জীবনী

মুহাক্কিক আলেমেদ্বীন আল্লামা কাজী মুহাম্মদ জিয়াউদ্দীন খাকী (রহ.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী

লেখক – কাজী মুহাম্মদ জুনাইদ জাকী, তরুণ লেখক ও গবেষক

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনুল হাকিমে ইরশাদ করেন- انما يخشي الله من عباده العلماء অর্থাৎ “আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে তারাই ভয় করে, যারা জ্ঞানসম্পম্ন”। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “العلماء ورثة الانبياء” অর্থাৎ “আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিস তথা উত্তরাধিকারী।” একজন সত্যিকারের নায়েবে রাসুল নিঃসন্দেহে আপন সময়ে সম্মানিত ও আল্লাহ তাআলার নেক বান্দা হয়ে থাকেন। তেমনই একজন ব্যক্তিত্ব হলেন ওস্তাজুল আসাতেজা হযরাতুল আল্লামা মাওলানা কাজী মুহাম্মদ জিয়াউদ্দীন খাকী (রহ.)। যিনি একাধারে মুহাক্কিক আলেমেদ্বীন, তাকওয়াবান, পরহেজগার ও দুনিয়াবিমূখ আলেমেদ্বীন ছিলেন।

জন্ম

তিনি তৎকালীন পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ) কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের পশ্চিম এলাহাবাদ গ্রামে প্রখ্যাত খন্দকার বংশে মরহুম মাওলানা হাফেজ ওবাইদুল করিম এবং মহীয়সী মা আজিমা খাতুনের কোল ধন্য করে ১৯৩৬ সালের ১০ই অক্টোবর (জন্ম সনদ অনুযায়ী) পৃথিবীর বুকে আগমন করেছিলেন। তবে তাঁর আসল জন্ম সাল আরো বছর পাঁচেক পূর্বে। তাঁর পিতা ছিলেন খুব ভালো হাফেজে কুরআন ও বুযুর্গ ব্যক্তি। তাঁর মাতাও পরহেজগার মহিলা ছিলেন। তাঁর বংশের পূর্বপুরুষ হযরত কাজী আবদুল্লাহ (রহ.), কাজী মিন্নাতুল্লাহ (রহ.), কাজী সানাউল্লাহ (রহ.) এবং তাঁর জেঠা মাওলানা কাজী খলিলুর রহমান (রহ.) ছিলেন মুহাক্কিক ও বুযুর্গ আলেমেদ্বীন।

 

শিক্ষাজীবন

 

তিনি ইলমে দ্বীন হাসিলের উদ্দেশ্যে তৎকালীন সুপ্রসিদ্ধ দ্বীনি ইলমের মারকাজ পটিয়াস্হ শাঁহচান্দ আউলিয়া কামিল মাদরাসা থেকে দাখিল, দারুল উলুম কামিল মাদরাসা থেকে আলিম, গারাঙ্গিয়া আলিয়া মাদরাসা থেকে ফাযিল, ওয়াজেদীয়া আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল (টাইটেল) কৃতিত্বের সাথে শেষ করেন। দ্বীনি ইলম অর্জনের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুদাক্কিক ও মুহাক্কিক আলেমেদ্বীন। তাই ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের মাঝে সমান জনপ্রিয় ছিলেন।

বিবাহ

তিনি চন্দনাইশের গাছবাড়ীয়ার সৈয়দ বাড়ীস্হ (কলঘর) সৈয়্যদ আব্দুল ওদুদ ও সৈয়্যদা তফুরা খাতুনের কন্যা সৈয়্যদা মুবিনা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের ঔরষে তিন মেয়ে শাকেরা পারভীন, আরেফা সুলতানা, নারগীস সুলতানা (জীবিত) জন্মলাভ করেছে। উনার কোনো পুত্র সন্তান ছিলেন না বিধায় সর্বকনিষ্ঠ কন্যা নারগীস সুলতানাকে নিজের আদরের মেধাবী ছাত্র আলেমে-দ্বীন মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান কাদেরীর সাথে বিবাহ দিয়ে মেয়ের জামাই করে নেন।

 

কর্মজীবন

 

তিনি দ্বীনি ইলম অর্জন শেষে সর্বপ্রথম চন্দনাইশের হাশিমপুরস্হ মকবুলিয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসায় শিক্ষকতা (খন্ডকালীন) করেছিলেন। এরপর আপন ওস্তাদ আওলাদে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বড় হুযুর কিবলাহ মুফতী সায়্যিদ আহমদ কবির আজিজী নকশবন্দি (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গুরা সিনিয়র আলিম মাদরাসায় সুদীর্ঘ ৪০ বছরেরও অধিক সময়কাল ধরে ইলমে-দ্বীনের খিদমত করেছিলেন। তিনি এই মাদরাসা থেকে রিটায়ার্ড হওয়ার পরেও বিভিন্ন মাদরাসায় খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেছিলেন। তার মধ্যে আহসানুল উলুম গাউছিয়া কামিল মাদরাসা, বুড়িশ্চর জিয়াউল উলুম ফাযিল মাদরাসা, খিতাবচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদরাসা, হযরত শাহগদী (রহ.) দাখিল মাদরাসা, হযরত ইয়াছিন আউলিয়া (রহ.) দাখিল মাদরাসা অন্যতম।

এ সকল প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রধানত মিজান, মুনশায়িব, উর্দু কি পহেলী কিতাব, উর্দু কি দোসরী কিতাব, চেহেল ছবক, ফার্সি কি পহেলী কিতাব, শরহে মিয়াতে আমেল, পাঞ্জেগঞ্জ, ফুসুলে আকবরী, হেদায়াতুন্নাহু, উসুলুশ শাশী, নুরুল আনওয়ার, শরহে বেকায়াহ তথা ইলমেদ্বীন অর্জনের প্রধান কিতাবসমূহ পাঠদান করেছিলেন। তিনি খুবই মুদাক্কিক আলেম ছিলেন বিধায় ছাত্রদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তিনি পাঠদান ছাড়াও সবসময় ইলমি কথাবার্তা বলতেন। ছাত্রদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইলমি তথ্য জিজ্ঞাসা করতেন। ছাত্ররা অবগত না হলে জানিয়ে দিতেন। তিনি হাস্যরসাত্মকও ছিলেন বটে৷ তাঁর শব্দভান্ডার এত বেশি আয়ত্তে ছিলো যে, উপস্থিত ক্ষেত্রেই কবিতার লাইন তৈরি করে সবার সামনে উপস্থাপন করতেন।

 

বায়’আত

 

তিনি তরীকায়ে নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়ার অন্যতম শায়খ পীরে তরীকত হযরত শাহসুফী মাসুম শাহ খুলনবী নকশবন্দী (রহ.)-এর দস্ত মুবারকে তরীকায়ে নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়ার বায়আত গ্রহণ করেন। তিনি ফানা-ফিশ শাইখ ছিলেন।

শিক্ষকবৃন্দ

ছাত্রজীবনে তাঁর অসংখ্য ওস্তাগণের মধ্যে কয়েকজনের নাম হলো- বড় হুযুর কিবলাহ মুফতী সায়্যিদ আহমদ কবির আজিজী নকশবন্দি (রহ.), গারাঙ্গিয়ার বড় হুযুর শাহসুফী আব্দুল মজিদ শাহ (রহ.), গারাঙ্গিয়ার ছোট হুযুর শাহসুফী আব্দুল রশিদ শাহ (রহ.), ওস্তাজুল মুহাদ্দিসীন আল্লামা আমিন (রহ.), শায়খুল হাদীস মুহাদ্দিস আল্লামা আবুল ফসীহ মুহাম্মদ ফোরকান (রহ.) প্রমূখ।

 

ছাত্রবৃন্দ

 

উনার হাজার-হাজার ছাত্রবৃন্দ রয়েছে যারা দেশ-বিদেশে ইলমে-দ্বীনের খেদমত, পীরানে তরীকত এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- পীরে তরীকত এ.জেড.এম. সেহাব উদ্দীন খালেদ (রহ.), পীরে তরীকত আবদুশ শাকুর রায়হান আজিজি নকশবন্দী, পীরে তরীকত আল্লামা আবুল কাশেম নুরী, পীরে তরীকত অধ্যক্ষ আবদুর রহিম আলকাদেরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া ১৫), অধ্যক্ষ এস.এম. ফরীদ উদ্দীন, অধ্যক্ষ কারী মাওলানা আবু তৈয়্যব, অধ্যক্ষ আল্লামা খলিলুর রহমান নিজামী, অধ্যক্ষ আল্লামা সায়্যিদ মুহাম্মদ সাজেদ উল্লাহ আজিজি, আল্লামা ওহিদুল আলম নকশবন্দী, অধ্যক্ষ আল্লামা আবদুছ ছবুর চৌধুরী, উপাধ্যক্ষ আল্লামা আব্দুল মালেক নুরী (রহ.), অধ্যাপক আল্লামা নুরুল ইসলাম জোহাদী, উপাধ্যক্ষ কাজী আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ ওবাইদুল করিম, অধ্যক্ষ আল্লামা আব্দুর রহিম আল-কাদেরী, অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম ছমদী (রহ.), অধ্যক্ষ কাজী আনোয়ারুল ইসলাম খান (রহ.), মুহাদ্দিস আল্লামা শাহ আলাউদ্দিন (রহ.), সহ আরো অনেকে।

