কালের স্বাক্ষী সিআরবি; এ ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব সরকারের
চট্টগ্রাম শহর ভালো নেই। ভালো নেই এ শহরের মানুষগুলো। চারিদিকে দুঃসংবাদ। একদিকে মৃত্যুর মিছিল আর করোনা রোগিদের অসহায় আত্মসমর্পণ। হাসপাতালে আইসিউ সিট খালি নেই, অক্সিজেনের সংকট, করোনা ইউনিটে অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা; এসব নিত্যকার সংবাদ চট্টগ্রামের মানুষের মনে ক্রমশ হাহাকার বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে বন্যা, পাহাড় ধস, ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার আক্রমণে সর্বত্র এখন আতংক। ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন। কোথাও আশার আলো নেই। এসব দুঃসংবাদের মাঝে চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপর উড়ে এসেছে কালো মেঘের ঘনঘটা; চট্টগ্রামের ফুসফুস সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। এমন ষড়যন্ত্রমূলক সিন্ধান্তে দেশের একজন সচেতন নাগরিক ও বৃক্ষপ্রেমি হিসেবে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। হাসপাতাল নির্মাণ নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু মাতৃবৃক্ষ ধ্বংসের আত্মঘাতী সিন্ধান্ত নিয়ে নয়।
বলে রাখা ভালো, খাওয়া-দাওয়া জায়েজ কিন্তু নামাজ পড়া অবস্থায় হারাম। নামাজ নিঃসন্দেহে উত্তম ইবাদত কিন্তু জুমার খুতবা চলাকালীন নিষেধ। কুরআন তেলাওয়াত সর্বোত্তম নফল ইবাদত কিন্তু ঘুমন্ত মানুষের ঘুম নষ্ট করে নয়। এগুলো ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি হলেও বাস্তবতার সাথে শতভাগ মিল। কারণ ইসলাম কর্মময় ধর্মের নাম। অতএব মানুষের কল্যাণে হাসপাতাল হোক কিন্তু মহান আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক হাসপাতাল ধ্বংস করে নয়। কারণ সিআরবি স্বয়ং নিজেই একটি হাসপাতাল। পাহাড়ঘেরা সবুজের সমারোহ।
উঁচু-উঁচু দালানকোঠার এ যান্ত্রিক শহরে, বায়ুদূষণ ও যানজটের নগরে একটু ফ্রেশ হাওয়া, স্বস্তির নিশ্বাস যেন সোনার হরিণ! আর এ সোনার হরিনের সন্ধান মিলে ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষী সিআরবিতে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে একটু অক্সিজেন যে, কতবড় হাতিয়ার তা বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বছরের পর বছর সিআরবি’র মাতৃবৃক্ষগুলো আমাদেরকে এ অমূল্য সম্পদ অক্সিজেন পরম মমতায় ফ্রিতে দিচ্ছে বলে হয়তো কোন কোন বড়কর্তার কাছে এটা মূল্যহীন। তাই হয়তো সিআরবি ধ্বংসের এ নীলনকশা!
সারা পৃথিবী যখন গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান শ্লোগানকে জীবনের অপরিহার্য আর্ট হিসেবে নিয়েছে তখন চট্টগ্রামের শ্বাসক্রিয়া সিআরবি’র মাতৃবৃক্ষ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচন সময়ের দাবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন জনপ্রতি অন্তত তিনটি (ফলজ, বনজ ও ঔষুধী) গাছ লাগানোর জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন ঠিক তখনই সবুজের লীলাভূমি সিআরবি নিয়ে এ দুরভিসন্ধি গভীর ষড়যন্ত্রের বার্তা দেয়। একদিকে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীর মা মাছ রক্ষায় ব্যয়বহুল ব্যবস্থাপনা। অন্যদিকে সিআরবি’র মাতৃবৃক্ষ রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের উদাসীনতা। এক শহরে দুই নীতি কেন? এ পারশিয়ালিটি বীর চট্টলার মানুষকে ভাবাচ্ছে। চট্টগ্রামের ১০১ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতিতে বলা হয়, “এই ইট-পাথরের উঁচু দালান আর শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভিড়ে শতবর্ষী বৃক্ষে ঘেরা সিআরবিকে এক টুকরো অক্সিজেন প্ল্যান্ট বলা চলে। পাহাড়ের মধ্যে প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ করতে গেলে শতবর্ষী অনেক গাছ কাটা পড়ার পাশাপাশি এখানকার সবুজ নিসর্গ ধ্বংস হয়ে যাবে। হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রবের কবর, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই মাটি শহীদের স্মৃতিধন্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সিআরবি তথা পাহাড়তলী ছিল বিপ্লবের সূতিকাগার। সেসব স্মৃতি সংরক্ষণে রেল উদ্যোগ নেয়নি। অথচ শহীদের কবর, শহীদের নামে কলোনি, শহীদের নামে যে সড়ক সেই জমি তারা বেসরকারি হাসপাতালকে বরাদ্দ দিয়েছে।” বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করছেন। তার সুশাসনকে কলঙ্কিত করতে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী আমলা রেলের জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল প্রকল্পের দুঃসাহস দেখিয়েছেন। সিআরবি এলাকায় এই প্রকল্প স্থাপিত হলে সেটির নেতিবাচক প্রভাব শুধু প্রকল্পের নির্দিষ্ট স্থানেই সীমিত থাকবে না। সময়ের প্রয়োজনে এই প্রকল্প এলাকা ঘিরে নতুন স্থাপনা গড়ে উঠবে। যার ফলে পরিবেশ দূষণ ঘটবে। পুরো এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক বলয় হুমকির মুখে পড়বে। এ অবস্থায় আমরা চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও বন্দরনগরীর ফুসফুসখ্যাত সিআরবিতে শুধু হাসপাতাল নয়, কোনও ধরনের স্থাপনা করা সমীচীন হবে না। প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনাশী সব কর্মকাণ্ড হবে আত্মঘাতী। চট্টগ্রামের ফুসফুস ও বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্থানটিকে ঐতিহ্য হিসাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানাই।”
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক,
প্রতিষ্ঠাতা: আলো একাডেমি, চট্টগ্রাম।