জুমার-খুৎবা

জুমার খুতবা | রাসূলুল্লাহ’র বিস্ময়কর মু’জিযা মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

২৩ রজব|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|২৫ ফেব্রুয়ারি’২২ 

 

 

“রাসূলুল্লাহ’র বিস্ময়কর মু’জিযা মিরাজুন্নবী” সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

 

 

 

মিরাজ আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন:

 

জেনে রাখুন, কোন কাজ যদি নিয়মের ব্যতিক্রম মাধ্যম ব্যতিরেকে আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ স্বরূপ সংঘটিত হয় তাকে “আয়াত” তথা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন বলা হয়। যেমন পিতা, মাতা ছাড়া হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা, মাতাবিহীন হযরত হাওয়া (আ:) কে সৃষ্টি করা, পিতা ছাড়া হযরত ঈসা আলাইহি সালাম কে সৃষ্টি করা আল্লাহর কুদরতের বহি:প্রকাশ।

 

নবীদের মু’জিযা আল্লাহর নিদর্শন:

সম্মানিত নবী রাসূলগণের নিকট থেকে স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম যখন কোন অলৌকিক কিছুর প্রকাশ ঘটে তা মু’জিযা হিসেবে পরিগণিত যেমন আল্লাহ তা’আলা হযরত মুসা (আ:)কে যাদু বিদ্যা মুকাবিলা করার জন্য তাঁকে লাটি ও সাদা হাতের মু’জিযা দান করেছেন। হযরত ঈসা (আ:) কে কুষ্টরোগী সুস্থ করা এবং মৃতকে জীবিত করার মু’জিযা দান করেছেন। এভাবে প্রত্যেক নবী রাসূল আলাইহিমুস সালামকে সীমিত সংখ্যক মু’জিযা দান করেছেন কিন্তু আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে, তিনি আমাদের মহান রাসূলকে অসংখ্য অগণিত মু’জিযা তথা আপাদমস্তক মু’জিযার অধিকারী করে প্রেরণ করেন।

 

 

মিরাজুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে জানতে বইটি সংগ্রহে রাখুন- 01516338399

কুরআনের আলোকে মিরাজুন্নবীর বর্ণনা:

প্রিয়নবীর পবিত্র সত্তা বর্ণনাতীত মু’জিযার সমাহার। মিরাজ নবীজির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর মু’জিযা। আল্লাহ তা’আলা মিরাজের বর্ণনা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, ‘যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাকে কুদরতের নিদর্শনাবলী দেখিয়ে দেই! নিশ্চয় তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনকারী। (সূরা: বনী ইসরাইল, আয়াত: ০১, পারা: ১৫)

 

আয়াত সংশ্লিষ্ট তাফসীর:

মক্কা শরীফের হেরম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ পবিত্র কুরআনের সূরা ইসরা দ্বারা প্রমাণিত। যার অস্বীকারকারী কাফির। মসজিদে আকসা থেকে আসমানী জগতের ভ্রমণ বর্ণনা মশহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, যার অস্বীকারকারী বিদআতী ও ফাসিক হিসেবে গণ্য। (মুদারেজুন নবুওয়াত, খন্ড: ১ম, পৃ: ২৮৭)

 

“হযরত খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার” বর্ণনা মতে মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা বলা হয়। বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আসমান সমূহের পরিভ্রমণকে মিরাজ এবং আসমান থেকে লা মকান তথা দিদারে এলাহীর সর্বোচ্চ স্তরে পদার্পণ মিরাজ নামে অভিহিত। (ফাওয়ায়েদুল ফাওয়ায়েদ, খন্ড: ৪, পৃ: ৩৫৮)

 

 

বর্ণিত আয়াতে সাতটি প্রশ্নের উত্তর এসেছে, ভ্রমণ বৃত্তান্তে সাতটি বিষয়ের অবগতি অর্জন প্রয়োজন হয়।

 

এক. ভ্রমণকে করিয়েছেন? জবাব এলো “সুবহানা” মহিমাময় সত্তা আল্লাহ।

 

দুই: ভ্রমণ কে করেছেন? জবাব এলো “বে আবহিহি” তাঁর বিশেষ বান্দা, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

