জ্ঞান ও জ্ঞানীর মর্যাদা (ইলম ও ওলামা)
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
بسم الله الرحمن الرحیم
আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একটি মহান উদ্দেশ্যে। আর তা হলো, মানুষ যাতে কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ইবাদতে কাউকে শরীক করবেনা। আর আল্লাহর ইবাদত করতে হলে বান্দাকে জানতে হবে যে, কোনটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং কোনটি নয়। পাশাপাশি দুনিয়ার জীবনে মানুষের জন্য হক ও বাতিল, হেদায়েত ও গোমরাহির মাঝে পার্থক্য করে হককে গ্রহণ ও হেদায়েতের ওপর অটল-অবিচল থাকা অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যকীয়। আর এ আবশ্যকীয়তা ও প্রয়োজন পূরণ করার জন্য প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় দীনের ইলম বা জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
একজন মানুষের প্রকৃত মুমিন হওয়া নির্ভর করে ইলম হাসিলের ওপর। কারণ কোনো ব্যক্তি ইলম হাসিল করা ছাড়া প্রকৃত মুমিনই হতে পারে না। কেননা তাওহীদ ও রিসালতের মর্মবাণীর মধ্যে ইলম অপরিহার্যভাবে জড়িত ও পরিব্যপ্ত। ইলম ছাড়া তাওহীদ ও রিসালতের মর্মবাণী যথার্থভাবে উপলব্ধি যায় না। একারণেই ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সহীহ বুখারীতে ইলমকে আমলের আগে প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন এবং একটি অধ্যায় কায়েম করেছেন নিম্নোক্ত শিরোনামে
بَاب الْعِلْمُ قَبْلَ االْقَوْلِ وَالْعَمَلِ لِقَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى: فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ
‘এ অধ্যায় কথা ও কাজের আগে ইলম- এ বিষয়ে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা জানো যে আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই’।
নারী-পুরুষ সকলেই ইলম অন্বেষণে আদিষ্ট:
ইলমের এই মর্যাদা লাভের জন্য শুধু পুরুষরাই নয় বরং নারীরাও আদিষ্ট। সকলের জন্য এই মর্যাদা এবং সকলের জন্য তা অপরিহার্য। যেমন:
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ .
‘হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইলম অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলিমের ওপর ফরয।’( 1)
কোন্ ইলম শিক্ষা করা ফরয?
‘ইলম শিক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরয।’(2 ) এর ব্যাখ্যায় ওলামায়ে কেরাম লিখেন,
فأشرف العلوم ثمرة العلم بالله سبحانه وتعالى وملائكته وكتبه ورسله وما يعين عليه فان ثمرته السعادة الأبدية. (3 )
‘সর্বশ্রেষ্ঠ ইলম হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে জ্ঞান হাসিল হওয়ার ইলম, তাঁর ফেরেশতা, রাসূল এবং এগুলোর সহায়ক ইলম। কারণ এর ফল হলো অনন্ত সৌভাগ্য।’
ইলম হাসিলের কাজে লিপ্ত থাকা নফল ইবাদতে মশগুল থাকার চেয়ে বেশি মর্যাদার। কেননা ইলম মানুষকে আল্লাহর ভয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পন্থা শেখায়। হাদীছে শরীফে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ أَوْحَى إِلَيَّ أَنَّهُ مَنْ سَلَكَ مَسْلَكًا فِي طَلَبِ الْعِلْمِ سَهَّلْتُ لَهُ طَرِيقَ الْجَنَّةِ
‘হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট এই মর্মে ওহী প্রেরণ করেন, যে ব্যক্তি ইলম তলবের পথ গ্রহণ করে আমি তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দিই।
আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দান করেছেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। আর আলেমদেরকে সাধারণ আবেদের তুলনায় এতবেশী মহামান্বিত করেছেন যে, অন্যান্য নবী-রাসূলগণের উপর যেমনিভাবে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা, আনুরূপভাবে আবেদদের উপর আলেমদের।
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ البَاهِلِيِّ، قَالَ: ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلَانِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالآخَرُ عَالِمٌ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ. ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرَضِينَ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الخَيْرَ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে দুইজন ব্যক্তির কথা আলোচনা করা হলো। তাদেও একজন আবেদ আর অপরজন আলেম। জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ওই দুইজনের মধ্যে আলেমের মর্যাদা তেমন সুউচ্চ, যেমন আমার মর্যাদা একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে সুউচ্চ। এরপর তিনি বললেন, স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা আলেমের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতা, আসমান ও জমিনবাসী, এমনকি গর্তেও পিপিলিকা এবং সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।’(4 )
১. ইলম মানুষের অন্তরে আল্লাহ ভয় সৃষ্টি করে:
إِنَّمَا يَخۡشَى ٱللَّهَ مِنۡ عِبَادِهِ ٱلۡعُلَمَٰٓؤُاْۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ
বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল। {সূরা ফাতির, আয়াত: ২৮}
২. ইলম উত্তম জিহাদ:
উত্তম। কারণ ইলম অর্জনে বেশি কষ্ট করতে হয় এবং এর শত্রুও বেশি।
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ جَاءَ مَسْجِدِي هَذَا ، لَمْ يَأْتِهِ إِلاَّ لِخَيْرٍ يَتَعَلَّمُهُ أَوْ يُعَلِّمُهُ ، فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ ، وَمَنْ جَاءَ لِغَيْرِ ذَلِكَ ، فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ الرَّجُلِ يَنْظُرُ إِلَى مَتَاعِ غَيْرِهِ.
‘যে ব্যক্তি আমার এই মসজিদে কেবল কোনো কল্যাণ (ইলম) শেখার বা শেখাবার অভিপ্রায়ে আসবে, সে আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদের মর্যাদার অধিকারী। আর যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসবে, সে ওই ব্যক্তির অনুরূপ যে অন্যের সম্পদের দিকে তাকিয়ে থাকে বা যে অন্যের সম্পদ পরিদর্শনে আসে।(5 )
৩. ইলম প্রচারে প্রতিযোগিতা প্রশংসনীয়:
لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ أَعْطَاهُ اللَّهُ مَالاً فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِي الْحَقِّ ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ الْحِكْمَةَ فَهُوَ يَقْضِي بِهَا وَيُعَلِّمُهَا .
‘কেবল দুই ব্যক্তিকে হিংসা (ইর্ষা) করার অনুমতি রয়েছে: ওই ব্যক্তিকে আল্লাহ যাকে সম্পদ দিয়েছেন। অতপর তাকে সে সম্পদ হকের পথে ব্যয় করতে ন্যস্ত করেছেন। আর ওই ব্যক্তি যাকে তিনি হিকমাহ বা ইলম দান করেছেন। ফলে সে তা দিয়ে বিচার করে এবং তার শিক্ষা দেয়।’(6 )
৪. ইলম ও দীন সম্পর্কে পাণ্ডিত্য আল্লাহর মহাদান:
مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ.
‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তিনি তাকে দীন বিষয়ে গভীর ইলম দান করেন।’(7)
৫. ইলমের পথ জান্নাতের পথ:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (দীর্ঘ হাদীছের অংশ) ‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ (8 )
৬. ইলমের মজলিস রহমত অবতীর্ণ হওয়ার মজলিস:
وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ.
যখন কোন কাওম বা জনগোষ্টি আল্লাহ তাআলার ঘরগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি ঘওে একত্রিত হয় এবং তাঁর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরে ইলমের দরসে লিপ্ত হয় তখন সেই ঘরে রহমত অবতীর্ণ হয়, ফেরেশতারা সেই ঘরকে বেষ্টন করে নেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আশেপাশে যারা আছেন (ফেরেশতারা) তাদের কাছে ওই সকল লোকদের প্রশংসা করেন।( 9)
৭. ইলমের বাহকদের জন্য ফেরেশতারা নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেন:
عَنْ كَثِيرِ بْنِ قَيْسٍ، قَالَ: كُنْتُ جَالِسًا عِنْدَ أَبِي الدَّرْدَاءِ فِي مَسْجِدِ دِمَشْقَ، فَأَتَاهُ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا أَبَا الدَّرْدَاءِ، أَتَيْتُكَ مِنَ الْمَدِينَةِ، مَدِينَةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؛ لِحَدِيثٍ بَلَغَنِي أَنَّكَ تُحَدِّثُ بِهِ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ: فَمَا جَاءَ بِكَ تِجَارَةٌ؟ قَالَ: لَا، قَالَ: وَلَا جَاءَ بِكَ غَيْرُهُ؟ قَالَ: لَا، قَالَ: فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنَّ طَالِبَ الْعِلْمِ يَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ، حَتَّى الْحِيتَانِ فِي الْمَاءِ .
‘কাছীর ইবন কায়স থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, দামেশকের মসজিদে আমি হযরত আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে বসা ছিলাম। তাঁর কাছে জনৈক ব্যক্তি আগমন করে বললেন, হে আবূদ্দারদা! আমি মদীনা শহর তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শহর থেকে আপনার কাছে এসেছি একথা জেনে যে, আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শোনা একটি হাদীছ বর্ণনা করে থাকেন। আমি অন্য কোনো প্রয়োজনে আসিনি, কেবল সেই হাদীছটি শ্রবণ করতে এসেছি।
হাযরত আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, তুমি ব্যবসায়ীক বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আগমন করনি? একমাত্র এ কারণেই তুমি সফর করে এসেছ? লোকটি বললেন, হ্যাঁ। একমাত্র এ কারণেই এখানে এসেছি। তখন তিনি বললেন, তবে শুনে রেখো, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য বের হয় আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন। ফেরেশতারা তার সম্মানে নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেয়। আলেমের জন্য আসমান-জমিনের সবাই দু‘আ করতে থাকে। এমনকি সাগর ও খাল-বিলের মাছও পানির গভীর থেকে তার জন্য দু‘আ করতে থাকে…। (10 )
আল্লাহ তা‘আলার নিকট জিহাদ অত্যন্ত প্রিয় আমল। জিহাদের রাস্তার ধূলোবালিকে তিনি জাহান্নামের প্রতিবন্ধক বানিয়েছেন এবং এই পথের পথিককে দিয়েছেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পথিকের মর্যাদা। এই রাস্তার মুসাফিরের ধূলোবালি আর জাহান্নামের আগুন একত্রিত হওয়াকে তিনি হারাম করেছেন। ইলম অন্বেষণের রাস্তাকেও তিনি সেই মর্যাদাই দিয়েছেন এবং ইলম অন্বেষী ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত ঘরে না ফেরে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে জিহাদের রাস্তায় থাকারই ছাওয়াব দান করেন। হাদীছে শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنْ خَرَجَ فِي طَلَبِ الْعِلْمِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ حَتَّى يَرْجِعَ.
‘হযরত আনাছ ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য বের হয় সে আল্লাহর রাস্তায় থাকে, যতক্ষন না সে ফিরে আসে।’(11 )
১ . আলেমরাই বিশ্বস্ত:
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ
‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, আর ফেরেশতা ও জ্ঞানীগণও। তিনি ন্যায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’। {সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৮}
২. মারা গেলেও আলেমের আমল বন্ধ হয় না:
ইলমের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের জাগতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। দুনিয়ার যাবতীয় আসবাব-সম্পদ মৃতের জন্য অর্থহীন ও অকার্যকর প্রমাণিত হয়ে যায়। এমনকি জীবদ্দশার কৃত যাবতীয় ইবাদতের ছাওয়াবও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ইলম এমন এক ইবাদত, যার ধারাবাহিকতা কখনও শেষ হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তিনটি আমল ছাড়া তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। আমল তিনটি হচ্ছে চলমান সাদাকা, এমন ইলম, যা দ্বারা (অন্যরা) উপকৃত হয় তথা ইলমে নাফে‘ এবং নেক সন্তান, যে মৃতের জন্য দু‘আ করে।’ (12 )
একজন আলেমের প্রচার-প্রসারকৃত ইলম কেয়ামত পর্যন্ত তার আমলনামায় যুক্ত হওয়ার কথা অন্য হাদীছে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنَ مِنْ عَمَلِهِ وَحَسَنَاتِهِ بَعْدَ مَوْتِهِ عِلْمًا عَلَّمَهُ وَنَشَرَهُ، وَوَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ، وَمُصْحَفًا وَرَّثَهُ، أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ، أَوْ بَيْتًا لِابْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ، أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ، أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ، يَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মৃত্যুর পর মুমিনের সঙ্গে যেসব আমল যুক্ত হবে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে ইলম, যা সে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং যার প্রচার-প্রসার করেছে; পুণ্যবান সন্তান যে সে রেখে গিয়েছে; কুরআন যার সে উত্তরাধিকারী বানিয়েছে; মসজিদ যা সে বানিয়েছে; মুসাফিরদের আশ্রয়কেন্দ্র যা সে নির্মাণ করেছে; পানির নহর যা সে খনন ও জারী করেছে এবং সাদাকা যা সে নিজ জীবদ্দশায় ও সুস্থতাকালে আপন সম্পদ থেকে দান করেছে, এসব তার মৃত্যুর পর তার সঙ্গে যুক্ত হবে।’ (13 )
৩. আলেম ও তালেবে ইলমের প্রতি আল্লাহর অবিরাম রহমত বর্ষণ:
পৃথিবীর সব কিছুই ধ্বংসে নিপতিত, সবই বিলীনতার পথে ধাবমান। সব কিছুর ওপরই লানতের বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। সব কিছুর মধ্যে কেবল মানুষের দুইটি শ্রেণী ব্যতিক্রম যাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে: ইলমসম্পন্ন ব্যক্তি ও ইলম অন্বেষণকারী এবং অধিক হারে আল্লাহর যিকিরকারী আবেদ। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
أَلا إنَّ الدُّنْيَا مَلْعُونَةٌ ، مَلْعُونٌ مَا فِيهَا ، إلا ذِكْرَ اللهِ تَعَالَى ، وَمَا وَالاهُ ، وَعالِماً وَمُتَعَلِّماً
‘মনে রেখ, নিশ্চয় দুনিয়া অভিশপ্ত। অভিশপ্ত এতে যা আছে তা-ও। শুধু আল্লাহ তা‘আলার যিকির ও যিকিরের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো এবং আলেম ও তালেবে এলেম ছাড়া।’(14 )
৪. আলেমের জন্য সৃৃষ্টি জগত ক্ষমা প্রার্থনা করে:
ইলমওয়ালাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বুঝাতে এতটুকুই যথেষ্ট যে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য সব কিছুইকে অনুগত করে দেন যাতে তারা তাঁর জন্য দু‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করে। যেমন: হযরত আনাস ইবন মালেক রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
صَاحِبُ الْعِلْمِ يَسْتَغْفِرُ لَهُ كُلُّ شَيْءٍ حَتَّى الْحُوتُ فِي الْبَحْرِ .
‘ইলমের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই মাগফিরাত বা ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত।’ (15 )
৫. আলেমদের চেহারা উজ্জ্বল হয় এবং তাদেরকে সচ্ছলতা দান করা হয়:
আহলে ইলম যারা আল্লাহর দেয়া শরীয়তের জ্ঞান পৌঁছে দেন মানুষের কাছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু‘আ অনুসারে তারা হলেন মানুষের মধ্যে সবচে উজ্জ্বল চেহারাবিশিষ্ট এবং তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান। নবীজী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
نَضَّرَ اللَّهُ امْرَءًا سَمِعَ مَقَالَتِي فَبَلَّغَهَا ، فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ غَيْرِ فَقِيهٍ ، وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ.
‘আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল (কারো কারো ব্যাখ্যা মতে ওই ব্যক্তিকে সুখে-স্বাচ্ছন্দে) রাখুন যে আমার কথা শোনে অত:পর তা (অপরের কাছে) পৌঁছে দেয়। কেননা, ফিকহ বা ইলমের অনেক বাহক আছে যে (আসলে) ফকীহ বা আলেম (ইসলামী জ্ঞানে পন্ডিত) নয়। আবার অনেক ফিকহ বা ইলমের বাহক আছেন যিনি তা পৌঁছে দেন এমন ব্যক্তির কাছে যে কি না তার চেয়েও বড় ফিকহবিদ।’(16 )
ইলমের ফযীলত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের অভিমত:
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আরও বলেন,
لَمَوْتُ أَلْفِ عَابِدٍ قَائِمٍ اللَّيْلَ صَائِمٍ النَّهَارَ أَهْوَنُ مِنْ مَوْتِ الْعَاقِلِ الْبَصِيرِ بِحَلَالِ اللَّهِ وَحَرَامِهِ
‘রাত্রি জাগরণকারী এবং সাওম পালনকারী এক হাজার আবেদের মৃত্যুর চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার হালাল-হারামের জ্ঞান রাখা একজন আলেমের মৃত্যু অনেক বেশি ভারি।’(17 )
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর অভিমত:
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
فَاِنَّ الْعالِمَ اَفْضَلُ مِنَ الصَّآئِمِ الْقآئِمِ الْمُجاهِدِ فى سَبيلِ اللَّهِ ، وَ اِذا ماتَ الْعالِمُ ثَلُمَ فىِ الْأِسْلامِ ثُلْمَةٌ لا يَسُدُّها اِلاَّ خَلَفٌ مِنْهُ
‘একজন আলেম রোজাদার, তাহাজ্জুদের জন্য রাত্রি জাগরণকারী এবং আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদের চেয়ে উত্তম। যখন একজন আলেম মারা যান যখন ইসলামের গায়ে একটি ছিদ্র ও দাগ পড়ে। যা অপরজন তার স্থান পূরণ না করার আগ পর্যন্ত ভরাট হয় না।’(18 )
তিনি আরো বলেন,
الْعِلْمُ خَيْرٌ مِنَ الْمَالِ، الْعِلْمُ يَحْرُسُكَ، وَأَنْتَ تَحْرُسُ الْمَالَ، الْعِلْمُ يُكْسِبُ الْعَالِمَ الطَّاعَةَ فِي حَيَاتِهِ، وَجَمِيلَ الْأُحْدُوثَةِ بَعْدَ مَوْتِهِ، وَصَنِيعَةُ الْمَالِ تَزُولُ بِزَوَالِهِ. مَاتَ خُزَّانُ الْأَمْوَالِ وَهُمْ أَحْيَاءٌ،
‘ইলম সম্পদের চেয়ে উত্তম। কেননা ইলম তোমাকে পাহারা দেয় আর তুমি পাহারা দাও সম্পদকে। আলেম ব্যক্তির জীবনে ইলম নিয়ে আসে মানুষের আনুগত্য, আর মৃত্যুর পর তাকে সবাই উত্তমভাবে স্মরণ করে। আর মালের মালিক মারা গেলে মালও তার হাতছাড়া হয়ে যায়। বরং, মালের মালিকরা জীবিত হলেও মৃত থেকে যায়।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার অভিমত:
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,
خُيِّرَ سليمانُ بن داود عليهما السلام بيْن المالِ والمُلْكِ والعِلْمِ، فاختارَ العِلْمَ، فأُعطِيَ المُلْكَ والمالَ
‘হযরত সুলায়মান ইবন দাঊদ ‘আলাইহিমাস সালামকে ইলম, সম্পদ ও রাজত্ব- এই তিনটি বস্তুর যে কোনো একটি গ্রহণের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। তিনি ইলম এখতিয়ার করেছিলেন। কিন্তু এর বদৌলতে তাঁকে সম্পদ ও রাজত্বও দেয়া হয়েছিল।(19)
হযরত আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহ আনহু অভিমত
হযরত আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
قال أبو الدرداء رضي الله عنه لَأَنْ أَتَعَلَّمَ مَسْأَلَةً أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ قِيَامِ ليلة.
‘একটি মাসআলা শিক্ষা করা আমার দৃষ্টিতে ইবাদতের জন্য সারারাত জাগ্রত থাকার চেয়ে শ্রেয়।’(20 )
হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর অভিমত:
হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
قَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَلَيْكُمْ بِالْعِلْمِ قَبْلَ أَنْ يُرْفَعَ وَرَفْعُهُ مَوْتُ رُوَاتِهِ
‘ইলম উঠে যাওয়ার আগেই তা শিক্ষা কর। আর এর উঠে যাওয়ার অর্থ বর্ণনাকারীর মৃত্যু ঘটা।’ (21 )
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর অভিমত:
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, হযরত ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এবং আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন,
تذاكُرُ العلمِ بعضَ ليلة أحبُّ اليَّ من احيائها (22 )
‘রাতের কিছু অংশে ইলমের আলোচনা করা আমার কাছে সারারাত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার চেয়েও প্রিয়।’
হযরত হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দৃষ্টিতে ইলম:
হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
عَنْ هِشَامٍ ، عَنِ الْحَسَنِ قَالَ : كَانُوا يَقُولُونَ : مَوْتُ الْعَالِمِ ثُلْمَةٌ فِي الْإِسْلَامِ لَا يَسُدُّهَا شَيْءٌ مَا اخْتَلَفَ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ.
‘পূর্বসূরীগণ এই বিশ্বাস রাখেন, একজন আলেমের মৃত্যু ইসলামের দেহ ছিদ্র হয়ে যাওয়ার ন্যায়। দিনরাতের পরিবর্তন যা ভরাট করতে পারে না।’ (23 )
তিনি আরো বলতেন,
موتُ قبيلةٍ أيسرُ من موتِ عالمٍ( 24)
‘একটি গোত্রের সকলের মৃত্যু একজন আলেমের মৃত্যুর চেয়ে অনেক সহজ।’
হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে ইলমশূন্য মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর মতো। তিনি বলেন,
لولا العلماء لصار الناس مثل البهائم (25 ).
‘যদি ওলামায়ে কেরাম না থাকতেন তবে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর কাতারে নেমে যেত।’ অর্থাৎ মানুষ কেবল ইলমের কারণেই চতুষ্পদ জন্তুর কাতার থেকে মানুষের কাতারে উন্নীত হতে সক্ষম হয়।(26 )
ইমাম যুহরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দৃষ্টিতে ইলম:
বিখ্যাত তাবে‘ঈ ইমাম যুহরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন,
مَا عُبِدَ اللَّه بِشَيْءٍ أَفْضَلَ مِنْ العلم(27 )
‘ইলমের চেয়ে উত্তম কোনো ইবাদত নেই।’
সুফিয়ান ছাওরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দৃষ্টিতে ইলম:
হযরত সুফিয়ান ছাওরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন,
لا أعلم بعد النُّبوة أفضل من العلم ، لأن العالم هو وريث النبي صلى الله عليه وسلم(28 )
‘নবুওয়াতের মর্যাদার পর ইলমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। কেননা আলেম হচ্ছেন নবীর ওয়ারিছ। আর নবীগণ দিনার-দিরহামের ওয়ারিছ বানান না বরং তারা ইলমের ওয়ারিছ বানান।’
শায়খ আব্দুর রহমান ইবন সাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দৃষ্টিতে ইলম:
পূর্বসূরীগণ ইলমকে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় বলে আকীদা রাখতেন। শায়খ আব্দুর রহমান ইবন সাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
أن أهل السنة والجماعة يتقربون إلى الله – تعالى – بتوقير العلماء وتعظيم حُرمتهم
‘আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাত ওলামায়ে কেরামের সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করতেন।’
আহনফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দৃষ্টিতে ইলম:
আহনফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন,
كل عزٍّ لم يُؤَيَّد بعلم فإلى ذلٍّ مصيره
‘যে ইজ্জত ইলমকেন্দ্রিক নয়, তার শেষ পরিণতি লাঞ্ছনা।’(29 )
আবুল আছওয়াদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দৃষ্টিতে ইলম:
আবূল আছওয়াদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
وقَالَ أَبُو الْأسود الدؤلي رحمه الله : ” لَيْسَ شَيْء أعز من الْعلم ، وَذَلِكَ أَن الْمُلُوك حكام على النَّاس، وَالْعُلَمَاء حكام على الْمُلُوك “( 30)
‘ইলমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো বস্তু নেই। বাদশারা তো সাধারণ মানুষের শাসক কিন্তু আলেমগণ বাদশাহদের শাসক।’
দ্বীনি ইলমের চর্চা ও বিকাশের মাধ্যমেই সমাজে ইমান-আমল, আল্লাহভীতি ও আখিরাতমুখিতা সৃষ্টি হবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়া যেমন আল্লাহতায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আখিরাতের কামিয়াবি অর্জন করা যায় না, তেমনি দুনিয়ার জীবনেও দুর্নীতি, অনাচার, জুলুম ও শোষণ থেকে মুক্ত করা যায় না। এ জন্য আখিরাতে কামিয়াবি ও দুনিয়ায় শান্তি-নিরাপত্তার জন্য দ্বীনি ইলমের চর্চা অপরিহার্য।
নোট:
1. ইবন মাজাহ: ২২৪, সহীহ
হাদীছের ব্যাখ্যাকারীগণ লিখেছেন,
وبلا ريب لفظ (مسلم) يدخل فيه أيضا (المسلمة). أما الحديث الذي فيه زيادة (ومسلمة) فهي زيادة ضعيفة، وعموم اللفظ الأول يغني عن الضعيف
‘নিঃসন্দেহে মুসলিম مسلم (পুরুষ) শব্দটি المسلمة মুসলিমা (নারী) কেও শামিল করে। অর্থাৎ এই বিধান পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীর জন্য সমানহারে প্রযোজ্য। আর কোনো কোনো হাদীছে المسلمة শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে এটি দুর্বল তথা অপ্রয়োজনীয় সংযোজন। কেননা ‘মুসলিম’ শব্দটিই এটার প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে দেয়।’
2. ইবন মাজাহ: ২২৪
3. كشف الظنون – حاجي خليفة – ج ١ – الصفحة ١٩
4. তিরমিযী: ২৬৮৫
5. ইবন মাজা: ২২৭
6. বুখারী: ৭৩
7. বুখারী: ৭৩১২; মুসলিম: ২৪৩৯
8. মুসলিম: ২৬৯৯
9. মুসলিম: ২৬৯৯
10. ইবন মাজাহ: ২২৩
11. জামে তিরমিযী: ২৬৪৭
12. মুসলিম: ১৬৩১
13. ইবন মাজাহ্: ২৪২; সহীহ ইবন খুযাইমা: ২৪৯০
14. তিরমিযী: ২৩২২; ইবন মাজা: ৪১০২
15. মুসনাদ আবী ই‘আলা: ২/২৬০; জামে‘ সগীর: ৩৭৫৩ কানযুল উম্মাল: ২৮৭৩৭
16. ইবন মাজা: ২৩১
17. – الجامع في بيان العلم و فضله لابن عبد البر بَابُ تَفْضِيلِ الْعِلْمِ عَلَى الْعِبَادَةِ حديث رقم ১০৬
18. أبو حامد الغزالي: إحياء علوم الدين ১/৭.
19. – روضة الواعظين/١١ط الحيدرية أبو حامد الغزالي: إحياء علوم الدين ১/৮.
20. – إحياء علوم الدين المؤلف : الغزالي، أبو حامد الجزء : ১ صفحة : ৯
21. – إحياء علوم الدين المؤلف : الغزالي، أبو حامد الجزء : ১ صفحة : ৮
22. أخرجه معمر بن راشد في ্রجامعهগ্ধ (২০৪৬৯)، والبيهقي في ্রالمدخل إلى السنن الكبرىগ্ধ (৪৫৮)، وابن عبد البر في ্রجامع بيان العلم وفضلهগ্ধ (১০৭).
23. سنن الدارمي مقدمة بَابٌ فِي فَضْلِ الْعِلْمِ وَالْعَالِمِ [৩৪১]
24. أخرجه الطبراني وابن عبد البر من حديث أبي الدرداء، وأصل الحديث عند أبي الدرداء. إحياء علوم الدين/كتاب العلم/الباب الأول ৬
25. مختصر نصيحة أهل العلم(১৬৭). انظر جامع بيان العلم وفضله لابن عبد البر ১/৮২، المدخل إلى السنن الكبرى ৪৪৫
26. বস্তুত অন্য যাবতীয় মাখলুক থেকে মানুষের আলাদা হওয়ার অবশ্যই কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর সেই বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে ইলম। মানুষ তো এ কারণেই মানুষ হয়েছে। সে তার ব্যক্তিগত শক্তি-সামর্থের কারণে জন্তু-জানোয়ারের চেয়ে আলাদা ও মর্যাদাশীল নয়। যদি শারীরিক সামর্থ এবং কষ্ট সহিষ্ণুতার কারণে কেউ শ্রেষ্ঠ হতো উট সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো। কেননা উট প্রাণীকুলের মধ্যে সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু প্রাণী। শারীরিক কাঠামো ও বপুতার কারণেও মানুষ শ্রেষ্ঠ নয়। যদি তাই হতো তবে স্থলভাগের হাতি এবং পানির তিমি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো। বাহাদুরি ও বীরত্বের কারণেও কেউ শ্রেষ্ঠ নয়। যদি হতো তবে হিংস্র বাঘ সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো। খাওয়ার সামর্থের কারণেও কেউ শ্রেষ্ঠ নয়। যদি তাই হতো তবে গরু-মহিষ সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো। কেননা তাদের চেয়ে বড় পেট ও পেটুক কোনো প্রাণী নেই। সুতরাং অন্যান্য মাখলুকের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একটি মাপকাঠি আছে। আর নিঃসন্দেহে সেটা হচ্ছে ইলম।
27. حلية الأولياء وطبقات الأصفياء গ্ধ من الطبقة الأولى من التابعين গ্ধ الزهري গ্ধ العلم أفضل ما عبد الله به وفضل العلماء
28. إحياء علوم الدين/كتاب العلم/الباب السادس سير أعلام النبلاء: ৮/ ৩৮৭، بتصرف يسير
29. أبجد العلوم ১-৩ ج১
30. الحث على طلب العلم” (ص ৫৩) .