ইসলামিক-সাওয়াল-জাওয়াব

রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা কি মু’মিন ছিলেন ? | সাওয়াল জাওয়াব

সেনানী ডেস্ক

সমগ্র জাহানের মুক্তির দূত রাসূলে খোদা ﷺ পৃথিবীতে এসেছেন মানবজাতিকে রক্ষা করবার জন্য এবং প্রত্যেক মুসলমান এমনকি যারা বলছেন, “রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা মু’মিন ছিলেন না” তারাও একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, তিনি ﷺ মানবজাতির মুক্তির জন্য এই ধরাধামে এসেছেন। নির্বোধ প্রজাতির সেই সব কথিত মুসলমানদের দুমুখো কথা শুনে নাস্তিকরাও বলবে, যাঁর নিজের পরিবার তথা পিতা-মাতা জাহান্নাম থেকে মুক্ত নয়, তিনি কিভাবে মানবজাতির মুক্তির দূত হতে পারেন? ইসলাম কে প্রশ্নবিদ্ধ করবার সকল পথ আপনারা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আপনাদের একেকটি ঈমান বিধ্বংসী আক্বিদা বেঈমান নাস্তিকদের কাছে ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হাতিয়ার।

পবিত্র কোরআনে নামাজের কথা উল্লেখ আছে কিন্তু কত রাকাত এবং কখন, কিভাবে পড়তে হবে তা উল্লেখ নেই। নামাজের রাকাত, সময় এবং কিভাবে পড়তে হবে তা জানতে হলে হাদিস শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। আক্বিদার বিষয়ও তার ব্যতিক্রম নয়।

 

প্রিয় রাসূল ﷺ’র শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা সহ পূর্বপুরুষ সকলেই মু’মিন ছিলেন এবং তাঁরা জান্নাতী। একথা কোরআন, হাদিস এবং বিশ্ব বিখ্যাত ইমামগণের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত।

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, মুশরিকদের চেয়ে মু’মিন বান্দাই উত্তম।

 

[রেফারেন্স: সূরা: বাকারা, আয়াত নং ২২১]

 

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল ﷺ ইরশাদ করেন, আদম সন্তানের প্রজন্ম পরম্পরায় আমি উত্তম প্রজন্মেই প্রেরিত হয়েছি। সেই ধারায় আমি বর্তমান এই প্রজন্মে এসে উপনীত হয়েছি।

 

[রেফারেন্স: সহীহ বুখারী: হা নং ৩৪৫৭]

 

সূরা বাকারার ২২১ নং আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি, মু’মিনরা উত্তম আর মুশরিকরা নিকৃষ্ট। আর রাসূলে খোদা ﷺ ইরশাদ করেছেন, আদম সন্তানের প্রজন্ম পরম্পরায় আমি উত্তম প্রজন্মেই প্রেরিত হয়েছি। অর্থাৎ রাসূল ﷺ স্বয়ং নিজেই তাঁর পূর্বপুরুষগণর মু’মিন হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন।

 

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে হাবীব! আমি আপনাকে সিজদাকারীদের (নামাজীদের) মধ্যে আপনার স্থানান্তর করান।

 

[রেফারেন্স: সূরা: আশ-শূরা, আয়াত নং ২১৮-২১৯]

 

এবার এই আয়াতের ব্যাখ্যায় যুগশ্রেষ্ঠ তাফসিরের ইমামগণ কি বলেছেন তা নিম্নে দেওয়া হলো।

 

১. বিশ্ব বিখ্যাত মুফাসসির ও হাফিজুল হাদিস, ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রা.) (৯১১ হি.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন, উক্ত আয়াতের অর্থ হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ’র নূর মোবারক নামাজী থেকে নামাজী অর্থাৎ ঈমানদারদের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছে। এই সূত্রমতে উক্ত আয়াতে কোরআনী দালালত করে যে, আখেরী নবী ﷺ’র বংশীয় সকল পূর্ব পুরুষগণ মুসলমান ছিলেন। ইমাম কাসতাল্লানী (রা.)-ও অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।

 

[রেফারেন্স: ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৫৪ পৃ:, ইমাম কাসতাল্লানী: আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ, ১/১০৪ পৃ:]

