জুমার খুতবা | কুরবানির ফযিলত ও আক্বিকার বিধান
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল모든 글 আলম রিজভি
জুমার খুতবা
০৫ জিলহজ|১৪৪২ হিজরি|শুক্রবার|১৬ জুলাই|২০২১
“কুরবানির ফযীলত ও আক্বিকার বিধান”
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য, সামর্থবান মুসলমানদের উপর কুরবানী অপরিহার্য করেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি আমাদের মহান নবী সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় বান্দা ও প্রিয় রাসূল। তাঁর উপর দরুদ সালাম বর্ষিত হোক। তাঁর পবিত্র বংশধরগন, সম্মানিত সাহাবাগণ, তাঁর পদাঙ্ক অনুসারী সত্যান্বেষীদের উপর অসংখ্য করুণাধারা বর্ষিত হোক।
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী পেশ করুন। জেনে রাখুন কুরবানী একটি আর্থিক ইবাদত, যা সামর্থবান মুসলমানদের উপর ওয়াজিব।
আল কুরআনের আলোকে কুরবানীর বিধান:
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম’র কুরবানীর অবিস্মরণীয় ঘটনাকে জীবন্ত করে রাখার জন্যই উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আল্লাহ কুরবানীর বিধান ওয়াজিব করেছেন। দ্বিতীয় হিজরীতে ঈদুল আযহার বিধান, কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার বিধান নাযিল করেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “সুতরাং আপনি আপনার প্রতি পালকের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। [তরজমা কানযুল ঈমান, সূরা: কাউসার, ১০৮:২]
কুরবান শব্দের আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ:
কুরবানুন শব্দটি আরবি, কুরবুন শব্দ থেকে নির্গত, এর আভিধানিক অর্থ নৈকট্য লাভ, ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন ইত্যাদি।
ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ “শরহে বেকায়াতে” উল্লেখ আছে, শরয়ী পরিভাষায় কুরবানীর দিন সমূহের কোনো একটি দিনে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট প্রাণী জবাই করাকে উদ্বহিয়া তথা কুরবানী বলা হয়। অনুরূপ ভাবে বিশ্ববিখ্যাত ফাতওয়া গ্রন্থ “আল ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবাআ” কিতাবে উল্লেখ আছে, কুরবানীর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে চতুস্পদ জন্তু জবেহ বা নহর করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নাম হলো কুরবানী। [আল ফিকহু আলালা মাযাহিবিল আরবাআ, খন্ড ১ম, পৃ: ৭১৫ কৃত: আল্লামা আবদুর রহমান জাযিরী (র.)]
কুরবানীর বিধান কুরআন সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত। এটা ইসলামের একটি বিশেষ ইবাদত। কুরবানী না করে এর বিনিময় মূল্য ইত্যাদি দেওয়া যাবেনা। [তাফসীরে নূরুল ইরফান, কৃত: হাকিমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র)]
কুরবানি আল্লাহর নিকট প্রিয় আমল:
পশুর রক্ত প্রবাহিত করা বা মাংস খাওয়ার নাম কুরবানী নয়। মহান আল্লাহর প্রেমে অন্তরাত্মাকে বিশুদ্ধচিত্তে তাকওয়া অর্জনের মধ্য দিয়ে নিজেকে আল্লাহর নিকট উৎসর্গ করা পশুবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তির তাড়না থেকে নিজকে পরিশুদ্ধ করাই কুরবানীর মর্মকথা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহর নিকট পৌছায়না এর মাংস ও রক্ত পৌছায় তোমাদের তাকওয়া।” [সূরা: হজ্ব ২২:৩৭]
