জীবনী

ইমাম আবু দাউদ (রহঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

আহমদ শাহ আদীল

 

ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) ইলমে হাদিসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। হাদিসশাস্ত্রে অবদানের জন্য যারা স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি তাঁদের অন্যতম। তিনি একজন ইমাম, হাফিয,শায়খুস সুন্নাহ ও উচ্চ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন ব্যক্তি।

জন্ম ও বংশ :

তাঁর নাম সুলায়মান, কুনিয়াত আবু দাউদ। পিতার নাম-আশাআস। তাঁর পুরো নাম বংশতালিকা হলো সুলাইমান ইবনে আশআস ইবনে ইসহাক ইবনে বুশাইর ইবনে সাদ্দাদ ইবনে আমর ইবনে ইমরান আল আযদি আস সিজিস্তানি। জানা যায়, তাঁর ঊর্ধ্বতম পুরুষ ইমরান, যিনি হজরত আলী (রা.)-এর সঙ্গী হয়ে সিফফিনের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। ইমাম আবু দাউদ ২০২ হিজরী মোতাবেক ৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে কান্দাহার ও চিশতের নিকটবর্তী সিজিস্তানে জন্ম গ্রহণ করেন।

শিক্ষা জীবন :

তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে বলা যায়, ইসলামী সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার সোনালি যুগে জন্ম হওয়ায় শৈশবেই তিনি তাঁর সিজিস্তান শহরের প্রখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিসদের পরশ পেয়েছিলেন। তাঁদের মাধ্যমেই অতিক্রম করেন তাঁর উচ্চশিখরে পৌঁছার প্রাথমিক ধাপগুলো। ইমাম আবু দাউদের বয়স যখন দশ বছর তখন তিনি নিশাপুরের একটি মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সেখানেই তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনু আসলামের নিকট হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

জ্ঞান অন্বেষণে বিদেশ গমন :

হাদিসের জ্ঞান অর্জনের তীব্র পিপাসা নিয়ে ঘুরে ফিরেছেন দেশ-বিদেশ ও শহর-নগরে। মক্কা, বাগদাদ, বসরা, কুফা, মিসর, আলজেরিয়া, তারসুস, রায়, হেরাত, খুরাসানসহ অসংখ্য ইসলামী শহর-নগরের যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের হাদিসভাণ্ডার থেকে হাদিস আহরণ করেছেন ব্যাপক হারে।

চরিত্র :
ইমাম আবু দাউদ ছিলেন ইবাদাতগুযার, পরহেযগার, যাহিদ ও ন্যায়পরায়ণ লোক। দুনিয়ার ভোগ বিলাসের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না। ইমাম ইবনু দাসাহ উল্লেখ করেন যে, ইমাম আবু দাউদের জামার একটি হাতা প্রশস্ত ও একটি হাত সংকৃর্ণ ছিল। এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, যে হাতাটি প্রশস্ত তার মধ্যে আমি লিখিত হাদীসগুলো রেখে দেই এবং যে সংকৃর্ণ হাতার মধ্যে এ জাতীয় কিছুই নেই।তাঁর সম্পর্কে একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে যে, ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-এর শহরের তৎকালীন শাসক আমির আবু আহমদ আল মুওয়াফফাক তাঁর কাছে আবেদন করেছিলেন, তিনি যেন খলিফার ছেলেদের সম্মানার্থে তাঁদের জন্য আলাদা একটি হাদিসের মজলিশ কায়েম করেন, যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার থাকবে না। শুধু খলিফা পুত্রদেরই হাদিসের পাঠ দান করা হবে। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) তা জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, কখনো নয়! শিক্ষার্জনে সবারই সমান অধিকার রয়েছে, চাই সে রাজপুত্র হোক বা প্রজাপুত্র।

অসাধারণ মেধা ও প্রখরতা :

তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও মেধার তীক্ষ্মনতার দরুন কৈশোর থেকেই সঙ্গীদের মধ্যে হাকিম (অর্থাৎ প্রজ্ঞাবান) -এর খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রাসুল (দ:) থেকে বর্ণিত সূত্রের দীর্ঘ ধারাবাহিকতাসহ পাঁচ লাখেরও বেশি হাদিসের হাফেজ ছিলেন। আর অজস্র অগণিত বর্ণনাকারীর নাম ও বংশপরম্পরাসহ তাঁর জীবনবৃত্তান্ত, প্রত্যেকের পার্থক্যসহ মুখস্থ করা ছিল তাঁর বিশাল ও অসাধারণ কৃতিত্বের একটি। এ ছাড়াও তিনি ইলমুল ফিকহসহ ইসলামী ইলম ও জ্ঞানের সব শাখায়ই ছিল তাঁর নেতৃত্বসুলভ অবস্থান।