 

২. ইমাম আবু হাইয়্যান আন্দুলসী (রা.) তাঁর তাফসিরে বলেন, এ বিষয়ে রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা এবং তাঁর পূর্বপুরুষগণ যে ঈমানদার এ আয়াত তার দলিল।

 

[রেফারেন্স: ইমাম আবু হাইয়্যান আন্দুলসী: তাফসিরে বাহারুল মুহিত, ৮/১৯৮ পৃ:]

 

৩. ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী (৪৩০:হি.) ও ইমাম আবু সাঈদ বিন আরাবী (৩৪০ হি.) উল্লেখ করেন, হযরত আব্বাস (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, নবীদের মাধ্যমে তাঁর স্থান্তরিত হয়ে, পিতা-মাতা পৌঁছে পর্যন্ত সকলেই সিজদাকারী ছিলেন।

 

[রেফারেন্স: ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী: দালায়েলুল নবুয়ত, ১/৫৮ পৃ:, হা নং ১৭, ইমাম আবু সাঈদ: মু’জামে ইবনে আরাবী, ২/৮৪৯ পৃ:, হা নং ১৭৫০]

 

৪. ইমাম ইবনে যুযাজ (রা.) (৩১১ হি.) তাঁর তাফসিরে বলেন, সিজদাকারীদের মধ্যে আপনার বিবর্তন অর্থাৎ নামাজীদের মধ্যে আপনার আগমন।

 

[রেফারেন্স: ইমাম ইবনে যুযাজ: মা’নীল কোরআন, ৪/১০৪ পৃ:]

 

৫. ইমাম সমরকান্দী (রা.) (৩৭৩ হি.) বর্ণনা করেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)’র ছাত্র তাবেঈ ইমাম ইকরামা (রা.) বলেন, সিজদাকারীদের মাধ্যমে আপনার বিবর্তন অর্থাৎ আপনার পিতৃপুরুষদের পৃষ্ঠদেশ ও মাতাদের মাধ্যমে হযরত আদম (আ.) থেকে নূহ (আ.) ও ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পরবর্তীদের মাধ্যমে আগমন আল্লাহ তাঁদের সকলের উপর শান্তি বর্ষিত করুন।

 

[রেফারেন্স: তাফসিরে বাহরুল মুহিত, ২/৫৭০ পৃ:]

 

৬. ইমাম কুরতুবী (রা.) (৬৭১ হি.) বলেন, সিজদাকারীদের মাধ্যমে আপনার আগমন এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাবেঈ ইমাম কাতাদা (রা.) এবং ইমাম মুজাহিদ (রা.) বলেন, নামাজিদের মাধ্যমে আপনার আগমন। সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) তিনি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তিনি সিজদাকারী পিতাসমূহের পৃষ্ঠদেশের মাধ্যমে তাঁর আগমন।

 

[রেফারেন্স: তাফসিরে কুরতুবী: ১৩/১৪৪ পৃ:]

 

৭. ইমাম নিযামুদ্দিন নিশাপুরী (রা.) (৮৫০ হি.) বলেন, সিজদাকারীদের মাধ্যমে আপনার বিবর্তন অর্থাৎ তাঁর স্থানান্তর এক সিজদাকারী হতে আরেক সিজদাকারীর মধ্যে,  যেমনিভাবে রাসূল ﷺ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি ইরশাদ করেন, সর্বদা পাক পবিত্র পিতাদের থেকে পবিত্র মাতাদের নিকট আমি স্থানান্তরিত হয়েছি।

 

[রেফারেন্স: তাফসিরে নিশাপুরী: ৩/১০৩ পৃ:]

 

রাসূল ﷺ ইরশাদ করেন, সর্বদা পাক পবিত্র পিতাদের থেকে পবিত্র মাতাদের নিকট আমি স্থানান্তরিত হয়েছি।

 