 

তিন. সফর কোন স্থান থেকে শুরু, জবাব এলো “মিনাল মসজিদিল হারামে” মসজিদে হারাম থেকে।

 

চার. সফর কোন স্থান পর্যন্ত? জবাব এলো “ইলাল মাসজিদিল আক্‌সা” মসজিদে আকসা পর্যন্ত।

 

পাঁচ. সফর কোন সময়ে সংঘটিত হয়েছে? জবাব এলো “আস্‌রা” রাত্রি বেলায়।

 

ছয়. “সফরের সময়কাল কতটুকু? জবাব এলো “লায়লান” রাত্রির সামান্য অংশে।

 

সাত. সফর কি জন্য করালেন? জবাব এলো “লেনুরিয়াহু মিন আয়াতিনা” জবাব এলো আমার কুদরতী নিদর্শনাদি প্রত্যক্ষ করানোর জন্য। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২য়, পৃ: ৩৯৯)

 

মিরাজের সূচনা:

হযরত ইবনে হাজর মক্কী অসংখ্য বর্ণনা সূত্রে উল্লেখ করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উম্মে হানির ঘর থেকে মিরাজের যাত্রা করেন। (সিরতে হালভী, পৃ: ৪০৫, তাফসীরে ইবনে কাছীর, খন্ড: ২য়, পৃ: ২৫৪, আত্‌তাবকাতুল কুবরা, খন্ড: ১, পৃ: ২১৪)

 

মিরাজের রজনী:

 

২৭ রজব সোমবার রজনীতে মিরাজ সংঘটিত হয়। সোমবারে পৃথিবীতে নবীজির শুভাগমন। সোমবারে নবীজির ওফাত, সোমবারে নবুওয়তের ঘোষণা, সোমবারে মক্কা শরীফ থেকে হিজরত, সোমবারেই মদীনা মনোওয়ারায় প্রবেশ। (সিরতে হালভী, পৃ: ৪০৫)

 

বোরাক নিয়ে জিবরাইল (আ:)’র আগমন:

হযরত জিবরাঈল (আ:) সওর হাজার ফিরিস্তার জামাত সহকারে বিশাল বহর নিয়ে বোরাক নিয়ে আগমন করলেন। নবীজি উম্মে হানির ঘরে বিশ্রাম করছিলেন, নবীজিকে তাজিমের সাথে জাগানো হলো, অত:পর বোরাকে আরোহণ করা হল, দ্রুতগতিতে মসজিদে আকসায় নিয়ে যাওয়া হল সেখানে হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম আমাদের মহান রাসূলের সম্মানার্থে অপেক্ষমাণ, সকলে নবীজির দর্শন লাভে আল্লাহর গুণগান প্রশংসা করলেন। নবীজির প্রতি সালাত-সালাম পেশ করলেন। সকলে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোত্তম হওয়ার স্বীকারোক্তি প্রদান করলেন। (মুদারেজুন নবুওয়ত, পৃ: ২৯৫)

 

হযরত জিবরাঈল (আ.) আজান দিলেন :

ইমামুল আম্বিল সৈয়্যদুল মুরসালীন ইমামতের মুসল্লায় উপবিষ্ট হয়ে নামাযের ইমামতি করলেন, সুবহান্নাল্লাহ।

মিরাজের হিকমত :

আমাদের নবী ইমামুল আম্বিয়ার পূর্বে যত নবী রসূল আলাইহিস সালাম তাশরীফ এনেছিলেন, সকলের কলেমা ছিল “আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” অর্থ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম’র সাক্ষী ছিল শ্রুতিমূলক শোনার ভিত্তিতে। কোন নবীই মহান আল্লাহ তা’আলাকে দেখেন নি, সাক্ষ্য পূর্ণতা লাভ করে দেখার ভিত্তিতে এ জন্যই প্রযোজন ছিল এমন একজন শানদার মহান নবীর, যিনি আল্লাহকে দেখেই একত্ববাদের সাক্ষ্য দেবেন, যাতে এ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সকলের সাক্ষ্য চুড়ান্তভাবে পূর্ণতা লাভ করে। এ কারণেই সাক্ষ্যের পূর্ণতা দানের জন্যই আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীব ইমামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিস্ময়কর মু’জিযা উর্ধ্বজগত তথা লা মকান পর্যন্ত পরিদর্শন ক্ষমতা ও দীদারে এলাহীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। তিনি আল্লাহর দিদার লাভে ধন্য হন এবং সমগ্র সৃষ্টিরাজিও অবলোকন করেন। নবীজির মাধ্যমে শাহাদত তথা একত্ববাদের সাক্ষ্যে পূর্ণতা পেয়েছে। ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম জীবন বিধান, আল্লাহর মনোনীত দ্বীন হিসেবে ঘোষিত হলো, এ কারণেই নবীজির পর আর দ্বিতীয় কোন নবীর আগমন হবে না। তিনিই সর্বশেষ নবী। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২য়, পৃ: ৩৯৬)