মাজহাবের অনুসরণ :

ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-এর ন্যায় যুগশ্রেষ্ঠ হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রের ইমাম চাইলে কোনো মাজহাব অনুসরণ না করে নিজেই সরাসরি হাদিস-কোরআনের ওপর আমল করতে পারতেন। তা সত্ত্বেও শরিয়ত পালনার্থে মাজহাব মানার সীমাহীন গুরুত্ব বিবেচনা করে তাঁর মতো একজন যুগশ্রেষ্ঠ ইমামও তাঁর শিক্ষক প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর মাজহাবের অনুসরণ করেছেন বলে তাঁর জীবনী রচয়িতা উল্লেখ করেছেন।

ইমাম আবু দাউদ (রহ:) সম্পর্কে মন্তব্য :

১। মূসা ইবনু হারুন বলেনঃ

ইমাম আবু দাউদ দুনিয়াতে হাদীসের খিদমাতের জন্য এবং অখিরাতে জান্নাত লাভের জন্য সৃষ্টি হয়েছেন।আমি তাঁর থেকে উত্তম ব্যক্তি দেখিনি ।

২। ইমাম হাকিম বলেনঃ
নিঃসন্দেহে ইমাম আবু দাউদ তাঁর সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাঁর এই শ্রেষ্ঠত্ব ছি নিরংকুশ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী ।

৩। ইমাম যাহাবী বলেনঃ
ইমাম আবু দাউদ হাদীসের ইমাম হওয়ার পাশাপাশি একজন বড় মাপের ফক্বীহ ছিলেন। তাঁর কিতাবই এর
প্রমাণ বহণ করে।

৪। হাফিয আবু আবদুল্লাহ ইবনু মানদাহ বলেন,

যাঁরা হাদীস বর্ণনা করে তন্মধ্যকার দোষযুক্ত হাদীসগুলো থেকে প্রমাণযোগ্য হাদীসগুলোকে এবং ভুল থেকে শুদ্ধকে পৃথক করেছেন, তাঁরা হচ্ছেন চারজনঃ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসায়ী।

৫। ইবরাহীম ইবনু ইসহাক্ব বলেনঃ
ইমাম আবু দাউদের জন্য হাদীসকে নরম ও সহজ করে দেয়া হয়েছিল ঠিক যেমনিভাবে নরম ও সহজ করে
দেয়া হয়েছিল দাউদ (আ:) নবীর জন্য লৌহকে ।

৬। মাসলামাহ ইবনু ক্বানিম বলেনঃ
আবু দাউদ ছিলেন নির্ভরযোগ্য, যাহিদ, হাদীস সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং এ বিষয়ে তাঁর যুগের ইমাম।

৭। আর-রাযী বলেনঃ
আমি তাঁকে বাগদাদে দেখেছি। তিনি আমার পিতার কাছে আসতেন। তিনি একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন।

৮। ঐতিহাসিক ইবনু তাগরিদী বলেনঃ তিনি ছিলেন হাদীসের হাফিয, সমালোচক, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ক্রটি সম্পর্কে অবহিত আল্লাহভীরু এক মহান ব্যক্তি।

তাঁর শিক্ষকগণ :
বিভিন্ন দেশ-বিদেশ ও শহরে ইমাম আবু দাউদ (রহ:) এর শিক্ষকের সংখ্যা অসংখ্য। তিনি উঁচু মাপের বহু মুহাদ্দিসের কাছে হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও শ্রবণ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন-
১| মাক্বাহতে কা’নাবী,