[রেফারেন্স: ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৫৪ পৃ:, আবু নুয়াইম ইস্পাহানী: হুলিয়াতুল আউলিয়ার সূত্রে, এছাড়া হাদিসটি পাওয়া যায়। ইমাম রাজি: তাফসিরে কাবীর, ১৩/৩৩-৩৪ পৃ:, ২৪/৫৩৭ পৃ:, আবু হাইয়্যান আন্দুলসী: তাফসিরে বাহারুল মুহিত, ৮/১৯৮ পৃ:, আবু হাফস দামেস্কী, তাফসিরে আল-লুবাব ফি উলূমিল কিতাব, ৮/২৩৩-২৩৪ পৃ:, ইসমাঈল হাক্কী: তাফসিরে রুহুল বয়ান, ৩/৫৪ পৃ:, ৬/৩১৩ পৃ:, জুহাইলী: তাফসিরুল মুনীর, ১৯/৩৩৯ পৃ:]

 

ইমাম ইবনে জারীর (রা.) ও ইমাম ইবনে আবি হাতেম (রা.) উভয়েই তাঁদের তাফসিরে লিখেছেন, তাবেঈ ইমাম কাতাদা (রা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকে শাস্তি প্রদান করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সংবাদ বা কোন প্রমাণ না পৌঁছবে।

 

[রেফারেন্স: ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৪৫ পৃ:]

 

যেমন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি শাস্তি প্রদান করি না।

 

[রেফারেন্স: সূরা: বনী ইসরাঈল, আয়াত নং ১৫]

 

তাই রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতার সময়ে কোন নবী কিংবা রাসূল ছিলেন না, বরং বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তাঁরা উভয়েই হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তথা মহান আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

 

হযরত আলী (রা.) বলেন, নিশ্চয় রাসূল ﷺ ইরশাদ করেন, অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়, বৈবাহিক সম্বন্ধ থেকেই আমি নির্গত হয়েছি। হযরত আদম (আ.) থেকে আমার পিতা-মাতা আমাকে জন্ম দেয়া পর্যন্ত আমার বংশ ধারায় এ পবিত্রতা অব্যাহত ছিল। আমার জন্মে জাহিলিয়াতের কোন অপকর্ম আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

 

[রেফারেন্স: ইবনে কাসির: বেদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/৩১৪ পৃ:] হাদিসটির সনদ হাসান।

হাদিস শরীফের আলোচনায় আমরা বুঝতে পারলাম যে, আদম (আ.) থেকে রাসূল ﷺ পর্যন্ত তাঁর সকল পূর্বপুরুষগণই পুতঃপবিত্র তথা ঈমানদার ছিলেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, মুশরিকরা হচ্ছে, অপবিত্র।

[রেফারেন্স: সূরা: তাওবা, আয়াত নং ১২৮]

ইমাম সুয়ূতী (রা.) সংকলন করেন, ইমাম ইবনে শাহীন (রা.) তাঁর “নাসেখ ওয়াল মানছুখ” গ্ৰন্থে ইমাম খতিবে বাগদাদী (রা.) তাঁর “সাবেক ওয়াল লাওয়াহেক” ইমাম দারাকুতনী এবং ইমাম ইবনে আসাকির (রা.) তাঁর “তারীখে দামেস্কে”, কিছুটা দুর্বল সনদে হযরত মা আয়েশা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, বিদায় হজ্বের সময়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ বেদনার্ত ছিলেন। এসময় তিনি ﷺ আনন্দচিত্তে আমার নিকট আগমন করেন। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি ﷺ বলেন, আমি আমার মা আমেনা (রা.)’র কবরের নিকট গমন করি এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করি তাঁকে জীবিত করতে। তখন আল্লাহ তাঁকে জীবিত করেন, তিনি আমার উপর ঈমান আনয়ন করেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁকে ফিরিয়ে নেন। কোনো কোনো বর্ণনায় পিতা-মাতা উভয়ের কথা বলা হয়েছে।

[রেফারেন্স: ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৭৮ পৃ:, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত লেবানন, প্রকাশ. ১৪২৪ হি., ইমাম কুরতুবী: তাযকিরাহ, ১৫ পৃ:, ইমাম কাসতাল্লানী: মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ, ১/১০৩ পৃ:, ইবনে সালেহ শামী: সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২/১২২ পৃ:, দিয়ার বাকারী: তারিখুল খামিস, ১/২৩০ পৃ:] আরো অসংখ্য কিতাবে হাদিসটি উল্লেখ আছে।

ইমাম কাসতাল্লানী (রা.) সংকলন করেন, ইমাম তাবারী (রা.) হযরত মা আয়েশা (রা.) হতে সনদ সহকারে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বিষন্ন ও চিন্তিত অবস্থায় হাজ্জুন নামক কবরস্থানে আল্লাহর মর্জি মুতাবেক অবতরণ বা অবস্থান করলেন। অতঃপর আনন্দিত হয়ে দাঁড়ালেন বা উঠলেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি ﷺ বললেন, আমি আমার রবের কাছে প্রার্থনা করেছি যে, আমার মাকে জীবিত করে দেয়ার জন্য অতঃপর আল্লাহ তাঁকে জীবিত করে দিলেন। অতঃপর তিনি আমার উপর ঈমান আনলেন। তারপর তাঁকে কবরে ফিরিয়ে দেন।

[রেফারেন্স: ইমাম কাসতাল্লানী: মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ, ১/১০৩ পৃ:]

ইমাম সুয়ূতী (রা.) সংকলন করেন, ইমাম সুহাইলী (রা.) তাঁর “রাওজুল উনূক” গ্ৰন্থে তিনি বলেছেন, সনদে অজ্ঞাত রাবীদ্বয় রয়েছে, হযরত মা আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, তিনি যেন তাঁর পিতা-মাতা কে জীবিত করে দেন। তখন আল্লাহ তাঁদেরকে জীবিত করে দেন। অতঃপর তাঁরা রাসূল ﷺ’র প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। অতঃপর তাঁরা মৃত্যুবরণ করলেন।

[রেফারেন্স: ইমাম সুহাইলী: রওজুল উনূক, ২/১২১ পৃ:, দারু ইহইয়াউত তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন প্রকাশ. ১৪২১হি. ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৭৮ পৃ:, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৪২৪হি.]

ইমাম সুহাইলী (রা.) সনদটি সংকলন করেন, মুআওজ ইবনু দাউদ (রা.) তিনি আব্দুর রহমান বিন আবি যানাদ (রা.) তিনি হিশাম বিন উরওয়া থেকে তিনি তাঁর পিতা থেকে তিনি হযরত মা আয়েশা (রা.) হতে।

[রেফারেন্স: ইমাম সুহাইলী: রওজুল উনূক, ২/১২১ পৃ:, দারু ইহইয়াউত তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন প্রকাশ. ১৪২১হি.]

হাদিসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়াতে সব মিলিয়ে হাদিসটির সনদের মান “হাসান” পর্যায়ের, যা দ্বারা দলিল গ্ৰহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ।

আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যাদের ধারণা, রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা মুশরিক তথা বেঈমান অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। অতঃপর রাসূল ﷺ তাঁদের জীবিত করে কলেমা পড়িয়ে ঈমানদার করেছেন। এটা সম্পূর্ণ গলদ কথা, আগেই বলেছি রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা উভয়েই হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তথা মহান আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ঈমানদার ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তাঁরা রাসূল ﷺ’র নবুয়ত মানব সমাজে প্রকাশের আগেই ইন্তেকাল করেছেন তাই তাঁদের রাসূল ﷺ’র উম্মত হওয়ার সেই পরম সৌভাগ্য নসিব হয়নি। আল্লাহর হুকুমে রাসূল ﷺ তাঁদের উভয়কেই জীবিত করেন, তাঁরা রাসূল ﷺ’র প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ৭ জন মুজতাহিদ ফকিহদের অন্যতম, আহলে বাইতের সদস্য হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)’র আক্বিদা ছিল রাসূল ﷺ’র উর্দ্ধতন সকল পূর্বপুরুষ ঈমানদার ছিলেন। ইমাম তাবরানী (রা.) সংকলন করেন, ইমাম ইকরামা (রা.) তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন, মহান রবের বাণী সিজদাকারীদের মাধ্যমে আপনার বিবর্তন এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, নবী থেকে নবী শেষ পর্যন্ত আমি নবী হয়েই প্রেরিত হয়েছি।

