সূরা নাসর’র তাৎপর্য ও শিক্ষা | জুমার খুতবা
মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
জুমার খুতবা
১৬ সফর|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|২৪ সেপ্টেম্বর’২১
“সূরা নাসর’র তাৎপর্য ও শিক্ষা”
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! তাঁরই পবিত্রতা বর্ণনা করুন। তাঁর গুণগান ও প্রশংসা করুন। জেনে রাখুন, একমাত্র আল্লাহই বিজয় ও সাহায্যদানকারী। দ্বীনের পথে বিজয় ও সাফল্য অর্জনে মহান প্রভূর সাহায্য কামনা করুন।
নসর শব্দটি আরবি এর অর্থ সাহায্য, বহুবচন আনসার। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১১০ তম সূরার নাম সূরা নাসর। এতে আয়াত সংখ্যা ০৩, পদ ১৭, বর্ণ ৭৭, রুকু সংখ্যা:১, পরা ক্রম: ৩০, তাফসীরকারদের সর্বসম্মত মতানুসারে সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ। সূরাটি হাজ্জাতুল বিদা তথা বিদায় হজ্বের সময় মিনায় নাযিল হয়েছে। এ সূরার অপর নাম সূরা তাওদী বা “সূরা বিদা” কেননা এ সূরায় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ইহকাল ত্যাগ করা তথা ওফাত শরীফের ইঙ্গিত করা হয়েছে। (তাফসীরে আযীযী ও তাফসীরে নূরুল ইরফান) এ সূরা নাযিলের দুবৎসর পর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহকাল ত্যাগ করেন। [তাফসীরে খাযিন, মাদারিক ও তাফসীরে নুরুল ইরফান]
এ সূরার আরেক নাম সূরা ফাত্হ এ সূরায় ফাত্হ শব্দের উল্লেখ রয়েছে ফাত্হ অর্থ বিজয়, সূরাটি মক্কা বিজয়ের পূর্বে নাযিল হয়েছে। এতে মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ রয়েছে। [তাফসীরে আযীযী, তাফসীরে নুরুল ইরফান] হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এ সূরা নাযিলের পর “আল ইয়াউমা আক্মালতু লাকুম দ্বী-নাকুম”… আয়াত অবতীর্ণ হয়। এটি নাযিলের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশি দিন পৃথিবীতে ছিলেন। [তাফসীর খাযাইনুল ইরফান]
১. যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে।
২. এবং আপনি লোকদেরকে দেখবেন যে আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করছে।
সালাতুশ শুকর আদায়:
তাফসীরে রুহুল বয়ান’র ব্যাখ্যা গ্রন্থ তাফসীরে ‘ফুয়ুজুর রহমান’ কৃত আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়াইসি (র.) ৩০ তম খন্ডে বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের শোকরানা হিসেবে নবীজি ক্বাবা শরীফের দরজা খুলে চার রাকাত নফল নামায আদায় করেছেন। [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, খন্ড:৩০, পৃ: ১০৯২]
হযরত মুকাতিল (র.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের মজলিশে সূরা নসর তিলাওয়াত করলে সবাই আনন্দিত হলেন, যেহেতু এ সূরায় মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ রয়েছে, সুরাটির তিলাওয়াত শুনে হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ক্রন্দন শুরু করলেন, নবীজি তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি আরজ করলেন আপনি তো এ সূরার মাধ্যমে আপনার ওফাতের বার্তা জানান দিয়েছেন। (আপনার বিচ্ছেদের বিরহ যন্ত্রণার কথা ভেবে ক্রন্দন করছি।) [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, খন্ড: ৩০, পৃ: ১০৯৪]
হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা:
সৈয়্যদানা মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেছেন, এ সূরা অবতীর্ণ হবার পর নবীজি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, এক দিন হুজুরা শরীফ থেকে বাইরে তাশরীফ আনলেন সাহাবাদের উদ্দ্যেশে বিদায় ভাষণ দিলেন, পূনরায় ঘরে ফিরে গেলেন, কিছু দিন পর নবীজি ওফাত বরণ করলেন। [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, খন্ড:৩০, পৃ: ১০৯৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আদরের কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) কে ডেকে নিজের ওফাতের সংবাদ দিলেন, হযরত ফাতেমা (রা.) শুনা মাত্রই ক্রন্দন করতে লাগলেন, নবীজি তাঁকে বললেন, ওহে কন্যা ফাতেমা! ক্রন্দন করোনা, আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সাথে সাক্ষাত করবে। এ সুসংবাদ শুনে হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হাসলেন। [তাফসীর ফুয়ুজুর রহমান, পৃ: ১০৯৪]
অধিক পরিমাণ তাসবীহ ও ইস্তিগফার:
উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, সূরা নসর নাযিল হবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক পরিমানে পড়তেন “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী আসতাগফিরুল্লাহ ওয়া আতু-বু ইলায়হি। অর্থ:-পবিত্রতা আল্লাহর এবং তাঁর প্রশংসা সহকারে ইস্তিগফার করছি, আল্লাহর মহান দরবারে এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। [তাফসীরে নুরুল ইরফান]
নবীগণ নিস্পাপ পুতঃপবিত্র:
আল্লাহ নবীগণ ওহী প্রাপ্তির আগে ও পরে সকল প্রকার কুফরী থেকে পুত:পবিত্র। [তাফসীরে আহমদিয়া, পৃ: ২১২ কৃত: আল্লামা মোল্লা জিওন (র.)]
নবীগণ নিস্পাপ হওয়া সত্বেও নিয়মিত অধিক পরিমানে তাওবাহ ইস্তিগফার তথা আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, উম্মতকে শিক্ষার দেয়ার জন্য, অথবা নিজের গুনাহগার উম্মতের জন্যই ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। [‘তাফসীর নূরুল ইরফান’ কৃত: হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.)]
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহর দরবারে দৈনিক সত্তরবারের অধিক ইস্তিগফার ও তাওবা করি। [বুখারী শরীফ, খন্ড:২য়, পৃ: ৯৯৩, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ৩য়, পৃ: ২৫০]
আল্লাহর দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে:
হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, সূরা নসর অবতীর্ণ হওয়ার পর যখন পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াত “আল ইয়াউমা আকমালতু লাকুম দ্বী নাকুম” অর্থ:-আজকের দিনে আমি আপনার জন্য দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম, যখন অবতীর্ণ হলো সাহাবায়ে কেরাম বুঝতে পেয়েছিলেন নবীজি পৃথিবীতে আর বেশীদিন অবস্থান করবেন না, দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এ সূরা অবতীর্ণ হবার পর রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন, ‘একজন বান্দাকে আল্লাহ এখতিয়ার দিয়েছেন তিনি ইচ্ছে হলে পৃথিবীতে থাকুক অথবা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করুক’ ঐ বান্দা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। এটা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার জন্য আমাদের জীবন, ধন সম্পদ, পিতা মাতা এবং সন্তান-সন্ততি সবই উৎসর্গ করলাম। [তাফসীর খাযাইনুল ইরফান, কৃত: সদরুল আফাযিল আল্লামা সৈয়দ নঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী (র.)]
হযরত কাশফি (র.) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন প্রতিনিধিদল যথাক্রমে বনী আসাদ, বনু মুররা বনী কালব, বনু কিনানাহ, বনী হিলাল, বনী তাসীম এর লোকেরা দলে দলে নবীজির সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলো।
হযরত আবু আমর ইবনে আবদুলবর বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওফাতের সময় সমগ্র আরবের একজন লোকও কাফির ছিলো না। সমগ্র আরবের অধিবাসীগণ ইসলাম গ্রহণ করলো। [ তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, খন্ড: ৩০, পৃ: ১০৬০]
অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।