খোদাভীতি ও তাকওয়া শূন্য ইবাদত আল্লাহর নিকট গুরুত্বহীন ও অর্থহীন। কে কত বড় পশু কুরবানী দিল তা মুখ্য নয়। আল্লাহর কাছে লৌকিকতা ও পশু ক্রয়ের প্রতিযোগিতা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন।” [সূরা: মায়িদা ৫:২৭]
হাদীস শরীফের আলোকে কুরবানির ফযীলত:
হাদীস শরীফে কুরবানীর গুরুত্ব ও ফযীলত সংক্রান্ত অসংখ্য বর্ণনা এসেছে, এরশাদ হয়েছে, উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আদম সন্তান কুরবানীর দিন যেসব নেক আমল করেন তন্মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো কুরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। কিয়ামতের দিবসে কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত হবে। তার কুরবানীর রক্ত জমীনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নিকট তা কবুল হয়ে যায়। অতএব তোমরা আন্তরিকভাবে সন্তুষ্টিচিত্তে কুরবানী করো। [তিরমিযী শরীফ, ১ম খন্ড, পৃ: ২৭৫, ইবনে মাযাহ শরীফ, পৃ: ২২৬]
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, তোমরা মোটা তাজা পশু কুরবানী করো, কেননা কুরবানীর পশু পুলসিরাতে তোমাদের বাহন হবে। [কানযুল উম্মাল, খন্ড ৫ম, পৃ: ৩৫, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড ৩য়, পৃ: ৩৭৬, ফয়যুল কদীর, খন্ড ১ম, পৃ: ৪৯৬]
স্বচ্ছলতা সত্ত্বেও কুরবানি বর্জনকারীর জন্য সতর্কতা:
কুরবানী একটি পুণ্যময় ইবাদত ও সওয়াবের কাজ। হিজরতের পর মদীনা মনোওয়ারায় অবস্থানকালীন সময়ে নবীজি কোনো বৎসর কুরবানী ত্যাগ করেননি। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করেনা সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। [সুনানে ইবনে মাযাহ, ৩১২৩, ফয়জুল কাদীর, খন্ড ৬ষ্ঠ, পৃ: ২০৮]
কুরবানির সময়সীমা ০৩ দিন:
১০ জিলহজ্ব তারিখে কুরবানী করা উত্তম। কোন কারণবশত প্রথম দিবসে করা সম্ভব না হলে দ্বিতীয় দিন, এতেও সম্ভব না হলে ১২ তারিখ পর্যন্ত করা জায়েজ। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কুরবানীর সময় তিন দিন, প্রথম দিনই উত্তম। [ বাদায়েউস সানায়ে, খন্ড ৫ম, পৃ:৬৫]
মাসআলা:
কুরবানীর পশু ক্রয় করেছে কিন্তু কুরবানীর দিন সমূহে কোন কারণে কুরবানী করতে পারেনি সেক্ষেত্রে পশু সাদকা করে দিবে। আর যদি পশু ক্রয় না করে থাকে তখন একটি বকরীর মূল্য সাদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। এরূপ করা না হলে গুনাহগার হবে। [রদ্দুল মুখতার, খন্ড ৫ম, পৃ: ২০৪, ফাতওয়া-এ ফয়জুর রাসূল, খন্ড ৩য়, পৃ: ২৩০]
১০ জিলহজের ফযীলত:
জিলহজের দশম তারিখ এর ফযীলত প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, এরশাদ হয়েছে, হযরত জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর নিকট ১০ জিলহজ (ঈদুল আযহা) থেকে উত্তম কোনো দিন নেই। [সহীহ ইবন হিব্বান ৯/১৬৪, হাদীস নং: ৩৮৫৩]
তাকবীরে তাশরিক বলা ওয়াজিব:
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, তাবিয়ী হযরত আসওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আরফাত দিন (৯ জিলহজ্ব) ফজরের নামায থেকে কুরবানীর দিন সমূহের আসর পর্যন্ত তাকবীর বলতেন “আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ। [ইমাম ইবন আবি শায়বা, আল মুসান্নাফ হাদীস ৫৬৩৩, সহীহুল বিহারী, খন্ড ৫ম, কৃত: আল্লামা যুফরুদ্দিন বিহারী (র.)]
মাসআলা:
জিলহজের ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত ফরজ নামাযের পর একবার তাকবীর তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব। নফল, সুন্নাত ও বিতরের পর তাকবীর তাশরিক ওয়াজিব নয়। জুমার পর তাকবীর তাশরিক ওয়াজিব। ঈদুল আযহার নামাযের পরেও তাকবীর তাশরিক পাঠ করবে। [ বাহারে শরীয়ত, খন্ড ৪র্থ, পৃ: ১৪৭,১৪৮]
কুরবানির জন্য পশু নির্বাচন ও অংশীদারি কুরবানি:
গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা হালাল গৃহপালিত পশু দ্বারা কুরবানী জায়েজ। প্রথম তিন প্রকার জন্তুতে এক হতে সাত জনের নামে কুরবানী জায়েজ। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এ তিন শ্রেণির পশুতে একাধিক ব্যক্তি শরীক হতে পারবেনা। অংশীদারী কুরবানী করলে মাংস ওজন করে বন্টন করা বাঞ্চনীয়। মাংস তিন ভাগ করা উত্তম। এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনের জন্য, এক ভাগ ফকীর মিসকীনদের জন্য। [আলমগীরি ৫ম খন্ড, বাহারে শরীয়ত, রদ্দুল মুখতার]
ঈদুল আযহার নামায:
ঈদুল আযহার দু’রাকাত নামায ওয়াজিব। নামাযের পর খতীব সাহেব দুটি খোতবা পাঠ করা সুন্নাত। ঈদুল আযহার নামাযে আজান ও ইকামত নেই। ঈদুল আযহার নামায তাড়াতাড়ি পড়া মুস্তাহাব। [আলমগীরি, দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত ৪র্থ খন্ড, পৃ: ১৪২,১৪৩]
কুরবানির পশু জবেহ করার বিধান:
পশু জবেহের নিয়ম জানা থাকলে নিজ হাতে জবেহ করা সুন্নাত। অন্যজন দ্বারা জবেহ করলে সামনে উপস্থিত থাকা উত্তম। জবেহ করার সময় পশুকে ক্বিবলা মুখী করে শোয়াবে। অত:পর “বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর” বলে জবেহ করা, জবেহকারী ও ক্বিবলামুখী হওয়া সুন্নাত। ছুরি ভাল ভাবে ধার দিবে, দ্রুত জবেহ করে নিবে চারটি রগ যেন কাটা যায়, উত্তম হলো জবেহের পর বাঁধন খুলে দেওয়া। [বাহারে শরীয়ত, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ: ১১৪১]
ইসলামে আক্বীকার বিধান:
ইমাম আবু হানিফা (র.)’র মতে আক্বীকা করা সুন্নাত। সন্তান জন্মের শুকরিয়া স্বরূপ যে পশু জবেহ করা হয় তাকে আকীকা বলে। ছেলের আকীকায় দুটি ছাগল, মেয়ের আকীকায় একটি ছাগল, কুরবানীর সাথে আক্বীকাও সম্পৃক্ত করা যাবে। গরু, মহিষ, উট, হলে ছেলের জন্য সাত অংশের দু’অংশ। মেয়ের জন্য এক অংশ আক্বীকা দেয়া যাবে। আক্বীকার মাংস পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানী সকলে খাওয়া জায়েজ। আক্বীকার দাওয়াতে অংশ গ্রহণে নিষেধ নেই। আক্বীকার মাংসের এক তৃতীয়াংশ ফকীর মিসকীনকে দান করা উত্তম। শিশু সন্তান কে বিভিন্ন প্রকার রোগব্যাধি বালামুসিবত ইত্যাদি থেকে নিরাপদ রাখতে আকীকা একটি উত্তম আমল। [ আহকামে শরীয়ত, ২য় খন্ড, পৃ: ১৯০, কৃত ইমাম আহমদ রেযা (র.), আনোয়ারে শরীয়ত, কৃত: আল্লামা মুফতি জালাল উদ্দিন আমজাদী (র.)]
হে আল্লাহ আমাদের কে আপনার ও আপনার প্রিয় হাবীবের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কুরবানি করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী)
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।