২|সুলায়মান ইবনু হারব,
৩| বাসরাহয় মুসলিম ইবনু ইবরাহীম,

৪|‘আবদুল্লাহ ইবনু রাজা,

৫| আবুল ওয়ালীদ তায়ালিসি,

৬|মূসা ইবনু ইসমাঈল ও তাঁদের সমপর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ
হতে।
৭| কূফা শহরে হাসান ইবনু রবীঈ বুরানী,
৮|আহমাদ ইবনু ইউনূস ও একটি দল হতে,
৯| হালবে আবু তাওবাহ আর-রাবী’ ইবনু নাফি,
১০|বাহরাইনে আবু জা’ফার নুফাইলী,
১১| আহমাদ ইবনু আবু শু’আইব ও আরো অনেকের কাছ থেকে।
১২|হিমসে হাইওয়াতাহ ইবনু শুরাইহ।
১৩|ইয়াযীদ ইবনু ‘আবদে রাব্বী।
১৪|দামিস্কে সাফওয়ান ইবনু সালিহ ও হিশাম ইবনু আম্মার হতে,
১৫| খুরাসানে ইসহাক্ব ইবনু রাহওয়াইহি ও তাঁর সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের থেকে,
১৬|বাগদাদে আহমাদ ইবনু হাম্বাল ও তাঁর
সমপর্যায়ের মুহাদ্দিস হতে,
১৭|বালখাতে কুতাইবাহ ইবনু সাবীদ হতে,
১৮| মিসরে আহমাদ ইবনু সালিহ ও অন্যদের থেকে।
১৯| ইবরাহীম ইবনু বাশমার,
২০| ইবরাহীম ইবনু মূসা আর-অপররা,
২১|আলী ইবনুল মাদীনী,
২২|হাকাম ইবনু মূসা,
২৩|সাঈদ ইবনু মানসূর,
২৪|সাহল ইবনু বাক্কার,
২৫|‘আবদুর রহমান ইবনুল মুবারক আবু-আয়শী,
২৬|আবদুস সারাম ইবনু মুত্ত্বাহহার,
২৭|মুহাম্মদ ইবনু কাসীর,
২৮|মু’আয ইবনু আসাদ,
২৯|আলী ইবনুল জা’দ,
৩০|খালফ ইবনু হিশাম,
৩১|আমর ইবনু ‘আওন,
৩২|ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও অন্যান্য ইমামগণ।

ছাত্রবৃন্দ :
ইমাম আবু দাউদের ছাত্র সংখ্যাও অসংখ্য। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-
১|ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী,
২|ইমাম আন-নাসায়ী,
৩|আবু আওয়ানাহ,
৪|আবু হামিদ আহমাদ ইবনু জাফার আশ’আরী আসবাহানী,
৫|আবূ ‘আমর আহমাদ ইবনু আলী ইবনু হাসান বাসরী,
৬|আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ খাল্লাল ফাক্বীহ,
৭|ইসহাক্ব ইবনু মূসা রমলী,
৮|ইসমাঈল ইবনু সাফফার,
৯|হুসাইন ইবনু ইদরীস আল-হারুবী,
১০|আবু বাকর ইবনু দুনয়া,
১১|আবু দাউদের পুত্র আবু বাকর,
১২|আবূ বিশর দুলাবী,
১৩|আবু ‘আলী মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ লু’লুয়ী,
১৪|মুহাম্মাদ ইবনু রাজ বাসরী,
১৫|আবূ সালিম মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ আদামী,
১৬| মুহাম্মাদ ইবনু মুনযির,
১৭|উসামাহ মুহাম্মাদ ইবনু ‘আবদুল মালিক,
১৮|মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া মরদাস,
১৯| আবু বাকর মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া প্রমুখ।
২০|হাসান ইবনু ‘আবদুল্লাহ,
২১| মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফার ফিরয়াবী,
২২|যাকারিয়্যাহ ইবনু ইয়াহইয়া সাজী,

ইমাম আবু দাউদের রচিত গ্রন্থাবলীঃ
ইমাম আবু দাউদ বহু মূল্যবান গ্রন্থাবলী রচনা করেছেন।তন্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ

১। ইবতিদাউল ওয়াহী।
২। আখবারুল খাওয়ারিজ।
৩। আ’লামুন নাবুয়্যাহ ।
৪। কিতাবু মা তাফাররাদা বিহী আহলুল আমসার।
৫। আদ-দু’আ।
৬। আয-যুহদ।
৭। কিতাবুস সুনান (সুনানে আবি দাউদ)। যা ছয়টি প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থের একটি।
৮। কিতাবু ফাযায়িলে আনসার।
৯। আর রাদ্দু ‘আলাল ক্বাদরিয়্যাহ।
১০। আল-মারাসীল।
১১। আল-মাসায়িল।
১২। মুসনাদে মালিক ইবনু আনাস।
১৩। নাসিখ ওয়াল মানসূখ।
১৪ । মারিফাতুল আওকাত।

ইন্তেকাল:
ইমাম আবু দাউদ (রহ,) ৭৩ বছর বয়সে ১৫ শাওয়াল মতান্তরে ১৬ শাওয়াল ২৭৫ হিজরি সনে বসরা নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। বসরায় ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহ.)-এর পাশে সমাহিত করা হয়।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাজারকে রহমতের চাদরে আবৃত করুক ও আমাদেরকে তাঁর ফুয়ূজাত দানে ধন্য করুক। আমীন

শিক্ষার্থীঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা