সুন্নি ইসলামে হজ্জের গুরুত্ব: একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড
হজ্জ কি এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
হজ্জ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। এটি প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জন্য ফরজ, যারা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান। হজ্জ শুধুমাত্র একটি ইবাদত নয়, এটি আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং মুসলিম উম্মাহর একতাবদ্ধ হওয়ার একটি অনন্য সুযোগ।
আল-কুরআনে বলা হয়েছে:
“এবং মানুষের উপর আল্লাহর প্রাপ্য এই যে, যারা সামর্থ্য রাখে তারা যেন এই গৃহের (কাবা) হজ্জ করে। আর কেউ অস্বীকার করলে (জেনে রাখবে) নিশ্চয়ই আল্লাহ সারা জগতের দরিদ্র নন।” (সূরা আলে ইমরান: ৯৭)
হজ্জের ইতিহাস
হজ্জের উৎপত্তি
হজ্জের সূচনা মহানবী ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাইল (আ.) এর সময় থেকে। আল্লাহ তাদের কাবা নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং মানুষকে হজ্জ পালনের জন্য আহ্বান করতে বলেন।
“এবং মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দিয়ে দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং বিভিন্ন দূরবর্তী পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে চড়ে।” (সূরা আল-হজ্জ: ২৭)
হজ্জের ধর্মীয় তাৎপর্য
হজ্জ মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা পাপমোচন, আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্জ পালন করে এবং কোন প্রকার গুনাহ বা অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে, সে নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।” (সহিহ বুখারি: ১৫২১)
হজ্জের নিয়মাবলী
ইহরামের পদ্ধতি
হজ্জ শুরুর আগে নির্দিষ্ট স্থানে (মীকাত) পৌঁছে ইহরাম ধারণ করতে হয়। ইহরাম হল বিশেষ পোশাক যা আত্মিক পবিত্রতার প্রতীক। ইহরামের শর্ত:
- নিয়ত করা
- তালবিয়া পাঠ করা: “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক”
- নির্দিষ্ট কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা (যেমন শিকার করা, চুল কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদি)
হজ্জের বিভিন্ন স্তর
হজ্জের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে, যা ধারাবাহিকভাবে পালন করতে হয়:
১. তাওয়াফ – কাবা শরীফের চারপাশে সাতবার প্রদক্ষিণ করা। 2. সাঈ – সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌড়ানো। 3. আরাফাত ময়দানে অবস্থান – এটি হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 4. মুযদালিফায় রাত্রিযাপন – আরাফাত থেকে ফিরে এখানে রাত কাটানো হয়। 5. শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ – মিনাতে তিনটি জামারায় পাথর নিক্ষেপ করা হয়। 6. কুরবানি – পশু কোরবানি দেওয়া হয়। 7. তাওয়াফে ইফাদা – পুনরায় কাবার চারপাশে তাওয়াফ করা। 8. বিদায়ী তাওয়াফ – হজ্জ শেষে কাবার চারপাশে শেষবার তাওয়াফ করা।
হজ্জের আধ্যাত্মিক উপকারিতা
- আত্মশুদ্ধি ও পাপমোচন – হজ্জ পালনকারী ব্যক্তি তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ থেকে মুক্তি পান।
- তাকওয়া বৃদ্ধি – হজ্জের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
- দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্তি – হজ্জ মুসলমানদেরকে দুনিয়ার ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকতে শেখায়।
হজ্জের সামাজিক প্রভাব
- বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের একতাবদ্ধ করা – হজ্জ হল মুসলিম উম্মাহর এক মহামিলন।
- সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা – ধনী-গরিব, কালো-সাদা নির্বিশেষে সবাই একই পোশাক পরে, একই নিয়মে ইবাদত করে।
- মানবতার প্রতি দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি – হজ্জ পালনের মাধ্যমে মানুষ দানশীলতা ও পরোপকারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে।
উপসংহার
হজ্জ শুধু একটি ইবাদত নয়, এটি আত্মশুদ্ধি, পাপমোচন, এবং উম্মাহর সংহতির প্রতীক। এটি মুসলমানদের দুনিয়াবি লোভ-লালসা থেকে মুক্ত করে আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের উচিত জীবনে অন্তত একবার হজ্জ পালন করা এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা।