জুমার-খুৎবা

সুন্নি ইসলাম ও আব্বাসীয় খিলাফতের সম্পর্ক

ইসলামের ইতিহাসে আব্বাসীয় খিলাফত এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক শক্তি ছিল না, বরং ইসলামী সভ্যতার অগ্রগতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির একটি স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত। সুন্নি ইসলামের সাথে আব্বাসীয় খিলাফতের সম্পর্ক গভীর এবং বহুমাত্রিক। এই নিবন্ধে আমরা আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠা, তাদের শাসনামলে সুন্নি ইসলামের বিকাশ, এবং এ দুটি বিষয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠা

খিলাফতের উত্থান

আব্বাসীয় খিলাফত ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই খিলাফত ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.)-এর বংশধর আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের নামানুসারে নামকরণ করা হয়। আব্বাসীয় শাসকেরা উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং খোরাসান থেকে তাদের আন্দোলনের সূচনা করে।

কৌশলগত রাজনৈতিক চাল

  • উমাইয়া শাসকদের অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হওয়া।
  • শিয়া মুসলিমদের সমর্থন অর্জন।
  • সুফি ও সুন্নি মুসলিমদের একত্রিত করা।

প্রতিষ্ঠাতা শাসকগণ

আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম খলিফা আবু আল-আব্বাস আস-সাফফাহ (৭৫০-৭৫৪) ছিলেন। তার শাসনামলে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয় এবং তাদের পুরোপুরি পরাজিত করা হয়। তার পরে আল-মানসুর (৭৫৪-৭৭৫) ক্ষমতায় আসেন এবং বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে খিলাফতের রাজধানী হয়।

সুন্নি ইসলামের বিকাশ

সুন্নি ইসলামের মূলধারা

সুন্নি ইসলাম কুরআন, হাদিস এবং সাহাবাদের আমল ও মতামতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সুন্নি মুসলিমরা চারটি প্রধান মাযহাব অনুসরণ করেন:

  1. হানাফি
  2. মালিকি
  3. শাফি
  4. হানবলি

আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে সুন্নি ইসলামের প্রসার

আব্বাসীয় শাসনামলে সুন্নি ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থিত হয় এবং এর বিভিন্ন মাযহাব বিকাশ লাভ করে। বিশেষ করে হানাফি মাযহাবকে প্রধান বিচারব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

আলেমদের ভূমিকা

আব্বাসীয় খিলাফতের সময় আলেমরা ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রের উন্নয়ন ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

  • ইমাম আবু হানিফা: হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা।
  • ইমাম মালিক: মাওতা মালিক নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিকহি গ্রন্থ রচনা করেন।
  • ইমাম শাফি: ফিকহের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করেন।
  • ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল: হানবলি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা।

মাদ্রাসা ব্যবস্থার উন্নয়ন

আব্বাসীয় যুগে মাদ্রাসাগুলো সুন্নি ইসলাম শিক্ষা প্রদানের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বাগদাদ, কুফা, এবং বসরা ছিল জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র।

আব্বাসীয় খিলাফতের বৈশিষ্ট্য

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ

আব্বাসীয় শাসকরা কেবল ধর্মীয় বিষয়েই মনোযোগ দেননি, বরং বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাগদাদের “বায়তুল হিকমাহ” (জ্ঞানগৃহ) ছিল এই যুগের অন্যতম সেরা উদাহরণ।

গুরুত্বপূর্ণ অবদান

  • আল খাওয়ারিজমি: অ্যালজেব্রার জনক।
  • ইবনে সিনা: চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্ববিখ্যাত।
  • আল বিরুনি: জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ অবদান।

সুন্নি ও শিয়া সম্পর্ক

আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথমদিকে শিয়া মুসলিমদের সমর্থন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ক্ষমতা স্থিতিশীল হওয়ার পর সুন্নি ইসলামকে প্রধান ধর্মীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। শিয়া মতবাদকে খিলাফতের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এর প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সুন্নি ইসলাম ও আব্বাসীয় খিলাফতের পারস্পরিক সম্পর্ক

রাজনৈতিক সমর্থন

আব্বাসীয় খিলাফত সুন্নি ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সুন্নি আলেম ও ফকিহদের সমর্থন দেন এবং তাদের মতবাদ রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করেন।

ধর্মীয় সংস্কার

আব্বাসীয় যুগে সুন্নি ইসলামে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধিত হয়। উদাহরণস্বরূপ:

  • শরিয়া আইন প্রণয়ন।
  • মাদ্রাসা ও শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ।

সামাজিক প্রভাব

আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে সুন্নি ইসলাম সাধারণ জনগণের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। সুন্নি আদর্শে ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

উপসংহার

সুন্নি ইসলাম ও আব্বাসীয় খিলাফতের সম্পর্ক ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আব্বাসীয় শাসকরা সুন্নি ইসলামের বিকাশ ও প্রচারে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। তাদের শাসনামল ইসলামের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে ধর্ম, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির চর্চা ও উন্নয়ন ঘটে। বর্তমান যুগে এই সম্পর্কের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে মুসলিম উম্মাহ আরও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।