তাকওয়া ও পরহেজগারিতা

তিনি খুবই ওয়াক্ত মুতাবিক নামাজের পাবন্দী ছিলেন। নামাজের ওয়াক্ত ছুটে গেলে ছটফট করতেন। তাঁর তাকওয়া ও পরহেজগারিতা ছিলো সর্বজনস্বীকৃত। তিনি এতই তাকওয়াবান ছিলেন যে, নিজে নামাজে ইমামতি করতে ভয় পেতেন। তাই প্রায় সময় ছাত্রকে দিয়ে ইমামতি করাতেন। যেমনিভাবে তিনি ছিলেন একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমেদ্বীন তেমনিভাবে ছিলেন মুত্তাকী।

 

আশেকে রাসুল

 

তিনি অদ্বিতীয় আশেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন। শেষ বয়সে যখন ঘরে অবস্হানরত ছিলেন, তখন তার নাতিদের নিয়ে “নাগমায়ে হাবিব”, “নাগমায়ে মাহবুব” থেকে নাতে মুস্তাফা পরিবেশন করতেন। অনেক সময় এলাকার মসজিদে খতমে গাউসিয়া শরীফ কিংবা খতমে খাজেগান শরীফে শরীক হতে না পারলেও সালাতু-সালাম দেয়ার সময় মাইকের আওয়াজ শুনার সাথে সাথে ঘরের পালংকয়ের উপর দাঁড়িয়ে যেতেন। অতঃপর রাসুলে কারিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’কে সালামি পেশ করতেন। তিনি আলা হযরত (রহ.) ও ইমাম শেরে বাংলা (রহ.)-এর কথা প্রায়ই তুলে ধরতেন। তিনি নিজেও ইমাম শেরে বাংলা (রহ.) -এর বিভিন্ন মজলিসে বসেছিলেন।

নামের সাথে “খাকী” যুক্ত করার কারণ

এই মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন দুনিয়াবিমূখ আলেমেদ্বীন। তাঁর অন্তরে দুনিয়ার লোভ-লালসা ছিলো না। তিনি সহজ-সরল জীবনযাপন করে ছিলেন। “খাকী” শব্দের প্রধান অর্থ হলো- মেটে রংঙের, মাঠি থেকে প্রস্তুত, মাঠির সাথে সম্পৃক্ত। তাঁর সম্পূর্ণ জীবনযাপন বিশ্লেষণ করে বুঝা যায়, তিনি আসলেই সবদিক থেকে “খাকী” ছিলেন। মাটির মানুষ হয়ে তাঁর মধ্যে ছিল না অহংকারের লেশ। ছিলো না কারো সাথে দ্বেষ। পারিবারিক সূত্র মতে, এই উপাধি টা উনাকে ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাযী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) দিয়েছিলেন।

 

ইন্তেকাল

 

এই মহান আলেমেদ্বীন ২০১৪ সালের ৮ই আগস্ট (১১ই শাওয়াল) রোজ জুমাবার জুমার নামাজের আযানের সাথে সাথে ইহকাল ত্যাগ করে মহান রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। উনার জানাযা ওইদিন বাদে এশা পশ্চিম এলাহাবাদ আহমদিয়া সুন্নিয়া ফাযিল মাদরাসার ময়দানে উনারই মেয়ের জামাই ও ছাত্র মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান কাদেরীর ইমামতিতে অনুষ্ঠিত হয়৷ এতে উনার ছাত্রবৃন্দ, সাংসদ, শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসীসহ সকলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, তিনি নিজেই তাঁর কবরে জীবিত থাকাকালীন জিয়ারত করেছিলেন এবং নিজের ছোট মেয়ের জামাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই জায়গাতেই যেন উনাকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে তাঁর নির্দেশ মোতাবেক সেই জায়গাতেই (নিজস্ব জায়গা) তাঁকে দাফন করা হয়েছিলো। আল্লাহ তাআলা উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের আলা মকাম দান করুক!