[রেফারেন্স: ইমাম তাবরানী: মু’জামুল কবীর, ১১/৩৬২ পৃ:, হা নং ১২০২১, ইমাম হাইছামী: মাযমাউয-যাওয়াইদ, ৭/৮৬ পৃ:, হা নং ১১২৪৭]

ইমাম হাইছামী (রা.) সংকলন করেন, এই হাদিসটি ইমাম বাযযার, তাবরানী (রা.) সংকলন করেন, আর সনদের সমস্ত বর্ণনাকারীই সহীহ বুখারীর শুধু “সাবিব ইবনে বিশর” ছাড়া, কিন্তু তিনিও সিকাহ বা বিশ্বস্ত।

[রেফারেন্স: ইমাম হাইছামী: মাযমাউয-যাওয়াইদ, ৭/৮৬ পৃ:, হা নং ১১২৪৭]

আহলে হাদিসের কথিত ইমাম নাসিরউদ্দিন আলবানী (লা.) সাবিব ইবনে বিশর কে দুর্বল প্রকাশ করেও তার সহীহ হাদিসের গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, আমি বলি, এই সনদটি “হাসান” সমস্ত বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত, সাবিবের বিষয়ে আপত্তি গ্ৰহণযোগ্য নয়।

[রেফারেন্স: সিলসিলাতুল আহাদিসুস সহীহা, ১/৬৮৯ পৃ:, হা নং ৩৫৪]

অর্থাৎ আলবানীও স্বীকার করে নিয়েছে যে, রাসূল ﷺ’র পূর্বপুরুষগণ ঈমানদার ছিলেন।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল ﷺ ইরশাদ করেন, আমি বনি আদমের সর্বোত্তম যুগে আবির্ভূত হয়েছি। যুগের পর যুগ অতিবাহিত হয়ে আমি সেই যুগেই এসেছি যে যুগ আমার জন্য নির্দিষ্ট ছিল।

[রেফারেন্স: সহীহ বুখারী: ৪/১৮৯ পৃ:, হা নং ৩৫৫৭]

অর্থাৎ আমি যখনই যাঁর কাছে ছিলাম সেই যুগের সর্বোত্তম মানুষের কাছেই ছিলাম, তাঁরা ছিলেন সেই যুগের শ্রেষ্ঠ ঈমানদার।

রাসূল ﷺ’র পরিবার পরিজনের সকলেই রাসূল ﷺ’র শাফায়াত লাভ করবে, আর তাঁর শাফায়াত লাভ করার অর্থ হচ্ছে নিশ্চিত জান্নাতী।

ইমাম তাবরানী (রা.) সংকলন করেন, হযরত আব্দুর রাহমান বিন রা’ফে (রা.) তিনি উম্মে হানী (রা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,… অতঃপর রাসূল ﷺ’র ইরশাদ করেন, সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে আমার পরিবারবর্গ আমার শাফায়াত লাভ করবে না। নিশ্চয় আমার শাফায়াত “হা” ও “হুকুম” গোত্রদ্বয় পর্যন্ত লাভ করবে। বর্ণনাকারী বলেন, “হা” ও “হুকুম” হলো দুটি গোত্র।

[রেফারেন্স: ইমাম তাবারানী: মু’জামুল কবীর, ২৪/৪৩৪ পৃ:, হা নং ১০৬০, ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৫১ পৃ:, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৪২৪ হি., হাইছামী: মাযমাউয-যাওয়াইদ, ৯/২৫৭ পৃ:, হা নং ১৫৪০১] সনদ সহীহ।

হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল ﷺ ইরশাদ করেন, সে সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে যে, আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক কোন উপকার করবে না। কিন্তু না, অবশ্যই উপকার করবে। এমনকি “হুকুম” সম্প্রদায় পর্যন্ত উপকৃত হবে। “হুকুম” হলো ইয়েমেনের একটি গোত্র। আমি শাফায়াত করবো এবং যার জন্য শাফায়াত করবো তা গ্ৰহণ করা হবে। শেষ পর্যন্ত ইবলিশও শাফায়াতের আবেদন করবে।

[রেফারেন্স: ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৫১ পৃ:, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৪২৪ হি.]

