জুমার খুতবা | রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র রওজা মোবারক যিয়ারতের ফযীলত
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
জুমার খুতবা
১৯ যিলহজ|১৪৪২ হিজরি|শুক্রবার|৩০ জুলাই|২০২১’ইং
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র রওজা মোবারক যিয়ারতের ফযীলত
যিয়ারত অর্থ ও শরয়ী ভিত্তি:
যিয়ারত বা যিয়ারা আরবি শব্দ। এর অর্থ দর্শন করা, সাক্ষাৎ করা, ইসলামি পরিভাষায় পবিত্র স্থান, সম্মানিত নবী রাসূলগণের রওজা শরীফ, কামিল অলী, বুজুর্গ, সূফী সাধক ও ইসলাম প্রচারকগনের সমাধিস্থান দর্শন করত তথায় কুরআন মজীদ পাঠ, দুআ দরুদ ও ফাতিহা পাঠ শেষে আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা যিয়ারত নামে স্বীকৃত। এমনকি সাধারণ মু’মিনদের কবর যিয়ারতের গুরুত্ব ও উপকারিতা হাদীস শাস্ত্র ও ফিকহ শাস্ত্রের অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কিতাবের বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং কবর যিয়ারত করা, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তবে তাবেঈন, মাযহাবের ইমামগণ, আউলিয়ায়ে কেরাম কর্তৃক যিয়ারত করা নির্ভরযোগ্য বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত।
আল কুরআনের আলোকে রওজা শরীফের যিয়ারত:
নবীজির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা মু’মিন হওয়ার পূর্বশর্ত। কোন মু’মিন মুসলিম আল্লাহর রাসূলের রওজা মুবারক যিয়ারত করা এটি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি ভালবাসার নিদর্শন। রওজা শরীফের যিয়ারত ইবাদত সমূহের মধ্যে উত্তম ইবাদত। হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা হাসান শারাম্বোলালী (র.)’র মতে রওজা মুবারক যিরারত করা ওয়াজিবের কাছাকাছি। হযরত ইমাম ফাসী মালেকী (র.)’র মতে রওজা মুবারক যিয়ারত করা ওয়াজিব। মহান আল্লাহ তা’আলা গুনাহগার বান্দাদেরকে গুনাহ মার্জনার জন্য তাঁর প্রিয় হাবীবের দরবারে গমনের নির্দেশ প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, “যখন তারা নিজেদের আত্মার উপর অত্যাচার করে তখন হে মাহবুব তখন তারা আপনার নিকট আসলে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আর রাসূলও তাদের জন্য শাফায়াত করলে তারা আল্লাহকে তাওবা কবুল কারী এবং দয়াবান পাবে। [তরজমা কানযুল ঈমান, সূরা: নিসা, আয়াত: ৬৪]
বিখ্যাত ফাতওয়া গ্রন্থ “আলমগীরিতে” আছে যখনই কোন মুসলিম রওজা শরীফে আগমন করবে তখন সে যেন এ আয়াত তিলাওয়াত করে। হযরত মওলা আলী (রা.) কর্তৃক হাদীসের বর্ণনা দ্বারা একজন বেদুঈন রাসূলুল্লাহর রওজা শরীফে হাজির হয়ে উক্ত আয়াত পাঠ করলে রওজা শরীফ থেকে সুসংবাদ এলো আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। [তাফসীরে কুরতুবী, খন্ড ৫, পৃ: ২৬৫]
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (র.)’র নুরানী ঘরই রওজা শরীফ:
প্রিয় নবীর প্রিয় শহর মদীনা মনোওয়ারার বুকে উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (র.)’র নুরানী ঘরে যেখানে নুরনবীজি ইন্তেকাল করেন সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। যে নুরানী স্থানে তিনি সমাধিস্থ হয়েছেন বিশ্বের মুসলমানদের কাছে তা রওজা মুবারক বা রওজা শরীফ নামে প্রসিদ্ধ। নবীগণের ইন্তেকাল আর অন্যদের ইন্তেকাল এক নয়। নবী ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে যতবড় মর্যাদার অধিকারী হোক যেখানে ইন্তেকাল করবে সেখানে দাফন করা অপরিহার্য নয়। ব্যাতিক্রম নবীদের ক্ষেত্রে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর তাঁর দাফন কোথায় করা হবে তা নিয়ে সাহাবাগণের বিভিন্নজন বিভিন্নমত প্রকাশ করলেও হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, আমি রাসূলুুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি আল্লাহর নবী যেখানে ইন্তেকাল করেন সেখানে তাঁকে দাফন করতে হয়। [মুসনাদে আহমদ, খন্ড ১ম, পৃ: ৭, তারিখে মদীনা মুনোওয়ারা, পৃ: ৯৪]
হাদীস শরীফের আলোকে রওজা শরীফ যিয়ারতের গুরুত্ব:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রওজা শরীফ যিয়ারত অত্যন্ত সওয়াবের কাজ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের সর্বোৎকৃষ্ট উপায়, ইহকাল পরকালে এর উপকারিতা সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সকল প্রকার সংশয় ও বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য উপরন্ত এ পুণ্যময় আমল অর্জনের মাধ্যমে ধন্য হওয়ার জন্য কয়েকটি নির্ভরযোগ্য হাদীস উপস্থাপন করছি।
১. হযরত নাফে (র.) হযরত ইবনে ওমর (র.) থেকে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে আমার রওজা যিয়ারত করেছে তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যায়। [তিরমিযী, নাওয়দিরুল উসুল, খন্ড ২, পৃ: ৬৮, বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, খন্ড ৩, পৃ: ৪৯০, শিফা, খন্ড ২, পৃ: ৮৩, আশ শিফাউল সিকাম, পৃ: ৩, দারেকুতনী, খন্ড ২, পৃ: ২৭৮, বাহারে শরীয়ত ৬ষ্ঠ খন্ড]
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, যে আমার ইন্তেকালের পর আমার যিয়ারত করেছে সে যেন জীবদ্দশায় আমার সাক্ষাৎ করেছে। [বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, খন্ড ৩, পৃ: ৪৮৮, আদদুররাতুস সমনীয়া ফীমা লিযায়িরীন নবী ইলাল মদীনা, পৃ:২১৬]
৩. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে হজ্বব্রত পালন করেছে এবং আমার ইন্তেকালের পর আমার মসজিদে আমার যিয়ারত করেছে সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাক্ষাৎ করেছে। [ বায়হাকী, সুন্নানুল কুবরা, খন্ড ৫, পৃ: ২৪৬, সুনানে দারে কুতনী, খন্ড ২, পৃ: ২৭৮]
৪. প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনায় আগমন করবে কিয়ামতের দিন তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে যাবে যে ব্যক্তি দু’হেরমের কোন এক হেরমে মৃত্যুবরণ করবে সে ক্বিয়ামতের দিন নিরাপত্তাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে। [বায়হাকী, সুনানুন কুবরা, খন্ড ৫, পৃ: ১৪০, তাবরানী, আসছগীর, খন্ড ২, পৃ: ৮৫]
৫. রওজা শরীফ যিয়ারত গমনে নিরুৎসাহিত করা সুন্নাহ বিরোধী। রওজা শরীফ যিয়ারতে গমনে নিরুৎসাহিত করা, অনাগ্রহ সৃষ্টি করা, গুরুত্বহীন মনে করা, অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা, মু’মিনের পরিচায়ক নয়। হতভাগা, কল্যাণ বঞ্চিত ব্যক্তিরাই পূন্যময় কাজে বাধা সৃষ্টি করে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন।
