জুমার-খুৎবা

ইসলামে পবিত্র শবে বরাত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

১৪ শাবান|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|১৮ মার্চ’২২ 

 

ইসলামে পবিত্র শবে বরাত

 

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! ইসলামী বর্ষের ৮ম মাস পবিত্র শা’বান এর ১৫ তারিখের ফযীলতপূর্ণ মহিমান্বিত রজনীকে ইবাদত বন্দেগী জিকর আযকার তিলাওয়াত ও দরুদ শরীফ পাঠের মাধ্যমে উদযাপন করুন। মহান আল্লাহর নিয়ামত, রহমত ও বরকত লাভের এক তাৎপর্যপূর্ণ রজনী শবে বরাত। আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনে এ রাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব অসংখ্য হাদীস শরীফ, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও বুজুর্গানে দ্বীনের আমল দ্বারা সমর্থিত ও প্রমানিত।

পবিত্র কুরআনের আলোকে লায়লাতুল বরাত

পূণ্যময় রজনী লায়লাতুল বরাতের অস্তিত্ব পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা সমর্থিত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হা-মীম এর মমার্থ আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রজনীতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (সূরা: দুখান, আয়াত: ১-৪)

বর্ণিত আয়াতে করীমায় “লাইলাতিম মুবারাকা” এর তাফসীর প্রসঙ্গে অসংখ্য তাফসীরকারদের মতে এর দ্বারা শবে কদরের রাতকে বুঝানো হয়েছে, এটা যেমন সত্য, তেমনিভাবে হযরত ইকরামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুসহ একদল তাফসীরকারদের বর্ণনা মতে এর দ্বারা ১৫ শা’বানের রজনী তবে তথা শবে বারাতের রজনী উদ্দেশ্য। সুতরাং শবে বরাতের অস্তিত্ব অস্বীকার করা, এ রজনীর পুণ্যময় আমল থেকে মুসলিম উম্মাহকে বিরত রাখতে অপপ্রচার করা সম্পূর্ণরূপে সত্যকে গোপন করার নামান্তর। পক্ষান্তরে অসংখ্য হাদীসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার দায়ে অভিযুক্ত। বিশ্ব বরণ্য তাফসীরকার ও হাদীস বিশারদদের বর্ণনা ও এতদসংক্রান্ত অভিমত অস্বীকার করা তাদের প্রতি অসম্মান, অশ্রদ্ধা ও ধৃষ্টতার শামিল।

সূরা দুখান-এ উল্লেখিত “লায়লাতুল মুবারাকা” প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসীরকার আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী (র.)’র অভিমত-

তিনি একাধারে প্রখ্যাত তাফসীরকার, ফকীহ ও হাদীস বিশারদ দু’লক্ষ হাদীস শরীফ তাঁর মুখস্থ ছিল। ৮৪৯ হিজরিতে মিসরের সুয়ুতে তাঁর জন্ম। ৯১১ হিজরিতে তাঁর ইন্তিকাল। যিনি ছিলেন শতাব্দীর একজন মুজাদ্দিদ। তিনি এমন একজন সৌভাগ্যবান আশেকে রসূল ছিলেন। যিনি ৭৫ বার জাগ্রত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দিদার অর্জন করেছেন। যাঁর লিখিত কিতাবগুলো মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত ও সর্বজনগ্রাহ্য। তিনি তাফসীরে জালালাইন শরীফে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন, “আমি বরকতময় রাত্রিতে কুরআন অবতীর্ণ করেছি, সেটা হলো লায়লাতুল কদর কিংবা শা’বানের মধ্য রজনী। সেই রজনীতে মহাগ্রন্থ কুরআনুল করীম সপ্ত আসমান থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়। (তাফসীরে সূরা দুখান, পৃ: ৪১০)

হাদিস শরীফের আলোকে লায়লাতুল বরাত

হযরত আলী বিন আবি তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন শা’বান মাসের মধ্য রজনীর আগমন ঘটে তোমরা সেই রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করো এবং দিনের বেলায় রোজা পালন করো, কেননা আল্লাহ তা’আলা সেদিন সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে অবতরণ করেন। (তাঁর শান অনুযাযী) এবং বলেন আমার নিকট ক্ষমা প্রার্র্থনাকারী কী আছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব, কোন রিযক অনুসন্ধানকারী আছে কী? আমি তাকে রিযক দান করবো, কোন বিপদগ্রস্ত আছে কী? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব, এভাবে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করতে থাকেন। (ইবনে মাযাহ, হাদীস নং: ১৩৮৮)

হাদিসের তাৎপর্য

বর্ণিত হাদীস শরীফে “লাইলাতুন নিস্‌ফি মিন শা’বান” বা শা’বানের ১৫ তারিখ রজনীর ফযীলত আলোকপাত হয়েছে, উপমহাদেশে এ পূণ্যময় রজনীটি শবে বরাত নামে পরিচিত। যেমনিভাবে উপমহাদেশে নামায ও রোজা দ্বারা সালাত ও সিয়ামকেই বুঝানো হয়। ইসলামী শরীয়তে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এ রজনীটি বিভিন্ন নামে উল্লেখ হয়েছে। এর অস্তিত্ব পবিত্র কুরআনের আয়াত ও অসংখ্য হাদীস শরীফ, তাফসীরকার ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণের বর্ণনার আলোকে প্রমানিত।