উপরোক্ত দুটি হাদিসে পাক থেকে বুঝা যায় যে, রাসূল ﷺ’র পরিবারের সকলে রাসূল ﷺ’র শাফায়াত লাভ করবেন।

রাসূল ﷺ’র পূর্বপুরুষগণের সম্পর্কে যুগশ্রেষ্ঠ ইমামদের আক্বিদা কেমন ছিল ?

১. ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রা.) বলেন, রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা সমন্ধে শরয়ী হুকুম হলো তাঁরা উভয়েই নাজাতপ্রাপ্ত এবং তাঁরা জাহান্নামী নয়। অনেক উলামায়ে কেরামগণ এ ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।

[রেফারেন্স: ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৪৪ পৃ:]

২. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রা.) প্রাথমিক জীবনে রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা জাহান্নামী ও কাফের হওয়ার উপরে অভিমত পেশ করেন। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতীর কিতাব অধ্যায়নের পরে তাঁর ভুল ভেঙ্গে যায় এবং ইতোপূর্বের আক্বিদা ঠিক করে নেন। যেমন তিনি তাঁর শেষের দিকের গ্ৰন্থে তিনি লিখেছেন, বিশুদ্ধ অভিমত হলো, রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা উভয়ই ইসলাম গ্ৰহণ করেছিলেন, এ বিষয়ে উম্মতের মর্যাদাপূর্ণ ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন। যেমনটি ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রা.) তাঁর তিনটি রিসালায় উল্লেখ করেছেন।

[রেফারেন্স: মোল্লা আলী ক্বারী: শরহে শিফা, ১/৬০৫ পৃ:, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন]

৩. বিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং সকলের মান্যবর ইমাম হাজার আসকালানী (রা.) লিখেন, নিশ্চয় রাসূলে পাক ﷺ’র পিতা-মাতা সমন্ধে যে ধারণা করা যায় যে, তাঁরা প্রত্যেকেই কিয়ামতের দিন পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হবেন।

[রেফারেন্স: ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৫১ পৃ:]

৪. ইমাম ইবনে সালেহ শামী (রা.) উল্লেখ করেন, রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা শিরক করেছেন তা প্রমাণিত নয়, বরং তাঁরা তাঁদের দাদা ইব্রাহিম (আ.)’র দ্বীনে বনী হানাফিয়্যার উপরে বিশ্বাসী ছিলেন। যেমন আরবে জাহিলী যুগে এমন ঈমানদার যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইলসহ আরো অনেকে ছিল। এ মসলকের উপরে রয়েছেন ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী। সেখানে তিনি আরো অতিরিক্ত বলেছেন, রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা থেকে বাবা আদম (আ.) পর্যন্ত সকলেই তাওহিদ বা একত্ববাদের উপরে বিশ্বাসী ছিলেন।

[রেফারেন্স: ইমাম ইবনে সালেহ শামী: সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/২৫৫ পৃ:, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী: তাফসিরে কাবীর, ৪/৭৭ পৃ:]

৫. ইমাম কুরতুবী (রা.) বলেন, পুনর্জীবন সংক্রান্ত হাদিস ও ইস্তেগফার নিষেধ এর মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ পুনর্জীবন সংক্রান্ত ঘটনা ইস্তেগফার সংক্রান্ত ঘটনার অনেক পরে হয়েছে। যেমন মা আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস তার প্রমাণ। তিনি বলেছেন, পুনর্জীবন এর ঘটনা বিদায় হজ্বের সময় ঘটেছিল। এজন্য ইবনে শাহীন (রা.) এ হাদিসকে অন্যান্য হাদিসের নাসিখ ও বা রহিতকারী নির্ধারণ করেছেন।

[রেফারেন্স: ইমাম কুরতুবী: তাযকিরা, ১৩৮ পৃ:, ইমাম সুয়ূতী: আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৭৮ পৃ:, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৪২৪হি.]

