খলিফাতু রাসূলিল্লাহ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র জীবন ও কর্ম
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র পরিচিতি
হযরত আবু বকর (রা.)’র প্রকৃত নাম: আবদুল্লাহ, তাঁর উপনাম আবু বকর, তাঁর উপাধি হলো সিদ্দিক ও আতীক, সিদ্দিক অর্থ মহাসত্যবাদী, মিরাজের বিস্ময়কর ঘটনা রাসূলুল্লাহর নূরানী মুখে শুনামাত্রই বিনা দ্বিধায় মানপ্রাণে সত্য বলে বিশ্বাস করায় সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত হলেন। (আল–ইসাবাহ, ৪/১৪৪)
আতীক অর্থ মুক্তি প্রাপ্ত ব্যক্তি, এটি ছিল রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত উপাধি, একদা নবীজি তাঁকে বলেছিলেন, তুমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রাপ্ত ব্যক্তি ঐ সময় থেকে আতীক নামকরণ হয়। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং: ৩৬১২)
জন্ম
তাঁর বংশধারা পিতা–মাতা উভয়ের দিক দিয়ে উর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়েছে। হযরত আবু বকর হস্তি সনের ঘটনার দু’বৎসর ছয় মাস পর ৫৭৩ খ্রি. মক্কা মুকাররমায় জন্ম গ্রহণ করেন। (ইমাম সূয়ুতী, তারীখুল খুলাফা, পৃ: ২১, আনোয়ারুল বয়ান, খণ্ড:১, পৃ: ১৫১)
হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.) বর্ণনা করেন, পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। কিশোরদের মধ্যে হযরত আলী (রা.) সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম উম্মুল মু’মেনীন খাদীজাতুল কুবরা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। (তারিখুল খুলাফা, পৃ: ২৬, আনোয়ারুল বয়ান, ২য় খন্ড, পৃ: ১৫৩)
ইসলাম গ্রহণের ঘটনা
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এক কাফেলার সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন, রাত হয়ে গেল। কাফেলা একটি গীর্জার সন্নিকট গিয়ে পৌছল সকলে ক্লান্ত, নিদ্রা গেল, হযরত আবু বকরও নিদ্রায় বিভোর। স্বপ্নে দেখলেন একটি চন্দ্র তাঁর কোলে এসে পড়েছে। গীর্জার পাদ্রীর নিকট স্বপ্নের কথা বর্ণনা করেন, বুখাইরা পাদ্রী হযরত আবু বকরকে নাম ও ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন, তিনি জবাব দিলেন নাম আবু বকর, জন্মস্থান মক্কা, ক্বোরায়াশ বংশের, বুখাইরা পাদ্রী স্বপ্নের ব্যখ্যায় বললেন, সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার ক্বোরায়শ বংশে ও আপনার জন্মস্থানে মক্কায় প্রেরিত হবেন। এবং আপনি জীবদ্দশায় সেই আখেরী নবীর ওযীর হবেন এবং নবীর ইন্তেকাল পরবর্তী খলিফা হবেন। তিনি যখন মক্কা থেকে হিজরতের সময় সওর পর্বতে অবস্থান কালে আপনার ক্রোড়ে সেই নবীর মাথা মুবারক রাখবেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে তিনি মক্কার হেরমে পৌছলেন, নবীজির খিদমতে হাজির হলেন, আবেদন করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে কলেমা শরীফ পাঠ করান, কলেমা পড়ে মুসলমান হলেন, ইসলাম গ্রহণের পর নবীজির খিদমতে আরজ করলেন যিনি নবী হন তিনি তো মুজিয়া প্রাপ্ত হন, আমার ঈমানের দৃঢ়তা ও অন্তরের প্রশান্তির জন্য আমাকে মুজিযা দেখিয়ে দিন। সরকারে দোআলম নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেছেন, সেথায় রাতযাপন করা, নিদ্রায় স্বপ্ন দেখা, বুখাইরা পাদ্রীর নিকট স্বপ্নের বর্ণনা দেওয়া, পাদ্রী কর্তৃক স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলা সেটা কি আমার মুজিযা নয়? (নুজহাতুল মাজালিস, পৃ: ২৫৪, আনোয়ারুল বয়ান, ২য় খন্ড, পৃ: ১৫৪)
বিনা দ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ
মুহাম্মদ বিন ইসহাক বলেন, মুহাম্মদ বিন আবদুর রহমান তামিমী বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, সে কিছুনা কিছু দ্বিধা ও সংশয় প্রকাশ করেছে এবং চিন্তা ভাবনা করেছে কিন্তু আবু বকর (রা.) কে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা মাত্রই ইসলাম কবুল করে নিয়েছে এতে কোন প্রকার সংশয় প্রকাশ করেনি। (বায়হাকী, দালায়িলুন নবুওয়াত, হাদীস নং: ৪৬৯, তারিখুল খুলাফা, পৃ: ২৭)
মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যারা স্বীয় ধন–সম্পদ ব্যয় করে রাত্রে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে তাদের জন্য তাদের সওয়াব রয়েছে, তাদের পালন কর্তার কাছে। তাদের কোন আশঙ্খা নেই এবং তারা চিন্তিতও হবেনা। (সূরা: আল বাক্বারা, আয়াত: ২৭৪)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক ইসলাম গ্রহণকালে তাঁর নিকট চল্লিশ হাজার দিরহাম মজুদ ছিল, ঈমান গ্রহণের পর তাঁর সমুদয় সম্পদ আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেন, দশহাজার রাতে, দশহাজার দিনে, দশ হাজার গোপনে, দশ হাজার প্রকাশ্যে আল্লাহর পথে অকাতরে বিলিয়ে দেন। তাঁর এ অনন্য ত্যাগ ও কুরবানীর উপর সন্তুষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সে সব গোলামদের কে খরিদ করে আযাদ করে দিয়েছিলেন, যারা ইসলাম গ্রহণের কারণে কাফিরদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতো। হযরত ওরওয়া ইবনে যুবাইর (রা.) বর্ণনা করেন, আমার জানামতে হযরত আবু বকর (রা.) সেই সাত জন গোলামদের খরিদ করে মুক্তি করে দিয়েছিলেন, যাদেরকে ইসলাম গ্রহণের কারনে আমানষিকভাবে নির্যাতন করতো, তাঁর এ অসামান্য অবদান ও অনন্য কীর্তির প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “অচিরেই খোদাভীরু ব্যক্তিকে তা (জাহান্নাম) থেকে দূরে রাখা হবে। যে আত্বশুদ্ধির জন্য তার ধন–সম্পদ দান করে তার ওপর কারো কোন প্রতিদান যোগ্য অনুগ্রহ নেই। তাঁর মহান প্রভূর সন্তুষ্টি অন্বেষন ছাড়া সে সত্বরই সন্তুষ্টি লাভ করবে। (আল কুরআন, ৯২ সূরা: আল–লায়ল, আয়াত: ১৭–২১)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এমন অসংখ্য গোলামদের কাফিরদের থেকে খরিদ করে আযাদ করে দিয়েছেন, যাদের অধিকাংশ ছিল অসহায়, দূর্বল ও নির্যাতিত। তাদের অন্যতম হযরত বিলাল হাবশী (রা.)। এক বর্ণনায় রয়েছে ৪০ উকিয়া স্বর্ণের বিনিময়ে হযরত বিলাল (রা.) খরিদ করে ছিলেন। এতে কাফিররা মন্তব্যে করেছিল আবু বকরের উপর নিশ্চয় বিলালের কোন অবদান ছিল। যার প্রতিদান দিতে গিয়ে তিনি এতো অধিকমূল্যে বিলালকে খরিদ করে আযাদ করে দিলেন। কাফিরদের উক্তির প্রতিবাদে আল্লাহ তা’আলা উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন। পার্থিব কোন স্বার্থ কিংবা উপকারিতা অর্জন নয় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই হযরত আবু বকর (রা.) ‘হযরত বিলাল (রা.)’কে আযাদ করেছিলেন, মহান আল্লাহ তা’আলা বর্ণিত আয়াতে এ প্রকৃত সত্য তুলে ধরেছেন।
হাদীসের আলোকে হযরত আবু বকর (রা.)’র মর্যাদা
নবী রাসূলগণের পর সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম মানব খলিফাতুল মুসলেমীন, হিজরতের সাথী, নবীজির অদ্বিতীয় আশেক হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে বললেন, ওহে আবু বকর শুনো! আমার উম্মতের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৫৬)
ইসলামের জন্য তাঁর বহুমূখী অবদান বদান্যতা ও দানশীলতা ছিল অতুলনীয়। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না। নবীজি এরশাদ করেছেন, “আবু বকরের ধন–সম্পদে আমার যে পরিমান উপকার হয়েছে অন্য কারো ধন–সম্পদ আমার অনুরূপ উপকার হয়নি। (তিরমিযী শরীফ, খন্ড: ২, পৃ: ২০৭, মিশকাত, পৃ: ৫৫৪, কানযুল উম্মাল, খন্ড: ৬ষ্ঠ, পৃ: ৩১৬)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র নিকট তিনটি জিনিস অধিক প্রিয়
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য:
হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) অসাধারণ গুণাবলী ও বৈশিষ্টের অধিকারী ছিলেন। ইসলামের জন্য তাঁর বহুমাত্রিক অবদানের নিরিখে মুসলিম মনীষী ও ঐতিহাসিকগণ তাঁকে ইসলামের ত্রাণকর্তা অভিধায় ভূষিত করেন। তাঁর জীবন ও কর্ম ইসলামের ইতিহাসের সুবিশাল এক বিস্তৃত অধ্যায়।
১। তিনিই সর্বপ্রথম মুসলমান।
৩| তিনিই প্রথম কাফির মুশরিকদের সাথে জিহাদ করেন।
৫। তিনিই উম্মতের সর্বপ্রথম ইমাম।
৭। উম্মতের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম জান্নাতে যাবেন।
ওফাত
১৩ হিজরির ২২ জমাদিউস সানি, ৬৩ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর খিলাফত কাল ছিল দু বছর তিন মাস দশ দিন। মতান্তরে দু বছর তিন মাস ছাব্বিশ দিন। হযরত ওমর (রা.) তাঁর জানাযার নামাযে ইমামত করেন। রাহমাতুল্লীল আলামীনের পাশেই খলীফাতু রাসূলিল্লাহ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় রাসূলের প্রিয় সাহাবীর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন।