐ পর্বতেই চলে যাবে যেখানে আমি গোপন ছিলাম, সকাল-সন্ধ্যায় তুমি রিয্‌ক্বপ্রাপ্ত হবে। এই পর্বত স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের দিকে এ বলে আহ্বান করেছিলেন- “ইয়া রসূলাল্লাহ্‌! আমার দিকে আসুন আমি আপনার পূর্বে আরো সত্তরজন নবীকে আহ্বান করেছি ও আমার মধ্যে আশ্রয় দিয়েছি।” (তারীখে মক্কা, ২১৪ পৃষ্ঠা)

জবলে হেরা:

এ পবিত্র পাহাড়ে হেরা গুহা রয়েছে। এ গুহাতেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। আল কোরআনের সর্বপ্রথম আয়াত ‘ইক্বরা, বিসমি রব্বিকাল লাযী খলাক্ব’ এখানেই নাযিল হয়েছে। এই পবিত্র পাহাড় মক্কা মুকাররমা থেকে পূর্ব দিকে তিন মাইল দূরত্বে অবস্থিত। এ পর্বতকে জবলে নূর নামেও অভিহিত করা হয়। এটা সেই বরকতময় পাহাড় যেখানে প্রিয়নবীর দিদার লাভেধন্য হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম অসংখ্যবার আগমন করেছিলেন। এই নূরানী গুহায় প্রিয়নবী দীর্ঘ একমাস ইবাদতে নিয়োজিত ছিলেন। হযরত আবূ হুরায়রা রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সায়্যিদুনা আবু বকর ছিদ্দীক, উমর ফারূকে আযম, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত তালহা, হযরত যোবায়ের রদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ একদা হেরা পাহাড়ের একটি টিলার উপর উপবিষ্ট হলে ঠিলা নড়াচড়া শুরু করল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, থামো! তোমার উপর একজন নবী, একজন ছিদ্দীক এবং শহীদগণ রয়েছেন। সাথে সাথে পর্বত থেমে গেল। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ২৪১৭, মুসনাদে আহমদ, ২য় খন্ড, ৪১৯ পৃ:),

 

হে আল্লাহ আমাদেরকে বায়তুল্লাহ শরীফ ও রওজা শরীফের যিয়ারত নসীব করুন। আমীন।

 

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।