যে ব্যক্তি কেবল আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমার রওজা শরীফে আসবে কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে যাবে। [তাবরানী, মুজামুল কবীর, খন্ড ১২, পৃ: ২২৫, দারে কুতবী, জযবুল কুলুব, পৃ: ২০৫]
রওজা শরীফ যিয়ারতের ওসীলায় হজ্ব কবুল হয়: শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (র.) বলেন, মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র দরবারে উপস্থিত ও যিয়ারতের ওসীলায় ক্বাবা শরীফের হজ্বও আল্লাহ কবুল করেন। [ জযবুল কুলুব, পৃ: ২০৬, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড ৩য়, পৃ: ৩৮২]
৬. রাসূলুল্লাহর রওজা শরীফ যিয়ারত না করার পরিণতি
যে ব্যক্তি হজ্ব করেছে কিন্তু নবীজির রওজা শরীফ যিয়ারত থেকে বিরত রইলো তার ব্যাপারে নবীজির কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, যে হজ্ব করেছে অথচ আমার যিয়ারত করল না সে আমার উপর জুলম করেছে। (নাউজুবিল্লাহ) [ওয়াফাউল ওয়াফা, খন্ড ২, পৃ: ৩৯৮, কানযুল উম্মাল, খন্ড ৫ম, পৃ: ১৩৫, জযবুল কুলুব, পৃ: ২০৬]
মসজিদে নববী শরীফে সর্বোচ্চ আদব রক্ষা করতে হবে: আমিরুল মু’মেনীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (র.) মসজিদে নববী শরীফে উচ্চৈঃস্বরে আওয়াজকারী দু’ ব্যক্তিকে ডেকে আনার জন্য হযরত সায়িব ইবন ইয়াজিদকে নির্দেশ দিলেন, ফারুকে আজম (র.) দু’জনকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কোন স্থানের বাসিন্দা? জবাব দিলেন আমরা তায়েফবাসী, ফারুক আজম (র.) বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে তোমরা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছ? [বোখারী শরীফ, খন্ড ১ম, পৃ: ৬৭] আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, তোমরা তোমাদের আওয়াজ নবীর আওয়াজের উপর উচু করোনা। [ মিরকাত শরহে মিশকাত, খন্ড ২য়, পৃ: ২২৩]
জান্নাতুল বাক্বী কবরস্থানে যিয়ারত:
রওজা শরীফ যিয়ারত শেষে মদীনা শরীফের মর্যাদাপূর্ণ জান্নাতুল বাক্বীতে কবরস্থানে যিয়ারত করুন, এ কবরস্থানে দশ হাজার সাহাবায়ে কেরাম শায়িত আছেন। তাবেঈন, তবে তাবেঈন, আউলিয়া, ওলামা, সালেহীন আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সংখ্যা বর্ণনাতীত। এখানে শায়িত আছেন আমিরুল মু’মেনীন হযরত ওসমান জিন্নুরাইন (রা.) নবীজির আওলাদ পাকদের মধ্যে বিশেষত: সৈয়্যদা ফাতেমাতুজ্জাহরা (রা.), হযরত রুকেয়া (রা.), হযরত উম্মে কুলসুম (রা.), হযরত যয়নব (রা.), সাহাবী হযরত ওসমান ইবন মজউন (রা.), হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ(রা.), হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.), প্রমূখ সাহাবায়ে কেরাম এখানে শায়িত আছেন।
শোহাদায়ে ওহুদের যিয়ারত:
মদীনা মুনাওয়ারার মর্যাদাপূর্ণ একটি পাহাড়ের নাম জবলে ওহুদ। এ পবিত্র পাহাড়ের উপর আল্লাহর নবী সৈয়্যদানা হারুন আলাইহিস সালাম’র মাজার মরীফ রয়েছে। ওহুদ যুদ্ধে নবীজির দান্দন মুবারক শহীদ হয়েছিল। এখানে নবীজি সৈয়্যদানা সিদ্দিকে আকবর, ফারুকে আজম ও হযরত ওসমান জিন্নুরাইন (রা) কে সাথে নিয়ে আরোহণ করেছিলেন। [ বোখারী শরীফ, ১ম খন্ড, পৃ: ৫২৪, মদীনাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পৃ: ৩১২]
হে আল্লাহ আমাদের কে আপনার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারক যিয়ারত করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।