শবে বরাতের বিভিন্ন নাম

পবিত্র কুরআনের ভাষায় এ রজনীর নাম লায়লাতুল মুবারাকা (বরকত রজনী)। হাদীস শরীফের ভাষায় “লায়লাতুন নিস্‌ফে মিন শা’বান” (১৫ শা’বান’র রজনী) এ ছাড়াও বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীর কুরতুবী প্রণেতা হযরত আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে আবু বকর আলে কুরতুবী (র.)’র বর্ণনা মতে এ রজনীর প্রসিদ্ধ চারটি নাম, ১. লায়লাতুল মুবারাকা (বরকতের রজনী), ২. লায়লাতুল বরাত (মুক্তির রজনী), ৩. লাইলাতুস্‌ ছক, ৪. লায়লাতুন নিস্‌ফে মিন শাবান। (তাফসীর কুরতুবী, খন্ড: ১ম, পৃ: ৯৯-১০৩)

লায়লাতুল বরাতে আল্লাহর ক্ষমা

গুনাহগার পাপী তাপী বান্দাদের গুনাহ ও অপরাধ কর্ম আল্লাহ তা’আলা বিশেষ বিশেষ দিন ও রজনীতে ক্ষমা করেন। এরশাদ হয়েছে, প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুয়ায বিন জাবল রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তা’আলা মধ্য শা’বানের রজনীতে তাঁর সমগ্র সৃষ্টি রাজির প্রতি আবির্ভূত হন। (কৃপাদৃষ্টি দেন) তিনি মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দিন (আল আওসাত, হাদীস, ২৭৬৭, ইমাম তাবরানী)

মুজতাহিদ ফকীহদের অভিমত

হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা ইবনু নুজাইম আল হানফী আল-মিসরী শবে বরাতের আমলের বৈধতা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন, রাত জেগে ইবাদত করা মুস্তাহাব। রমজান মাসের দশ রজনীতে, দুই ঈদের (ঈদুল ফিতর ঈদুল আযহা) রজনীতে জিলহজ্ব মাসের দশ রজনীতে, শা’বান মাসের মধ্য রজনীতে (বাহরুর রায়িক, খন্ড:২য়, পৃ: ৫২)

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, প্রণীত “তাফসীরে আদ দুররুল মনসুর” এ শবে বরাতের ফযীলত সংক্রান্ত পনেরটি হাদীস বর্ণনা করেছেন।

 

শবে বরাতের ইবাদত

হযরত মুয়াজ ইবনু জাবল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি পাঁচ রজনীতে রাত জেগে ইবাদত করবে তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হয়ে যাবে। পাঁচ রাত্রির এক রাত শবে বরাতের রজনী। (আততারগীব ওয়াত তারহীব, খন্ড: ২, পৃ: ৯৮, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৪র্থ, পৃ: ১০৫)

শবে বরাতে অধিকহারে নফল নামায পড়া, একশতবার দরুদ শরীফ পাঠ করা, একশতবার কলেমা শরীফ পাঠ করা, একশত বার এস্তেগফার করা, একশতবার “লাহাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ” পাঠ করে প্রার্থনা করবে দূঢ় বিশ্বাস রাখবে আল্লাহ তায়ালা দুআ কবুল করবেন। (আনোয়ারুল বয়ান, ২য় খন্ড, পৃ: ৫২৬)

দরুদ শরীফ পাঠের ফযীলত

দরুদ শরীফ তো এমন এক বরকতময় আমল ও সওয়াবের কাজ যা দিবারাত্রি আমলকারীকে আল্লাহ তা’আলা অফুরন্ত প্রতিদান নসীব করেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, সাহাবী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বণির্ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি একবার দরুদ শরীফ পাঠ করবে, তা কবুল করা হবে এবং আশি বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হবে। (ফাতওয়ায়ে শামী, খন্ড: ২য়, পৃ: ২৩২)

এ পবিত্র রজনীতে আল্লাহর দরবারে অধিক পরিমান দুআ করবে। আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের দুআ করবে। মাতা পিতার হায়াত বৃদ্ধি, রোগ ব্যাধির শেফার ও তাঁদের খিদমতের তাওফিক কামনা করে দুআ করবে, দুআর শুরুতে ও শেষে দরুদ শরীফ পাঠ করবে, দুরুদ শরীফের ওসীলায় আল্লাহ দুআ কবুল করবেন। তাফসীরে ইবনে কাছীরে উল্লেখ রয়েছে, তোমরা দুআর শুরুতে দুআর মধ্যেখানে ও দুআর শেষে আমার উপর দরুদ শরীফ পাঠ করো। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৫১৪)

দান সাদকা করা

ইসলামে অভাবগ্রস্ত, অসহায়, দরিদ্র, ফকীর, মিসকীন, নিঃস্ব, লোকদের দান সাদকা করা, একটি উত্তম আমল, অভাবীদের অভার দূর করা, বিপদ গ্রস্তদের সাহায্য করা, অপরিসীম সওয়াবের কাজ।

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, দান সাদকা গুনাহ নির্বাপিত করে, যেমনিভাবে পানি আগুন নির্বাপিত করে। (আবু ইয়ালা কর্তৃক সহীহ সনদে বর্ণিত) বর্তমান নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর যে উর্ধ্বগতি, এমন নাজুক সন্ধিক্ষণে অসহায় দুঃস্থ মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসা, সমাজের নিপীড়িত মানুষের প্রতি দানের হস্ত প্রসারিত করা, বিত্তবান ও সামর্থবান ব্যক্তিদের ঈমানী দায়িত্ব।

আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে লায়লাতুল বরাতের ইবাদত ও ফযীলত নসীব করুন! আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।