 

মিরাজে আম্বিয়ায়ে কেরামের সাক্ষাত :

 

আল্লাহর আরশের মেহমান নবীজির সাথে প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ.) এর সাক্ষাত হয়। দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা (আ.) ও হযরত ইয়াহিয়া (আ.) এর সাক্ষ্যৎ হয়, তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.) এর সঙ্গে, চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরীস (আ.) এর সঙ্গে, পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.)’র এর সঙ্গে, ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.) এর এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহার দিকে অগ্রসর হন। অত:পর আরশ মুয়াল্লায় গমন করেন, আল্লাহ পাকের একান্ত সান্নিধ্যে লাভে ধন্য হন। (তাফসীরে রুহুল বয়ান, খন্ড: ৫ম, পয়গামে মিরাজ, পৃ: ১৬৫, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড ২য়, পৃ: ৪২৯)

সিদরাতুল মুনতাহা গমন:

রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম আসমান থেকে সপ্তম আসমান পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত বিস্ময়কর জগত অবলোকন করেন। হাদীস শরীফে নবীজি এরশাদ করেছেন, “আমি সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উর্ধ্বগমন করেছি, তখন দেখতে পেলাম তার কুল বরই ফল হাজর নামক মটকা সদৃশ্য, তার পাতা হাতির কান সদৃশ্য। জিবরাঈল (আ.) বললেন, এটা সিদরাতুল মুনতাহা। (মুসলিম, খন্ড: ১ম, পৃ: ৯১)

 

সিদরা অর্থ কুলবৃক্ষ মুনতাহা অর্থ শেষ প্রান্ত :

 

সিদরাতুল মুনতাহা ফিরিস্তাদের যাত্রার প্রান্তসীমা। ফিরিস্তারা এ সীমা অতিক্রম করতে পারেনা। নবীজি তা অতিক্রম করে আরো অনেক উর্ধ্বে আরোহণ করেছেন। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট রয়েছে বায়তুল মামুর। নবীজি বায়তুল মামুরে তাশরীফে নিলেন সেখানে সওর হাজার ফিরিস্তারা নবীজিকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করলেন, নবীজি বায়তুল মামুরে ফিরিস্তাদের নামায পড়ালেন, বায়তুল মুকাদ্দাসে আম্বিয়ায়ে কেরামের ইমাম হলেন এবং বায়তুল মামুরে ফিরিস্তাদের ইমাম হলেন। (রুহুল বয়ান, খন্ড: ৫ম)

ফিরিস্তাদের কা’বার নাম, বায়তুল মামুর :

মানুষ যেভাবে খানায়ে কা’বার তাওয়াফ করে থাকেন, তেমনিভাবে ফিরিস্তারা বায়তুল মামুরের তাওয়াফ করেন। দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেস্তা বায়তুল মামুর যিয়ারতে গমন করেন। (মুদারেজুন নবুওয়ত, খন্ড:১ম, পৃ: ৩০১)

 

মিরাজুন্নবী রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শ্রেষ্ঠতম মু’জিযা, নূরের নবীর শ্রেষ্ঠতের পরিচায়ক পবিত্র মিরাজ। মহান আল্লাহর অপার করুণা, অনুগ্রহ, নিয়ামত, রহমত, বরকত প্রাপ্তির সাওগাত, মহিমান্বিত রজনী মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

 

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।