৬. আহলে হাদিসদের শ্রদ্ধাভাজন ইমাম, ইমাম ইবনে কাসির (রা.) উল্লেখ করেন, হিশাম বিন মুহাম্মদ কালবী (রা.) তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসূল ﷺ’র মায়ের বংশধারার ৫০০ মহিলার তালিকা সংকলন করেছি। তাঁদের কোন একজনকে না ব্যাভিচারী পেয়েছি, না জাহিলী যুগের কোন অনাচারের (মুশরিকী কর্মকাণ্ড) সম্পৃক্ততা পেয়েছি।

[রেফারেন্স: ইবনে কাসির: বেদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/৩১৪ পৃ:]

বিরুদ্ধবাদীরা সহীহ মুসলিম শরীফের একটি হাদিস শরীফ তাদের পক্ষে দলিল হিসেবে উত্থাপন করে থাকেন। যা তাদের অজ্ঞতার প্রমাণ বহন করে।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, (মক্কা বিজয়ের সময়) রাসূল ﷺ তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করেন। তখন তিনি এমনভাবে ক্রন্দন করেন যে তাঁর সাথীগণও ক্রন্দন করতে থাকেন। রাসূল ﷺ বলেন, আমি আমার রবের নিকট আমার মায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার অনুমতি চাইলাম কিন্তু আমাকে অনুমতি দেয়া হলো না। তারপর আমি তাঁর কবর জিয়ারতের অনুমতি চাইলাম। তখন আমাকে অনুমতি দেয়া হলো। তোমরা কবর জিয়ারত করবে, কারণ তা মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

[রেফারেন্স: সহীহ মুসলিম: ২/৬৭১ পৃ:, হা নং ৯৭৬]

হাদিস শরীফটি সহজে অনুধাবনের জন্য আমি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত নিম্নে উল্লেখ করছি।

মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আপনি কখনো তাদের (মুনাফিক) কারোর উপর (জানাযার) নামাজ পড়বেন না এবং তাদের কবরের নিকট (জিয়ারতের জন্য) দাঁড়াবেন না।

[রেফারেন্স: সূরা: তাওবাহ, আয়াত নং ৮৪]

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূল ﷺ-কে মুনাফিক তথা বেঈমানদের জানাযা পড়তে এবং কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু মুসলিম শরীফের হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা রাসূল ﷺ-কে মা আমেনা (রা.)’র কবর জিয়ারতের অনুমতি দিয়েছেন। অর্থাৎ মা আমেনা (রা.) ঈমানদার ছিলেন। উক্ত হাদিস শরীফও রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতা মু’মিন হওয়ার প্রমাণ বহন করে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা কেন রাসূল ﷺ-কে মাগফেরাতের অনুমতি দেননি ? উত্তরটা খুবই সহজ, মাগফেরাত করা হয়ে থাকে গুনাহগার বান্দার জন্য কিন্তু মা আমেনা (রা.)’র তো কোন গুনাহ ছিল না। তাই আল্লাহ তায়ালা রাসূল ﷺ-কে মাগফেরাতের অনুমতি দেননি বরং কবর জিয়ারতের অনুমতি দিয়েছেন, যেহেতু নেককার, বদকার সকলেরই কবর জিয়ারত করা যায়।

রাসূল ﷺ’র পিতা-মাতাকে কেউ জাহান্নামী বললে, রাসূল ﷺ অবশ্যই কষ্ট পাবেন। সব বিষয় বুঝতে কোরআন হাদিসের দলিলের প্রয়োজন পড়ে না, নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন, নিজেকে দিয়ে বিচার করুন, খুব সহজেই উত্তর পেয়ে যাবেন।

রাসূল ﷺ-কে কষ্টদানকারী পাপিষ্ঠদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, যারা আল্লাহকে ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ অব্যশই তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে লা’নত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।

[রেফারেন্স: সূরা আহযাব, আয়াত ৫৭]

আল্লাহ তায়ালা রাসূল ﷺ’র  সম্পর্কিত অনেক আক্বিদার বিষয় সরাসরি কোরআনে কিংবা হাদিসে উল্লেখ করেননি। তার কারণ হচ্ছে, সবকিছু যদি সরাসরি মানার জন্য নির্দেশনাই থাকে, তাহলে মুনকির-নকিরের ৩ নাম্বার প্রশ্ন, “ইনার (রাসূল ﷺ) প্রতি তুমি দুনিয়াতে কি ধারণা পোষণ করতে” এই প্রশ্ন অর্থহীন হয়ে যেতো।